শিয়া মুসলমানদের সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। যা জানি তার সবটাই সুন্নি মুসলমানদের বিদ্বেষ জনিত। এবং বলতে দ্বিধা নেই শিয়াদের সম্পর্কে আমার নিজের ধারণাও সুন্নী প্রচারণা থেকেই প্রাপ্ত ছিলো যা কিছুটা বিভ্রান্তিকর। শিয়াদের সম্পর্কে আমি সম্প্রতি কিছুটা পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছি। তাতে আমার নিজের যেটা মনে হয়েছে শিয়া সুন্নীর জন্ম রাজনৈতিক কারণে হলেও (ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব) ইসলামের বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে গেছে সেটি এই দুই দলের দলিল দস্তাবেজ ঘাটলেই পরিস্কার হয়ে যায়। শুরুতে বলে রাখা ভালো, শিয়া মুসলমানের ইসলাম কেমন সেটি ইরানের মুল্লা খুমেনির ইসলামী প্রজাতন্ত্র থেকেই বুঝতে পারেন। যেমন শিয়াদের অন্যতম বিশ্বাস হচ্ছে তারা মাহদির নেতৃত্বে ইহুদীদের বন্দি করে জেরুজালেম দখল করে নিবে। এটি সুন্নীদের মতই হুবহু সহিংস রাজনৈতিক লক্ষ্য। বলতে গেল শিয়া সুন্নীর ইসলামের সঙ্গে তফাত কিছুই নেই। যা আছে সেগুলি কি সেটাই সামান্য তুলে ধরি।
শিয়াদের সহি হাদিসের নাম উসুলুল কাফী সেখানে বলা হয়েছে নবী মুহাম্মদের কাছে জিব্রাইল ২৩ বছর ধরে যে কুরআন নিয়ে এসেছে তাতে আয়াতের সংখ্যা ১৭০০০। কিন্তু সুন্নীদের যে কুরআন আমরা দেখি তাতে আয়াতের সংখ্যা মাত্র ৬২৩৬টি! শিয়া হাদিস থেকে:
আর কুলাইনী বর্ণনা করেন: “আবূ আবদিল্লাহ(আ) {জাফর সাদিক} থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নিশ্চয় জিবরাঈল আ. যে কুরআন মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নিকট নিয়ে এসেছে, তাতে আয়াত সংখ্যা সতের হাজার।” [উসুলুল কাফী (أصول الكافي), (ভারতীয় সংস্করণ পৃ. ৬৭১)।
শিয়াদের কুরআনে সুরা মায়দায় যে বাক্যটি আছে সেটি সুন্নীদের নেই। “আলী ঈমানদারদের প্রভূ” বাক্যটি সুন্নী কুরআন থেকে মুছে ফেলার অভিযোগ করে হয়। সুরা মায়দার ৬৭ নম্বর আয়াতটি এরকম-
হে রাসূল, তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, (আলী ঈমানদারদের প্রভু) তা পৌঁছে দাও আর যদি তুমি না কর তবে তুমি তাঁর রিসালাত পৌঁছালে না। আর আল্লাহ তোমাকে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।
(ইবনে কাথিরের তাফসির সুরা মায়দা, জালাল আল দিন, দুরর আল মানসুর, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২৯৮)
শিয়াদের তরফ থেকে দাবী করা হয় ব্রাকেটের কথাটি সুন্নী কুরআনে নেই কারণ আলী যে নবীর উত্তরাধিকার সেটি চক্রান্ত করে মুছে ফেলা হয়েছে। শিয়াদের দাবী কুরআনের আরেকটি আয়াতে নবী ও আলীকে দুই নূর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সেটিও মুছে ফেলা হয়েছে। নিচের আয়াতটি দেখুন-
হে ঈমানদারগণ! তোমরা দুই নুরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, যা আমরা নাযিল করেছি; তারা তোমাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে এবং মহান দিবসের শাস্তির ভয় প্রদর্শন করবে; উভয় নুর পরস্পর পরস্পরের অংশ; আর আমি শ্রবণকারী, জ্ঞানী। (ফসলুল খিতাব (فصل الخطاب), (ইরানি সংস্করণ) পৃ. ১৮০)
শিয়াদের নামাজের সঙ্গে সুন্নীদের মিল নেই। শিয়াদের আসর ও এশার নামাজ নেই। তারা তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। তাদের কলিমা সুন্নীদের থেকে ভিন্ন। নবীর নামের সঙ্গে যুক্ত করে তারা পড়ে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহম্মাদুর রাসুলুল্লাহ আলী ওয়ালী উল্লাহ”। তাদের আজানে নবী মুহাম্মদের সঙ্গে হযরত আলীর নামও বলা হয় এভাবে- “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” এর পরে “আশহাদু আন্না আলিউন ওয়ালী উল্লাহ” । শিয়ারা তারাবী নামাজ পড়ে না।... এরকম অনেক তফাত আছে। এরা একে অপরকে কাফির বলে থাকে। এরাই আবার দুনিয়ার সবাইকে ইসলামের ছায়াতলে এসে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত হতে বলে। অথচ উভয়েই ইসলামের ছায়াতলে থেকে একে অপরকে জাহান্নামী বলছে! মনে করুন একজন হিন্দু শিয়া মতে মুসলমান হলো- সুন্নীর কাছে সেটি কেমন লাগবে? বলবে ‘ভ্রান্ত আকিদা গ্রহণ করেছে’! সু্ন্নী মতে ইসলাম গ্রহণ করলে শিয়ারা বলবে ‘বিকৃত ইসলামের খপ্পরে পড়েছে’! অথচ এরাই কত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের বিশ্বাসকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির একমাত্র পথ বলে মনে করছে!
