#সিরাজউদ্দৌলার_বিয়ে
©souvik
+++++++++++++++
বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিল আক্ষরিক অর্থেই একটা আগাপাশতলা ছ্যাঁচড়া ছোটোলোক। তার আশেপাশে থাকা মানুষের কাছে ছোট থেকেই সে ছিলো এক নিদারুন বিভীষিকার নাম। একে তো দাদুর আদরে বখে যাওয়া ছেলে‚ আর তারউপর সেই দাদু আবার যে সে কেউ না‚ খোদ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খান। ফলে ছোট থেকেই সিরাজ বিপজ্জনক বস্তু হিসাবেই এতটাই নামডাক করে ফেলে যে‚ ঐতিহাসিক গোলাম হোসেনের মতে যখনই চলার পথে সিরাজের সাথে কেউ মুখোমুখি হতো সে মনে মনে এক হাত লাফিয়ে উঠে বলতো‚ আল্লাগো বাঁচাও‚ ডরাইসি।
.
তো এই হেন সিরাজ ঘটনাচক্রে একদিন মুখোমুখি হলো সিরাজের বন্ধু তথা তার সমস্ত দুষ্কর্মের সঙ্গী মোহনলালের বোন মাধবী ওরফে হীরার সাথে। পলাশীর যুদ্ধ খ্যাত কাশ্মীরি মোহনলাল! ব্রিটিশ বিরোধী হাওয়ায় বাঙ্গালী নাট্যকাররা একসময় যাকে পাম্প দিয়ে দিয়ে একেবারে দেবদূতের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল!
যাইহোক‚ এই মোহনলাল ছিল সিরাজের সমবয়সী এক কাশ্মীরি ব্রাহ্মন! মুর্শিদাবাদ রাজপ্রাসাদে সিরাজের হাতে গোনা শুভাকাঙ্খীর দের মধ্যে একজন! আগেই বলেছি‚ সিরাজের সকল দুষ্কর্মের সাথী ও প্রশ্রয়দাতা । ইংরেজ কোম্পানির ল সাহেবের মতে, “The greatest scoundrel of earth has ever borne”।
আর পড়বি তো পড় সিরাজের নজর পড়লো গিয়ে কিনা এই মাধবীর উপরেই। আসলে স্বভাব চরিত্র খুব ভালো ছিলো তো‚ সমস্ত মেয়েদেরই …………!
.
ভাগ্যান্বেষী মোহনলাল দেখলো এই সুযোগ‚ ঘাটের মরা আলীবর্দী আজ মরে কি কাল মরে ঠিক নেই‚ তার পরে সিরাজই হবে পরবর্তী নবাব। তাকে হাতে রাখা কি মোটেও খারাপ কিছু? ফলে একদিন নিজের বোনকে সাজিয়ে গুজিয়ে তুলে দিয়ে আসলো সিরাজের হেরেমে। তারপর যা হওয়ার তাই হলো‚ আর সময়মতো সিরাজের ঔরষে মাধবী এক ফুটফুটে ছেলের জন্ম দিয়ে দিলো।
.
বেচারা মাধবী। দাদার নোংরা উচ্চাকাঙক্ষার বলি সে! এখন তো আর করারও কিছু নেই। লোক জানাজানি হলে বিপদ। কেউ না জানলে আরো বিপদ। অগত্যা উপায়ান্তর না পেয়ে শেষে তাকে সেই সিরাজের পায়েই হুমড়ি খেয়ে পড়তে হলো। যে‚ তোমার ছেলে‚ তুমিই ব্যবস্থা করো। তা সিরাজ করলেন বটে ব্যবস্থা! আফটার অল বাবা বলে কথা‚ তারও তো দায়িত্ব বলে কিছু একটা আছে‚ নাকি? একটা ঘোড়ার পিঠে সদ্যোজাত বাচ্চাটাকে বেঁধে ঘোড়ার গায়ে তীর মেরে দিলেন! উদ্দেশ্য এই যে‚ আল্লাহর নামে ঘোড়া ছুটুক‚ যে আটকাতে পারবে ট্রফি আইমিন ছেলে তার। আর যদি কেউ না আটকায়‚ যদি ভালো খারাপ কিছু হয়ে যায় তাহলে তো আল্লাহ মেহেরবান! অযাচিত সমস্যা থেকে চমতকার চিরমুক্তি।
.
তো তীর খেয়ে ঘোড়া ছুটলো‚ আর নিজের ছেলের এই হাল দেখে মাধবী জুড়ে দিলো চিল চিৎকার! এতক্ষণ ধরে অপদার্থ মোহনলাল সিরাজের পাশেই বসে ছিলো‚ প্রতিদিন প্রতিকাজে যেমন থাকে আরকি! নিজের বোনের পার্সোনাল কথাবার্তার মধ্যে কান দেওয়ার মতো কোয়ালিফায়েড ছোটোলোক তো সে একেবারেই না‚ তাই সে চুপচাপ ছিলো!
কিন্তু বাচ্চাটাকে ঐভাবে মরার জন্যে ছুটে দেখে‚ আর বোনের কান্না শুনে হঠাৎ আমাদের ভদ্রলোকের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া মনুষ্যত্ব ফিরে আসে‚ আর ছুটে গিয়ে ঘোড়া থামিয়ে ভাগ্নেকে ঊদ্ধার করে আনে। তারপর একহাতে বোন‚ অন্যহাতে ভাগ্নে আর মাথায় পোটলাপুটলি নিয়ে‚ " বুনরে‚ এই বাংলায় আমাগো কাশ্মীরিগো কদর নাই! ধুর্বাল থাকুম না এহানে" বলে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে হাঁটা লাগালো!
