কেন বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের এমন বেহায়া সমর্থক হয়?
ঋত্বিক ঘটকের মত বরেণ্য চিত্র পরিচালক কোলকাতার রাস্তায় বাক্স হাতে বাংলাদেশের মানুষের বাঁচার জন্য চাঁদা তুলেছিলেন। কোলকাতার ট্রামে বাসে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের চড়তে কোন পয়সা লাগত না। ভাঁড়ের চা ফ্রি খাওয়াতো যদি শুনত ভদ্রলোক বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। দেবদুলাল আকাশবাণীতে আবেগ ঢেলে বাংলাদেশের পক্ষে সাহস সঞ্চারী যে শব্দতরঙ্গ বইয়ে দিতেন সেগুলো ছিলো স্পষ্ট বাংলা ও বাঙালীর প্রতি টান থেকে। আর যাদের সরাসরি দেশ ছিলো পূর্ববঙ্গ-- তারা নিজের দেশের টানেই দুই কোটি শরণার্থীর জন্য রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে সাহায্যের পয়সা তুলতেন।
অথচ মাত্র ২৪ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে কোলকাতার এইসব মানুষজন চরম আক্রান্ত, নিগৃহীত অপমানিত ও রক্তাক্ত হয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গের মুসলমান তখন মুসলিম লীগ করে। পূর্ববঙ্গ মুসলমানদের দেশ পাকিস্তান হবে। এখান থেকে হিন্দুরা চলে যাবে। কি আস্ফালন…। ভিটেবাড়ি ফেলে চোখের জলে যারা একদিন দেশ ত্যাগ করেছিলেন তারা কেন সেইসব বেইমানদের জন্য ১৯৭১ সালে এমন আবেগ ঢেলে দিয়েছিলো?
আজকে ভারত পাকিস্তান চলমান যুদ্ধাবস্থায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পাকিস্তানের প্রতি পক্ষাবলম্বন কে বুঝতে হলে আপনাকে কিছু সত্যকে গ্রহণ করতে হবে।
ঋত্বিক ঘটক যখন তার ফেলে আসা জন্মভূমির জন্য কোলকাতার প্রচন্ড রৌদ্রে ঘেমেনেয়ে গলায় ব্যানার হাতে বাক্স নিয়ে পথে পথে পয়সা তুলছেন, তখন এই কোলকাতারই কোন এক অডিটরিয়ামের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী তথা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পরিচিত মুখ এমআর আখতার মুকুল সরাসরি কোলকাতাবাসীকে শোনাচ্ছেন, আপনারা যারা মনে করছেন বাংলাদেশে স্বাধীন হলে যারা ৪৭, ৫০, ৫৮, ৬৪, ৬৫ সালে সীমানা অতিক্রম করেছেন তারা আপনাদের এককালের জন্মভূমিতে ফিরতে পারবেন- এমন অলীক স্বপ্ন দেখলে শুধু মানসিক যন্ত্রণাই বৃদ্ধি পাবে। (আমি বিজয় দেখেছি, এমআর আখতার মুকুল, পৃষ্ঠা-৫৪)। বইয়ের ৫০ থেকে ৫৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত এমআর আখতার মুকুলের এমন বহু বক্তব্য চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ। আশ্রিত হয়ে অন্যের দয়ায় অন্যের পয়সায় যাদের জীবন চলছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে কিনা তার যেখানে কোন নিশ্চয়তা নেই-- সেই অবস্থায় দ্বিজাতি তত্ত্বর জন্য হিন্দুদের উপর দোষচাপানো, নিজেদের ‘বাঙালী মুসলমান’ হিসেবে আলাদা স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা হিসেবে বুকের ছাতি ফোলানো থেকে পরিস্কার হয় কি তীব্র ভারত বিদ্বেষ নিয়েই এরা সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। এই যদি হয় মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ও মুজিবনগরের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের একজন বেতনভুক কর্মচারীর ভারত প্রসঙ্গে অবস্থান, তাহলে যারা ইসলামী মানসিকতার, তাদের কী অবস্থা বুঝতে হবে।
