ফিলিস্তিন ইজরাইল ইস্যুতে অনেক নাস্তিকের সঙ্গেই আমার মেলে না। ইজরাইল ফিলিস্তিনি সংঘাতের বদলে সেখানে শান্তিপূর্ণ অবস্থা না হওয়ার পিছনে যে বড় একটি কারণ ধর্ম সেটি তারা ধরতে পারে না। একইভাবে দুটো ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ যে তাদের মুখপাত্র সেটিও অনেকে মনে রাখেন না। সে বিষয়ে আলাপ করার আগে একটু ধর্মীয় অধিকারের জায়গা থেকে জেরুযালেম কাদের কতটুকু সেটি আবার একটু অল্প কথায় বলাটা প্রাসঙ্গিক।
কাশি গয়া যে হিন্দুদের প্রধান তীর্থ সেটি নিশ্চয় সবাই স্বীকার করবেন। এখন কাশিতে জ্ঞানবাপী মসজিদকে কেন্দ্র করে যদি মুসলমানরা গয়া কাশিকে তাদের পবিত্র তীর্থস্থান দাবী করে সেটা কেমন হবে? আসাদউদ্দিন ওয়াসিস কিন্তু সেরকমই একটা গ্যাঞ্জাম শুরু করার চেষ্টা করছে। হিন্দুত্ববাদীরা জ্ঞানবাপী মসজিদ সরানোর দাবী করছে। ইতিহাসের স্বীকৃতি দরকার। ঔরাঙ্গজেব যে ভুল করেছিলো মসজিদটি তৈরি করে সেটির স্বীকৃতি ও স্বীকারোক্তি জরুরী। যাই হোক, এখন জেরুযালেমে আল আকসা মসজিদটি ঠিক জ্ঞানবাপী মসজিদের মতই তৈরি করা হয়েছিলো মুসলমানরা যখন জেরুযালেম দখল করে নেয়। ওমর জেরুযালেম সফর করে এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ইসলামের নবী অলৌকিক উপায়ে একরাতের মধ্যে মক্কা থেকে জেরুযালেম ভ্রমণ করে এখানে থেমেছিলেন সেটি বিশ্বাস করেই ইহুদীদের প্রধান তীর্থস্থানে মসজিদটি তৈরি করা হয়। ইসলামের নবীর ভ্রমণটি কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাসের বিষয়, কারণ যখন তিনি দাবী করেছেন এই ভ্রমণের কথা তখন তিনি ওমরদের সঙ্গেই মক্কায় অবস্থান করছিলেন। এরকম একটি বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে মসজিদ তৈরি করে জেরুযালেমকে ইসলামের অন্যতম পবিত্রস্থান দাবী করে বছরের পর বছর আল আকসায় নামাজ পড়তে পুরো ফিলিস্তিন খালি করে এখানে আসাটার পেছনে কি কোন উদ্দেশ্য নেই? ইসলামের প্রাথমিক যুগে জেরুযালেমে ইহুদীদের পবিত্র এই প্রার্থনাস্থানকে কিবলা করা হয়েছিলো। পরে এখান থেকে কেবলা সরিয়ে মক্কাকে নির্বাচিত করা হয়েছিলো। সে হিসেবেও জেরুযালেম ইসলামের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন যেন জেরুযালেমে জুম্মার নামাজ পড়লে সোয়াব বেশি! এই যে মানসিকতা কি করে এখানে শান্তি আসবে? এটা তো ধর্মীয় সমস্যা। এই সমস্যার বিজ তখনই রোপন করা হয়েছিলো যখন ইহুদীদের তীর্থস্থানে মসজিদ করা হয়েছিলো।
এবার আসি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কথায়। ইহুদী জাতীয়তাবাদ বা জায়নবাদকে অত্যন্ত ঘৃণা স্বরূপ দেখা হয়। যারা সুশীল তারা নিজেদের কোন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয় এটা নিশ্চিত করতে বলেন, আমরা ইহুদী বিরোধী না, জায়নবাদের বিরুদ্ধে। তো জায়নবাদটা কি?