.
এদিকে আলীবর্দীর কানে ঠিক খবর চলে গেছে। সিরাজের মাত্রাতিরিক্ত উৎপাতে বিরক্ত হয়ে তার প্রিয়বন্ধু মোহনলাল মুর্শিদাবাদ ছাড়ার তাল করেছে। আলীবর্দী বুদ্ধিমান লোক‚ মোহনলাল চলে গেলে অপদার্থ সিরাজের কি গতি হবে তা সে ভালোমতোই জানে। মাতৃহারা বাছুরও হয়তো দিন কোনোভাবে বেঁচে থাকতে পারে‚ তবে মোহনহারা সিরাজ নয়। অগত্যা‚ শাহী দূত পাঠিয়ে মোহনলালকে ফেরত আনা হলো রাজধানীতে‚ আর বহু বাবাবাছা করে‚ বহু পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে তার অভিমান শান্ত করা হলো! যে 'আহা দোষ তো আমার নাতিটারই!ওটা একটা বলদ পোলা ! তোমার মতো ওর ঘটে তো পাকা বুদ্ধি আসে নাই এহনো‚ কি করতে গিয়া কি কইর্যা ফ্যালসে! বাদ্দাও দিনি ! আমি সিরাজের সাথে মাধবীর শাদী দিমু। তুমি শান্ত হও ! "
.
মোহনলাল দেখলো এতো মন্দ মজা না। এতদিন ছিলো নবাবের নাতির মোসাহেব !এখন হতে চলেছে নবাবের খাস আত্মীয়!ভবিষ্যৎ নবাবের বড় কুটুম! নারীর মন আর পুরুষের ভাগ্যের গতিপথ সত্যিই বলা খুব মুশকিল! শোনা মাত্রই মোহনলাল তখন এক পায়ে খাড়া!
.
তারপরে আর কি? সেদিনই কাজী ডেকে সিরাজের সাথে মাধবীর বিয়ে দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হলো ! শুভ কাজে অযথা বিলম্ব করা কেন আর? কিন্তু এর ভেতরেও থেকে গেলো একটা মাইনর প্রবলেম! মাধবী যে হিন্দু। কাফের মেয়ের সাথে কি নবাবের নাতির বিয়ে হওয়া উচিৎ! চারিদিকে যে সিরাজ বিরোধী আবহাওয়া‚ একটা ইসলাম বিরোধী কাজ করে আমির ওমরাহ দের ক্ষেপিয়ে দেওয়া কি উচিৎ হবে ? ভবিষ্যতে যদি এই ইস্যুতে সিরাজের বিরোধীরা ঘোট পাকায় ইসলাম বিপন্ন বলে? তাহলে? আবার এই বিয়ে না দিলেও যে সমূহ বিপদ! নাদান সিরাজকে বন্ধুহীন ভাবে রেখে মরে যেতে তিনি একদমই রাজি নন। টেনশনে টেনশনে আলীবর্দীর নাওয়া খাওয়া হারাম হলো।
এদিকে টেনশন মোহনলালেরও কিছুমাত্র কম না‚ বরং আরও বেশি! এই বুঝি নবাবের শালা হওয়ার সুযোগটা হাত থেকে ফসকে বেরিয়ে যায়। তীরে এসে তরী ডোবে বুঝি। কি যে অসুবিধা একটা হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করতে কে জানে ? মনে মনে এই সাম্প্রদায়িক মনোভাবের উপরে ভয়ানক খাপ্পা হয়ে ওঠে মোহনলাল!
.
এমন "এগোয় নাকো পিঁছোয় নাকো " ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতিতে মুশকিল আসান হয়ে এগিয়ে আসলো আলীবর্দীর খাস ইমাম। তিনি দুহাত তুলে অভয় দিলেন‚ হুজুর! আপনি একদম চিন্তা করবেন না‚ কাফের রমণীকে বিয়ে করার বহু বহু ইতিহাস আমাদের ইসলামে আছে। আমাদের ইসলাম মহান ধর্ম‚ শুধুমাত্র কাফের বলে কোনো মেয়েকে দূরে ফেলে রাখার বিধান শরিয়তে নেই। শুধু মাধবীকে বিয়ের আগে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে এইটুকুই যা! "
.
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আলীবর্দী! হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মোহনলাল। সাজিয়ে গুজিয়ে মাধবীকে আনা হলো বিয়ের সভায়‚ ইসলাম গ্রহণ করিয়ে তার নতুন নাম হলো আলিয়া। হিন্দুয়ানী নাম যে ইসলাম নেওয়ার পর অচল! এদিকে হেরেম খানা থেকে সিরাজকেও তুলে আনা হলো বিয়ের আসরে! মিয়াঁ বিবি উভয়ের মুখ থেকে কবুল শুনে কাজী তাদের শাদী দিলেন! ব্যাস হয়ে গেলো বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রথম শাদী।
সিরাজ অবশ্য তারপর আরও খান কয়েক বিয়ে করেছিল ‚ তবে সেগুলো কখনোই প্রথম বিয়ের মতো এত ইন্টারেস্টিং ছিলোনা।!
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................