প্যান ইসলামিজম কি?

লিখেছেন : সুষুপ্ত পাঠক Susupto Pathok

প্যান ইসলামিজম কি?

মুসলমান আর ইসলাম এক কথা নয়। মুসলমান ইসলাম নাও মানতে পারে। আবার মুসলমানে মুসলমানে ইসলামে বিস্তর ফারাক। কেউ চরমোনাই কেউ আটরশি। কেউ সুফি কেউ আইএস। কেউ মওদুদী কেউ ভাসানী…। মনে করুন বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মুসলমানই নাস্তিক, তবু তারা ওআইসি, ডি-৮ ইত্যাদি মুসলিম পরিচয়ের বিশ্ব রাজনীতিতে যোগ দিতেও পারে। মিশরের বামপন্থি বুদ্ধিজীবী মুহাম্মদ ইমারা মনে করেন ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ আসলে ‘গণরাষ্ট্র’। তিনি মিশরের ব্রাদারহুডসহ ইসলামপন্থিদের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত। এমনকি মিশর, মরক্কোর মত দেশের ইসলামপন্থিরা ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা মনে করেন পশ্চিমা আর্শিবাদপুষ্ট রাজতন্ত্র কিংবা একনায়কতন্ত্রকে প্রতিরোধ করতে গণতন্ত্রকে মেনে নেয়া যেতে পারে। কিছু কিছু ইসলামিক বুদ্ধিজীবী, নেতা নারীদের নেতৃত্বকে সামনে আনার মত দিয়েছে। এটা কার্যত কুরআনের পরিপন্থি কাজ কিন্তু আধুনিক যুগের ইসলামী কৌশল হিসেবে ধরা হয়। আর এত সব যে ইসলামী দর্শনের সাহায্যে গ্রহণ করা হয় তার নাম ‘প্যান ইসলামিজম’।

#সাইয়েদ জামালউদ্দিন আফগানিকে ধরা হয় এই দর্শনের নব জাগরণের রূপকার। তিনি পশ্চিমা সামাজ্যবাদী শক্তির উত্থানকে ঠেকাতে ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদের’ ভিত্তিতে সারা বিশ্বে এক জাতি এক দেশ- এই লক্ষ্যে মুসলমানদের জাগাতে কাজ করেন। তিনি ইসলামের শরীয়া আইন, কুরআন-হাদিসের শাসনের চাইতে মুসলমানদের একটি জাতি হিসেবে ঐক্য গড়াতে জোর দিয়েছেন। হাত কাটা- পা কাটার আইন পাশের চাইতে মুসলমানরা নিজেরা রাষ্ট্র গঠন করে পৃথিবীতে পরাশক্তিতে আবির্ভূত হবে সেটাই তার চাওয়া ছিলো। জামালউদ্দিন আফগানি কিন্তু প্যান ইসলামিজমের রূপকার নন। এটা তাই উনিশ শতকের কোন নতুন ইসলামী চেতনা নয়। এটি ১৪০০ বছর আগের নবী মুহাম্মদের থিউরী ছিলো। মুহাম্মদ ও খোলাফায়ে রাশেদিনের সময় থেকে মনে করা হতো মুসলমান এবং অমুসলমান এই দুইভাবে পৃথিবী বিভক্ত। মুসলমানরা এই পৃথিবীকে মুসলমানদের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাকীদের নতমস্তকে তাদের অধিনস্ত করে রাখবে। পশ্চিমা সামাজ্যবাদের পূর্বে সারা পৃথিবীতে খোলাফায়ে রাশেদিনই ছিলো সামাজ্যবাদ শক্তি। এটা অবশ্য বামপন্থিরা স্বীকার করতে চায় না। তাদের কাছে পশ্চিমা সামাজ্যবাদের আগে পৃথিবীতে সুখ আর শান্তি ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্বই ছিলো না!