এই যে ধর্ম নিয়ে ভিন্নতা, এর কারণ কি? মনে রাখতে হবে নবীর মৃত্যুর দেড়শো বছর পর ‘মাহযাব’ অর্থ্যাত রীতি নীতি গড়ে উঠে। ইসলামে প্রধানত চারটি মাযহাব স্বীকৃত। চারটির মধ্যে নামাজ রোজা ওজুসহ নানা রকম ভিন্নতা বিদ্যমান। প্রশ্ন হচ্ছে একই নবীর পিছনে নামাজ করা আমল করা সাহাবীদের নানা গ্রুপের মধ্যে এত তফাত গড়ে উঠল কিভাবে? এর উত্তর হচ্ছে নবীর মৃত্যুর আড়াই শো বছর পর ইমাম বুখারী সুন্নী হাদিস সংগ্রহ করে এবং সেই হাদিসকে ভিত্তি করে ইসলাম ধর্মকে একটি রূপরেখা নিয়ে যাওয়া হয়। একইভাবে শিয়ারাও নিজস্ব একটা মাহযাব ও হাদিসকে কেন্দ্র করে তাদের ইসলাম গড়ে তোলে। খিলাফত জিহাদ গণিমত এইসব লক্ষ ঠিক করে নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়।
সুন্নীরা শিয়াদের ভ্রান্ত আকিদার কাফের বললেও খোদ সুন্নী দলিলগুলি যা দাবী করছে সেটি আমি বললে বলবেন আমি ধর্ম নিয়ে উশকানি দিচ্ছি! কিন্তু এগুলো ইমাম বুখারী সাহেবের সংগ্রহ করা সব দলিল! জেনাকারী বুড়ো বুড়িকে পাথর মেরে হত্যার আয়াত গায়েব হওয়ার দাবী করেছিলেন খোদ হযরত ওমর (সহীস বুখারী, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ২০৮-২১১, সহীহ মুসলিম, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৮৭, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১১৬, মুসনাদে আহমাদ, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২৩, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৩২, ১৮৩, আবু দাউদ, হুদুদ ২৩, তিরমিযি হুদুদ ৭, ইবনে মাজা হুদুদ ৯, মোআত্তা হুদুদ ১০)।
হযরত ওমর কুরআনে ১০ লক্ষ ২৭ হাজার অক্ষর ছিলো দাবী করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানের প্রচলিত কুরআনে ৩ লক্ষ ২৩ হাজার ৬৭১টি পাওয়া যায়! (আল ইতকান, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১৯৮)
খোদ হজরত ওমরের সন্তান আব্দুল্লাহ দাবী করেছিলেন, কোরআনের অনেক আয়াত পরে কোরআনের লিপিবদ্ধ হয়নি(আল ইতকান, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৭৩)
হযরত আয়েশার কাছে যে কুরআন ছিলো তাতে এমন কিছু লেখা ছিলো যা এখনকার কুরআনে নেই!
یا ایها الذین آمنوا صلو علیه و سلموا تسلیما و علی الذین یصلون الصفوف الأولی
যতদিন হজরত উসমান উক্ত লিখাটিকে পরিবর্তন করেননি।(আল ইতকান, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ৭৩)
২০২১ সালে ভারতের শিয়া সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড কুরআন থেকে ২৬টি আয়াত সরিয়ে ফেলতে সুপ্রমকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। বোর্ডের চেয়ারম্যান ওয়াসিম রিজভী আদালতে বলেছিলেন, “নিজেদের ক্ষমতা বাড়াতে কুরআনে এই ২৬টি আয়াত ঢুকিয়েছেন ইসলামের তিন খলিফা- হজরত আবু বকর (রা.), হজরত উমর (রা.) ও হজরত উসমান (রা.)। আর এসব আয়াত সহিংসতা এবং মানুষজনকে জিহাদের ব্যাপারে উস্কানি দেয়”।
রিজভী সাহেব শিয়া হিসেবে এই দাবী সুন্নী কুরআন সম্পর্কে করলেও শিয়াদের বিশ্বাস একদম শুরুতেই বলেছি তারাও ইমাম মাহদি সম্পর্কে কি বিশ্বাস করে এবং ইহুদী বিদ্বেষ কতখানি। ইরানীদের মুল্লা খুমেনি ইরানকে একটি মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র বানিয়ে রেখেছে সেটা শিয়াদের কুরআন হাদিস মাহযাব দিয়েই। কাজেই রসুনের কোয়া অনেকগুলি হলেও তাদের সকলের গোঁড়া একটিই!
-সুষুপ্ত পাঠক
#সুষুপ্তপাঠক
26 July 2022
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................