হুমায়ূন আজাদ একবার প্রশ্ন করেছিলেন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে কি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথাটা ভেবেছিলেন? আজাদের মনে এই প্রশ্ন আসাটা খুব স্বাভাবিক। ইতিহাসে এমন কোন নজির পাওয়া যায় না যেখান থেকে মনে হতে পারে বাঙালী মুসলমান পাকিস্তান থেকে পৃথক হতে চেয়েছিল। এম আর আখতার মুকুল কোলকাতায় দাঁড়িয়ে সেদিন বলেছিলো আমরা করাচি লাহোর গিয়ে তাদের চাকচিক্য দেখে নিজেদের বঞ্চিত ভেবেছিলাম তাই এই যুদ্ধটা আমাদের কাছে ন্যায্য বা অবধারিত মনে হয়। কিন্তু এখানে আসার পর (কোলকাতায়) আপনাদের মধ্যবিত্ত জীবন দেখে মনে হচ্ছে পাকিস্তানে আমরা খারাপ ছিলাম না…(আমি বিজয় দেখেছি, এমআর আখতার মুকুল, পৃষ্ঠা-৫৩)
এমআর আখতার মুকুলরা ছিলেন ১৯৪৭ সালের মুসলমানদের নিজস্ব দেশ ‘পাকিস্তান’ নিয়ে গর্বে বুক ৫৬ ইঞ্চি হওয়া প্রজন্ম। এদের একাংশ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং একাংশ হয়েছিলেন বিপক্ষে। কিন্তু দুটো দলই ভারত-হিন্দু বিষয়ে একই নৌকার যাত্রী। উভয়েই দ্বিজাতি তত্ত্বকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানান অছিলায় জায়েজ করেন। ভারতের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকে এদের সকলেই ৭২ সালে মুখ মুছে ফেলে দিয়েছিলেন। যে পাকিস্তান কয়েক লক্ষ বাংলাদেশী নারীদের রেপ করে গেলো সেটা কেন বাংলাদেশের মুসলমানরা মনে রাখেনি? এর কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যেসব নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন তাদের ৯০ ভাগই ছিলো হিন্দু নারী। এর বাইরে আওয়ামী লীগ করেছে এমন বাড়ির নারীদের প্রতি রাজাকার আল বদর ও পাকিস্তানী সৈন্যদের ক্ষোভ ছিলো। কারণ তাদের মতে আওয়ামী লীগ মুনাফেক। এরা হিন্দুদের সঙ্গে নিয়ে মুসলমান মিল্লাতে ভাঙ্গন ধরাতে ষড়যন্ত্র করছে। যেকারণে শরণার্থীদের তালিকায় দেখা যায় ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি শরণার্থীর মধ্যে হিন্দু শরণার্থীর সংখ্যা ছিলো ৬৯ লাখ ৭১ হাজার এবং মুসলিমসহ অন্যান্য শরণার্থীর সংখ্যা ছিলো ৬ লাখ মাত্র (সূত্র: প্রথম আলো, একাত্তরের শরণার্থী, আশফাক হোসেন, ০৭-১২-২০১০ তারিখে প্রকাশিত)।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো আসলে হিন্দুদের জন্য হলোকাস্ট। এ কারণেই মুসলমানরা মুক্তিযুদ্ধকে মনে রাখেনি। এই কারণেই লাখ লাখ নারীকে যারা রেপ করেছে সেই পাকিস্তানীদের সমর্থন জানাতে, কাশ্মীর নিয়ে সেই পাকিস্তানের পক্ষ নিতে বাংলাদেশের মুসলমানদের বাধে না। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন তাদের ৯০ ভাগই ছিলো হিন্দু নারী। এবং হিন্দু তথা বিধর্মী নারীকে ধর্ষণ করাটা ইসলামে পুণ্যের কাজ।
সুতরাং এখন যা দেখছেন তা খুবই স্বাভাবিক। মানতে না পারলে আপনি সত্যকেই স্বীকার করতে পারছেন না…।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................