#তরুস্কের থ্রিপিস ক্লিন সেভড এরদোগান আর আইএসের মুজাহিদদের মধ্যে কাজের ধরণের তফাত থাকলেও লক্ষ্যে তারা সহযাত্রী। ঢাকার কবি-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের ইসলামী রাষ্ট্র, শরীয়া শাসন, আইএস খাওয়ানো কঠিন কিন্তু প্যান ইসলামিজমের বাটি চুক চুক করে সবটুকু শুষে নিবে। বহু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ইসলামপন্থিদের সঙ্গে আদর্শিকভাবে মারমুখো, তারা ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তাদেরকে একমাত্র প্যান ইসলামিজম দিয়েই কাছে টানা গেছে। মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের এরদোগানকেই ধরা হয় আধুনিককালের জামালউদ্দিন আফগানি। আফগানির থিউরী অনুযায়েই তিনি ৮টি মুসলিম দেশকে নিয়ে যথা-  তুরস্ক, মিশর, ইরান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া এবং বাংলাদেশ নিয়ে ডি-৮ গঠন করেছে। ভবিষ্যতে তাদের লক্ষ্য একই ইসলামী মুদ্রা প্রচলণ, প্রতিরক্ষা এবং মুসলিম বিশ্বে একক পরাষ্ট্রনীতি অবলম্বণ করা। দেখুন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ বাংলাদেশের কিন্তু এই প্যান ইসলামিজমে যেতে কোন অস্বস্তি লাগেনি! আপনি প্যান ইসলামিজমের ছায়ায় বসে সুন্দর সেক্যুলারিজমের গান গাইতে পারবেন। জিন্না সাহেব গেয়েছিলেন। তিনি ভন্ড ছিলেন না। আদতেই প্যান ইসলামিজমের ভিত্তিতে পাকিস্তান চাইলেও চেয়েছিলেন পাকিস্তান সেক্যুলার হোক। সেখানে হিন্দুরাও সমান অধিকার পাক। প্যান ইসলামিজমের কম-বেশি প্রভাব বঙ্গবন্ধুর মধ্যেও ছিলো। তার অন্ধভক্তরা সেটা নাও মানতে পারে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠে বাংলা ভাগ করে পাকিস্তান করেও তিনি চেয়েছে বাংলার হিন্দু মুসলমান বাঙালী অবাঙালী সবাই সমান মর্যাদা নিয়ে বাস করুক। প্যান ইসলামিজমের বিপদটা তারা বুঝতে পারেনি। এটি মুহাম্মদ এবং খোলাফায়ে রাশেদিন যুগের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক একটা জাতীয়তাবাদ যা হিটলারের ন্যাৎসিবাদের চেয়ে হিংস্র ছিলো। জামালউদ্দিন আফগানী উনিশ শতকে এটিকে সে যুগের আদলে কিছুটা পরিবর্তন করে ভারতসহ সামাজ্যবাদী শাসনে থাকা মুসলমানদের ঐক্য করতে নতুনভাবে তুলে ধরেন। কিন্তু এর ভিতরের বিষাক্ত সাপটিকে দেখতে পেয়েছিলেন আলীগড় মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ। আফগানির প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে, ভারতীয় মুসলমান কিছুতেই তুরস্কের খেলাফতের সঙ্গে যুক্ত নয়। ভারতীয় মুসলমান নির্দিষ্ট করেই ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। মুসলিম জাতি বলতে কোন কিছুকে আহমদ স্বীকার করেননি। তিনি জানতেন এর বিপদটি কোথায়। ভারতীয় মুসলমানদের তিনি সতর্ক করেছিলেন। দুঃখজনক হচ্ছে আলেম ওলামারাই মুসলমানদের প্রভাবিত করতে পেরেছিলো এবং সারা ভারতে খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়েছিলো। আর এই প্যান ইসলামিজমকে সমর্থন দিয়ে মহাত্মা গান্ধি ভবিষ্যতের ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের ললাট লিখন এক প্রকার আদায় করে নিয়েছিলেন। আজকেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে যেভাবে দেশের কথিত প্রগতিশীল, সুশীল, ভদ্রজনরা প্যান ইসলামিজমকে বাড়তে দিচ্ছেন হয়ত আমাদের ভবিষ্যত লিখিত হয়ে যাচ্ছে সময়ের কালিতে…। প্যান ইসলামিজমের আধুনিক অবতার এরদোগানরাই কিন্তু আইএসের পৃষ্ঠপোষক। প্যান ইসলামিজমের বিপদ তাই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠের ব্যবধানে…।

Copyright © 2022 Susupto Pathok aka সুষুপ্ত পাঠক all rights reserved.

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted