সর্বধর্ম সমন্বয়

কৃষ্ণনগরে একটি গির্জা আছে- ইতালীয় স্থাপত্য রীতিতে তৈরি। ক্যাথলিক পাদ্রীদের আনা ইতালিয়ান কিছু ভাস্কর্য সেখানে রয়েছে। মাস দু'য়েক আগে, ঘটনাচক্রে সেই গির্জাটির সামনে তিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। লোক চলাচল দেখছিলাম। যেহেতু পূর্বপুরুষদের আদি বাসস্থান এই অঞ্চলে, তাই আবেগ থাকাটাই স্বাভাবিক। অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিলাম, লোকজন আসতে-যেতে গির্জাটিকে প্রণাম করছে। শাঁখা-সিঁদুর পরা একজন নারী, রাস্তা পার হতে হতে - ছেলের হাত ছেড়ে গির্জাটিকে প্রণাম করে, অস্ফুট স্বরে কিছু প্রার্থনা করছে। ভদ্রমহিলা কাছাকাছি আসতেই তাকে বললাম, "তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?"

"বলো দাদা।"

 "তুমি তো নিশ্চয়ই সনাতন ধর্মালম্বী।"

"হ্যাঁ।"

"তুমি এখানে প্রণাম করলে কেন?"

"এ-কী বলচ দাদা, ঠাকুর যে!"

"মোটেও তোমার ঠাকুর নয়, খ্রি*স্টানদের গির্জা!"

"ওই তো হলো আর কি। সব ধর্মই এক।"

 "সব ধর্মই এক, এটা তুমি কিভাবে জানলে?"

"কেন স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন।"



আশা করি বুঝতে পেরেছেন, স্বামী বিবেকানন্দ কেন যীশুর পূজার প্রচলন করেছিলেন; এছাড়াও তাদের প্রতিষ্ঠানে, আরেকটি ধর্মের স্পর্শকাতর ব্যক্তির পূজা করা হয়। স্বামী বিবেকানন্দের পরে 'সর্বধর্ম সমন্বয়' প্রচার করেছিলেন অনুকূলচন্দ্র ঠাকুর। তারপরে 'সর্বধর্ম সমন্বয়' প্রচারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন প্রভুপাদ অভয়চরণ দে।

আমি ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন ধরনের বই পড়তাম। একথা অনেকেই জানতো। খ্রি*স্ট ধর্ম, ইস*লাম ধর্ম ও কমিউনিজম প্রচারকরা, তাদের বই-পুস্তক আমার কাছে সরবরাহ করেছিল। আমি তাদের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। তবে খ্রি*স্টান ও মুস*লমানরা ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করতে পেরেছে এবং অনেকগুলো রাষ্ট্র স্থাপন করেছে - এজন্য তাদের প্রশংসা করি।

আমার কয়েকজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন সহপাঠী ছিল। তারা আমাকে বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে, বার্মার ভাষা শিখিয়েছে। বার্মিজ ভাষাও ভারতীয় এবং পল্লবীয় লিপি। এখন অবশ্য সব ভুলে গেছি। বৌদ্ধ ধর্মালম্বী বাঙালি বড়ুয়াদের সংস্পর্শে আসার পর, বৌদ্ধ দর্শনের বই চেয়েছিলাম। তারা দেয়নি, কিনে পড়েছি। অনেক কথাই ভালো, তবে নারী-বি*দ্বেষ ভালো লাগেনি।

ছোটবেলা সাংঘাতিক ধার্মিক ছিলাম। যখন দেখেছি, মন্দিরগুলো কতিপয় ধা*ন্দাবাজ লোকের পয়সা কামানোর জায়গা, ধর্মের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। বর্ণবাদ, অস্পৃ*শ্যতা, নারী-বি*দ্বেষ, বিষয় বৈরাগ্য, নিরামিষ ভজন, গো*মূত্র পান, গুরু ব্যবসা ইত্যাদির ঘোরতর বিরোধিতা করি ― এজন্য তথাকথিত হি*ন্দুত্ববাদী ও সমাজপতিরা আমাকে দু'চোখে দেখতে পারেনা।

হি*ন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ব্রিটিশরা ভারত রাষ্ট্রটি বানিয়ে দিয়ে গেছে। ভারতের লোকাল ট্রেনে উঠলে ভারত রাষ্ট্রটিকে চেনা যায়। খুবই অল্প জায়গা। তার মধ্যে সামান্য কয়েকজন লোক আরামে বসে আছে; দুই সিটের মাঝখানে কিছু লোক কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যে দাঁড়িয়ে আছে; আর যাতায়াতের পথে পোকা-মাকড়ের মতো লোকজন কিলবিল করছে। জনসংখ্যা অনুপাতে ভারত রাষ্ট্রটির ভূখণ্ড খুবই কম, খনিজ সম্পদ আরও কম, তার মধ্যে ভয়ানক আর্থিক বৈষম্য।

পৃথিবীতে খ্রি*স্টান রাষ্ট্রগুলো আয়তনে যেমন বিরাট, তেমনি সমৃদ্ধশালী। ভারতের পাঁচ গুণ বড় রাশিয়া। আমেরিকা ও কানাডা আয়তনে ভারতের তিনগুণ করে বড়। ব্রাজিল ও অস্ট্রেলিয়া ভারতের আড়াই গুণ করে বড়। এই রাষ্ট্রগুলোতে কয়েকটা ভারতের সমান উর্বর ভূমি পড়ে আছে, চাষবাস করার লোক নেই। এই দেশগুলোর মাটির নিচে অঢেল সম্পদ। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং বিশ্ব রাজনীতির লাগাম খ্রি*স্টান রাষ্ট্রগুলোর হাতে।

খ্রি*স্টানরা কেন বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে? কারণ খ্রি*স্টানরা দুস্থ-দরিদ্র মানুষদের সাহায্য দেয়, আশ্রয়হীন মানুষদের আশ্রয় দেয়। রাষ্ট্রহীন মানুষদের খ্রি*স্টান রাষ্ট্রগুলো নাগরিকত্ব দেয়। আর হি*ন্দুরা কী করে, শুনবেন! বছর তিনেক আগে, বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ হওয়া একটি হি*ন্দু পরিবার ভারতে গিয়েছিল। ভারত সরকার তাদের গ্রেফতার করে, জেলখানায় আটকে রাখে। আমি কয়েকজন হি*ন্দুত্ববাদীকে বলেছিলাম, "এদের জেলখানা থেকে বের করার ব্যবস্থা করুন।"

একজন বলেছে, "ভারত কোন ধর্মশালা নয়। যে আসবে তাকেই আশ্রয় দেওয়া যাবে না।"

আরেকজন বলেছে, "এরা তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেবে, এদের পা*ছায় লাথি মেরে বের করে দেওয়া উচিত।"

বাংলাদেশের একটা এনজিও উচ্চ মহলে যোগাযোগ করে, সেই হি*ন্দু পরিবারটিকে জেল থেকে ছাড়িয়ে- বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। কোনও একটি হি*ন্দু সংগঠন, এই ছিন্নমূল অসহায় হি*ন্দু পরিবারটির পাশে দাঁড়ায়নি। শেষ পর্যন্ত একটা ইস*লামী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ছিন্নমূল হি*ন্দু পরিবারটির কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এবং তারা স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে ইস*লাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।

হি*ন্দুর সংখ্যা এমনি এমনি কমেনি। আর খ্রি*স্টান ও মুস*লমানদের সংখ্যা এমনি এমনি বাড়েনি।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted