কলিতে যবন দুষ্ট হৈন্দবী করিল নষ্ট
বাংলায় 'হিন্দুত্ববাদ' শব্দটি শুনেলেই অনেকের চোখ বড় হয়ে যায়, কান খাড়া হয়ে যায়। কেউ এ শব্দটি উচ্চারণ করলে তাকেও মৌলবাদী ট্যাগ দেয়ার জন্যে তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবী গোছের মানুষ উঠেপড়ে লেগে যায়। কিন্তু তারা অনেকেই বিষয়টিকে গভীর থেকে ভেবে দেখেন না বা অনেকে ভেবে দেখলেও সাময়িক স্বার্থে মুখবন্ধ করে সুবিধাবাদী একপাক্ষিক কথা বলে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেয়া সংজ্ঞা অনুসারে হিন্দু পরিচয়টি শুধু একটি ধর্মকে বোঝায় না। এ পরিচয়টি সপ্তসিন্ধু অববাহিকায় অবস্থিত সকল অধিবাসীদের বোঝায়।
কেউ ধর্মে বিশ্বাস না করেও, এ ভূখণ্ডের শাশ্বত সংস্কৃতির ধারক বাহক এবং প্রচারক হতে পারে। হিন্দুত্ববাদ এবং ধর্মীয় মৌলবাদ এক নয়। হিন্দুত্ববাদ হল, ভারতবর্ষের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক চেতনার এক ঐক্যবদ্ধ বহিঃপ্রকাশ। আজ হয়ত বিষয়টি রাজনীতির অংশ। হিন্দুত্ববাদের নামে পক্ষে বিপক্ষে রাজনীতি হচ্ছে, দ্বন্দ্ব সংঘাত হচ্ছে। আজ যে রূপ পরিগ্রহ করে বিষয়টি সকলের সামনে এসেছে, আদতে বিষয়টি ঠিক তেমন নয়। হিন্দুত্ববাদ বিষয়টি হল এ ভূখণ্ডের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক পরিচয়ের একটি পরিশীলিত ঘনিভূত রূপ।
হিন্দুত্ব শব্দটি বঙ্গে কোন নতুন শব্দ নয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অনেকের মুখেই শোনা যায়, হিন্দুত্ব শব্দটি উত্তর ভারত থেকে সদ্য রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্যে আমদানি করা হয়েছে। এ তথটি কিছুটা সত্য হলেও, সম্পূর্ণ সত্য নয়। এ 'হিন্দুত্ব' শব্দ বা এর কাছাকাছি শব্দ বহু পূর্বেই বাংলার কবিরা তাদের সাহিত্যে ব্যবহার করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মঙ্গলকাব্য ধারার খ্যাতিমান কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যের রচনাতেও হিন্দুত্ব শব্দের কাছাকাছি 'হৈন্দবী' শব্দটি পাওয়া যায়। হিন্দু শব্দটি হল একটি ভৌগোলিক জাতিগত পরিচয়। শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, বিতস্তা, সিন্ধু ও সরস্বতী এই সাতটি নদীর অববাহিকা অঞ্চলকে এককথায় সপ্তসিন্ধুবিধৌত অঞ্চল বলে। এ পবিত্র সপ্তসিন্ধু অববাহিকায় যারা বসবাস করে তারাই হিন্দু। সেই হিন্দু শব্দটিই বাংলায় অপভ্রংশ হয়ে 'হৈন্দবী' শব্দে রূপান্তরিত হয়ে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই বলা চলে হিন্দুত্ব শব্দটি বাংলায় কোন নবাগত শব্দ নয়। এর রাজনৈতিক রূপটি হয়ত নবাগত।
কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যের বাড়ি ছিলো পশ্চিমবাংলার মেদেনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার বরদাবাটীর যদুপুর নামক এক পল্লীগ্রামে। তিনি ছিলেন তার নিজ গ্রাম থেকে বিতাড়িত এক ভাগ্যবিড়ম্বিত কবি।তিনি অনেক কাব্য লিখেছেন। তার মধ্যে শিব-সঙ্কীর্ত্তন বা শিবায়ন ও সত্যনারায়ণের পাঁচালী অন্যতম। সেই সত্যনারায়ণের পাঁচালী গ্রন্থটিতে রয়েছে, 'হৈন্দবী' শব্দটি। তবে এ কথা অবিসংবাদিত সত্য যে, বৈদেশিক তুর্কি-পাঠান শাসনের কারণে মধ্যযুগীয় কবিরা স্বাভাবিকভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারেননি। এর সবথেকে দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যকেই গ্রহণ করতে পারি। কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য একাধারে তাঁর সত্যনারায়ণের পাঁচালীতে বলেছেন- ষড়দর্শনসহ সকল শাস্ত্রই বলে ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি আরও বলেন, অবতাররূপে ভিন্ন ভিন্ন রূপে জগতে আবির্ভূত হওয়ায় তিনি ভিন্ন ভিন্ন নামে ঈশ্বর অভিহিত হন। এরপরেই তিনি তাঁর তৎকালীন বাস্তবতা সম্পর্কে বলেন, কলিকালে দুষ্ট যবন হিন্দুর হিন্দুত্ব বা ধর্ম ও সংস্কৃতি বিনষ্ট করছে।
"ছয় দরশন কয় এক ব্ৰহ্ম দুই নয়
জন্ম জন্য ভিন্ন ভিন্ন নাম ৷৷
কলিতে যবন দুষ্ট হৈন্দবী করিল নষ্ট"
কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য হাহাকার করে বলেছেন, দুষ্ট বিধর্মী যবন কলিযুগের আগমনে এই ভূখণ্ডের অধিবাসী হিন্দু সম্প্রদায়ের 'হৈন্দবী' বা হিন্দুত্ব নষ্ট করেছে।শাস্ত্রমতে কলিযুগের বয়স চারলক্ষ বত্রিশ হাজার বছর। এর মধ্যে বর্তমানে কলিযুগের মাত্র ৫২০০ বছর অতিক্রম হয়েছে। কলিকালের সমাপ্তি হতে আরও দীর্ঘ সময় বা চার লক্ষের অধিক সময় বাকি আছে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেই দুষ্ট স্বভাবের যবনেরা অধর্মের বিস্তার করে হৈন্দবী বা হিন্দুত্বের অকারণে হানি ঘটাচ্ছে।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................