কেন মরিস বুকাইলিরা মুসলিম হন না?
নিয়মিতই ওয়াজে শুনি এবং অসচেতন বন্ধুরা বলেন, 'পৃথিবীর বহু বিখ্যাত ব্যক্তি মুসলিম হয়েছেন এবং লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ মুসলমান হয়ে যাচ্ছেন। যেমন ড. মরিস বুকাইলি।' অনেকে দাবি করেন প্রতিদিন ৭৫০০ জন মুসলিম হন৷ কিন্তু এসব ওয়াজের কথা৷ নির্ভরযোগ্য নয়৷ বাস্তবিক এখন খুব কম মানুষই ধর্ম বদলায়— মানুষ এখন ধর্ম ত্যাগই করে৷ সালমান রুশদী থেকে আসিফ মহিউদ্দিন, মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ পর্যন্ত বহু জনকেই পাবেন৷
সাম্প্রতিক কালে যত লোক অন্য ধর্ম থেকে মুসলিম হয়েছেন কাছাকাছি সংখ্যক লোক আবার ইসলাম ছেড়েও গিয়েছেন। আর মরিস বুকাইলিতো সৌদি রাজ পরিবারের ডাক্তার ছিলেন৷ ওনি রাজ পরিবারের অনুরোধে 'বাইবেল কোরআন বিজ্ঞান' বইটি লিখেন৷ ওনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি যে বই লিখেছেন তাতে মনে হওয়ার কথা যে তিনি মুসলিম হয়েছেন, কিন্তু বাস্তবে হননি। তাঁর কন্যাও নিশ্চিত করেছেন তিনি ধর্ম বদল করেননি৷ খৃষ্টান রীতিতেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে৷
এক ভ্রমণে আমার এক স্নেহভাজন বন্ধু আমার এমন কথা শুনে খুব ক্ষেপে গেলেন। সে নিশ্চিত! যদি মরিস মুসলিম না হন তবে জিভ দিয়ে আমার জুতো পরিষ্কার করে দিবেন!
শুনে খুবই কষ্ট পেলাম, এমন বাজে ধরনের এক বাজি/চ্যালেঞ্জে! আমি প্রস্তাব দিলাম হেরে গেলে এক কাপ চাই যথেষ্ট। মোবাইলে সার্চ দিয়ে উইকিপিডিয়াতে সবাই দেখলাম, তিনি মুসলমান হননি। সে মানবে না। তার কাছে বই রয়েছে। কদিন পরে ফোনে জানালেন, তারই ভুল! মরিস মুসলিম হননি!
মরিস মুসলিম হননি- বিষয়টি আমার কাছেও বিস্ময়কর। তিনি তার গ্রন্থ ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ এ প্রমাণ করতে চাইলেন বাইবেল ভুল, বিজ্ঞানেও ভুল হচ্ছে শুধুই কোরআন বিজ্ঞানভিত্তিক, অলৌকিক, সত্য ও মহাবিস্ময়কর এবং এটিই একমাত্র স্রস্টা প্রদত্ত গ্রন্থ।
বইটি লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। এই বই তাঁকে রাজপরিবারেরর কাছে আরো গ্রহণযোগ্য করেছে এবং তাঁর অর্থ উপার্জন বহুগুণে বেড়েছে এই বই থেকে এবং চিকিৎসা থেকে। এই বই একজন মূর্খ সৌদী রাজপুত্রের কাছে যেমন মহামূল্যবান, তেমনটি একজন বিজ্ঞানমনষ্ক যুক্তিবাদি মানুষের কাছে নয়। মরিসের বই হাস্যকর যুক্তিনির্ভর এবং তিনি গবেষণা ছাড়াই গল্পের মতো লিখেছেন। এবং আরো বই লিখেছেন ইসলাম নিয়ে। শুধুই অর্থ উপার্জনের জন্য তিনি এই বই লিখলেন? অথচ নিজের ইসলাম গ্রহণ করলেন না!!