অল্প কথায় জায়নবাদ হচ্ছে, ইহুদীদের স্বাতন্ত্র্য ইহুদী পরিচয় ধরে রাখা এবং অন্য জাতি সত্ত্বার মধ্যে মিশে না যাওয়া। জায়নবাদ থেকে ইহুদীদের নিজস্ব দেশের দাবী তোলা হয়। তাদের হারানো ভূমিকে ফিরে পেতে পৃথিবীর একমাত্র ‘ইহুদী দেশ’ ইজরাইলের জন্ম ঘটে জায়নবাদের মাধ্যমে।
ধার্মিক মুসলমানরা ইহুদী-ইজরাইলদের ঘৃণা করে ধর্মীয় কারণে। কিন্তু বাম, লিবারাল, সেক্যুলার, প্রগতিশীলদের জায়নবাদের বিরুদ্ধে থাকার কারণ হচ্ছে বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চিন্তার বিরোধী অবস্থান থেকে। কিন্তু আপনি কি কখনো তাদের কাছ থেকে ‘মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদকে’ জায়নবাদের মতই ঘৃণা করতে দেখেছেন?
ভারতবর্ষে মুসলিমরা কোন জাতি সত্ত্বায় একভূত না হয়ে ‘মুসলিম’ পরিচয়ে থেকেছে। নিজেদের ‘মুসলিম জাতি’ পরিচয় দিয়েছে। সেখান থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বে মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ চেয়েছে। জাতিসংঘে আজো তারা ৫৭টি ‘মুসলিম দেশ’ ‘মুসলিম জাতি’। মুসলিম অর্থনীতি, মুসলিম ব্যাংকিং, মুসলিম টুরিজম, মুসলিম খেলোয়ার, মুসলিম নেতা, মুসলিম বিজ্ঞানী, মুসলিম অভিনেতা- এগুলো জায়নবাদের ইহুদীদের স্বাতন্ত্র্যবাদের মতই মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ নয়?
ইজরাইল যে দর্শন থেকে জন্ম নিয়েছিলো সেই একই রকম দর্শন থেকেই পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিলো। যদি ইজরাইলের জন্য ফিলিস্তিনীদের ভূমি হারাতে হয়ে থাকে তাহলে পাকিস্তানের জন্য পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের ভূমি হারাতে হয়েছে। রক্ত ঝরাতে হয়েছে আর শরণার্থী জীবন বেছে নিতে হয়েছে। জায়নবাদীদের পৃথিবীর লিবারালরা ঘৃণা করলেও ‘মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদীদের’ বিষয়ে নৈবচ নৈবচ…! উল্টো যারা মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদীদের সমালোচনা করে তারা হয়েছে এই সুশীলদের চোখে ‘মুসলিম বিদ্বেষী’!
ইমরান খান, এরদোয়ান নিজেরা ও তাদের দেশগুলো মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ জাহির করে। পাকিস্তানী তূর্কি আরবী বাঙালী ইত্যাদি পরিচয়গুলো অতিক্রম করে ‘মুসলিম বিশ্ব’ ‘মুসলিম ভ্রাতৃত্ব’ ‘মুসলিম উম্মাহ’ মুসলিমদের বিভিন্ন জাতি ও্ রাষ্ট্রে আত্মীকরণ করতে দিচ্ছে না। যদি এগুলো আপনার কাছে আত্মপরিচয় হয়ে থাকে তাহলে জায়নবাদকে সমালোচনা করার কোন অধিকার কি আপনার আছে?
রবীন্দ্রনাথ ইজরাইল রাষ্ট্রের জন্মে অনেক আগেই বলেছিলেন, ইহুদীদের ইউরোপে বিভিন্ন জাতি সত্ত্বায় মিশে যাওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। তা না করে ইহুদী পরিচয়ে কোন জাতিরাষ্ট্র করাটা হীতে বিপরীত হবে…। আমি ঠিক এই কথাটাই বলি। মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদের বিরোধীতা করে মুসলিম সম্প্রদায়কে নিজ নিজ জাতি সত্ত্বায় মিশে যেতে হবে। এসব বলার জন্যই আমি ‘মুসলিম বিদ্বেষী’ ‘ইসলাম বিদ্বেষী’!
#সুষুপ্তপাঠক
14 May 2022
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................