এমনটি খাটে আমাদের বাঙালি ভাই গিরিশচন্দ্র সেন এর বেলাতেও। এই ব্রাহ্ম পণ্ডিতই প্রথম কোরআন বাংলায় অনুবাদ করেন এবং শীর্ষস্থানীয় ইসলামি চিন্তবিদদের অনুমোদন নিয়ে প্রকাশ করেন। শুধু কোরআন নয় তিনি বহু হাদিসগ্রন্থও অনুবাদ করেন এবং ইসলাম নিয়ে অনেক লেখালেখি করেন। কিন্তু তিনিও মুসলিম হননি। শুধুই পেশা এবং ব্রাহ্ম ধর্মের নেতাদের নির্দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ইতিহাসের অংশ হয়েছেন।
গ্যারি মিলার কানাডার খ্যাতিমান সাংবাদিক। তাঁর বই ‘আল কুরআনঃ এক মহাবিস্ময়’। তিনি বিভিন্ন দিক আলোচনা করে বলেছেন, 'কোরআন বিস্ময়কর ও অলৌকিক'। তিনি কোরআনকে আসমানি বাণী বলেই দাবী করেছেন যা পৃথিবীতে একমাত্র গ্রন্থ। তার বইটিও পড়ে মনে হয়েছে তিনি সৌদী রাজপরিবারের অনুরোধেই বইটি লিখেছেন এবং তিনিও বিজ্ঞানভিত্তিক কোন যুক্তি দেননি অবশ্য দাবী করেছেন। তিনি সাংবাদিক হলেও আধুনিক বিজ্ঞান বিশেষ করে চিকিৎসা বিজ্ঞান, বিবর্তনবাদ, পদার্থবিদ্যা, নভোবিজ্ঞান সম্পর্কে তার ধারণার বিস্তর অভাব রয়েছে। তিনি দাবী করেছেন, তিনি বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে কোরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণ করেছেন। তিনিও মুসলমান হননি অথচ কেন এমন একটি বই লিখলেন তা ভেবে ভাই না। শুধুই কি বাণিজ্য আর সৌদি রাজপরিবারের অনুরোধ রক্ষার জন্য?
ড. কীথ এল মুর লিখেছেন ‘আল কুরআনে ভ্রূণতত্ত্ব’ নামের একটি বড় নিবন্ধ। এটিও সৌদি রাজপরিবারের অনুরোধে। কোরআণে ভ্রূণ সম্পর্কিত আয়াতগুলোকে তিনি মিলিয়েছেন, আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে। তিনি লিখেছেন, অনেকগুলো আয়াতই এতোকাল স্পষ্ট বুঝা যায়নি। সাম্প্রতিক ভ্রূণ নিয়ে উচ্চতর গবেষণা আয়াতগুলোকে স্পষ্ট করেছে। ড. কীথ কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগে ছিলেন। এটা একটি নিবন্ধ, যাতে তুলনা করেছেন কোরআনে কিভাবে মানুষের জন্মরহস্য লেখা হয়েছে এবং বর্তমানে বিজ্ঞানের গবেষণায় তার প্রমাণ মিলছে। তিনি দাবী করেছেন, কোরআনে আছে— ‘আমি তোমাদের তৈরি করেছি মাতৃগর্ভে কয়েক ধাপে, অন্ধকার তিনটি পর্দার আড়ালে। তারপর তাকে বিন্দুরূপে এক সুরক্ষিত স্থানে স্থাপন করি। তারপর আমি সেই বিন্দুকে পরিণত করি জোঁকের মত আঁকড়ে থাকা কাঠামোয়। তারপর সেই চর্বিত গোস্ত থেকে তৈরি করি অস্থি, পরে অস্থিকে ঢেকে দিই গোস্ত দিয়ে। তারপর তাকে গড়ে তুলি এক নতুন সৃষ্টিরূপে।'
এগুলো কয়েকটি সুরা থেকে তিনি একত্রিত করেছেন এবং আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে মিলিয়েছেন। ড. কীথ সৌদী এক রাজপুত্রের পাঠানো ভ্রণসম্পর্কিত আয়াতগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে নিবন্ধটি লিখেছেন এবং কোরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণ করেছেন। বিস্ময়কর যে ড. কীথ সৌদি রাজপরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখলেও নিজে মুসলমান হননি। কেন হননি? তার লেখা কি শুধুই সৌদী রাজপরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য এবং লেখাটি মুসলিম বিশ্বে আলোচিত হবে সে জন্য?
আমি অনেক ভেবেছি আলোচিত চারজনকে নিয়ে। তারা কেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন না? শুধুইকি বাণিজ্য, প্রচার ইত্যাদির কারণেই তারা কথিত গবেষণা করেছেন এবং লিখেছেন? নাকি সত্যি অনুধাবন করেই লিখেছেন? সত্যি অনুধাবন করলে কেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন না?
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................