বাঙালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র্যতা আনতে মোশাররফ পরবর্তী অন্যান্য লেখকরা আমদানী করেছিলেন আরবী ফার্সি শব্দ

১৯৩৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে দাস প্রথা পুরোপুরি চালু ছিলো যা ‘Law commission on slavery in India’ গঠন করে নিষিদ্ধ করা হয়। মীর মোশাররফ হোসেনের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় তখনকার অবস্থা সম্পন্ন মুসলমান ও হিন্দুদের বাড়িতে এই ক্রীতদাসরা থাকত। মোশাররফদের বাড়িতেই তিরিশ-বত্রিশ জনের মত ‘দাসীবাঁদি’ ছিলো। এই দাসরা কেউ স্বাধীন ছিলো না। এরা এই বাড়িতে কাজ করতে করতে জীবন পাড় করে দিতো। অন্যত্র কোথাও যেতে পারবে না। এদের সঙ্গে মালিকের বৈধভাবে যৌন সম্পর্ক খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। মোশাররফে আত্মজীবনী ‘আমার জীবনী’-তে মোশররফ হোসেন এরকমই এক দাসীর সঙ্গে পদস্খলের কথা স্বীকার করেছেন।

মীর মোশাররফ হোসেন ছিলেন জমিদার বাড়ির সন্তান। তার পিতা মীর মোজাম্মেল হোসেন ছিলেন জমিদার ও ইংরেজ ভক্ত। মীর মোশাররফ হোসেন তাই ছিলেন ধনী মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি। সেকালে পরিস্কারভাবে মুসলমান সমাজে উঁচু নিচু দুটি শ্রেণী বিভাগ ছিলো। মীর মোশাররফ হোসেনদের মত যারা তাদেরকে বলা হতো ‘আশরাফ মুসলমান’। গরীর সাধারণ গ্রামীণ সমাজে বসবাসকারী কৃষক মুসলমানকে ‘আতরাফ’ বা ছোটজাতের মুসলমান বলা হতো। ইংরেজ আমলে মুসলমানদের শিক্ষার ভাষা হিসেবে কোন ভাষা উপযুক্ত এরকম এক কমিশনের সামনে মুসলিম নেতারা বলেছিলেন, অবশ্যই মুসলমানদের জন্য উর্দু ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ বাঞ্ছনীয়, তবে আতরাফ মুসলমানদের বাংলায় শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মীর মোশাররফ হোসনের জন্মের আগেই মুসলমানদের ‘ওহাবী’ ও ‘ফারায়েজী’ নামের দুটি রাজনৈতিক ইসলাম ও মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঢেউ বয়ে গেছে। কিন্তু সেই আন্দোলন যে সাধারণ জনমানসে কোন প্রভাব রাখেনি (অন্তত তাত্ক্ষনিকভাবে রাখেনি) সেটি জানতে ও বুঝতে মীর মোশাররফ হোসেন সাহিত্য এবং তিনি নিজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাজি শরীয়তুল্লাহ ও তীতুমীরের ওহাবিজম অবশ্যই সাধারণ মুসলমানদের কট্টর ওহাবি করেছিলো তবে সেটি সময় নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো। বাঙালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য পরিচয়ের বা জাতিচেতনা যে এই ‘আশরাফ মুসলমানদের’ একটি সামন্তবাদী সমাজের জাগরণ সেটি আজ পর্যন্ত কেউ স্বীকারই করেননি। মীর মোশরারফ হোসেন বলছেন তিনি বঙ্গদেশে সাধারণ মুসলমানদের সবাইকে ‘হিন্দু নামে’ দেখেছেন। মীর যাদের কথা বলেছেন তারা গরীব সাধারণ মুসলমান। তার স্ত্রী কুলসুম সেরকম গরীব ঘরের মেয়ে ছিলেন। স্ত্রীর মায়ের নাম ছিলো ‘লালন’ যিনি বাড়ি বাড়ি ধান বেনে জীবিকা নির্বহ করত। কুলসুমকে তিনি একটি অগ্নি দুর্ঘটনা থেকে উদ্ধার করে পরবর্তীকালে বিয়ে করেন। স্ত্রী কুলসুমের ডাক নাম ছিলো হিন্দু দেবী কালীর নামানুসারে কালী। কুলসুম জীবনেও গরুর মাংস খাননি এবং বাড়িতে এই বস্তু তিনি কোনদিন ঢোকাতে দেননি। তার পোশাক পরিচ্ছিদ আচার আচরণ সবটাই ছিলো সাধারণ গৃহস্থ হিন্দু নারীদের অনুরূপ। এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো বলে মনে হয় না। মীর বলেছেন তিনি গ্রাম গঞ্জে সেসব মুসলমানদের দেখেছেন তাদের সকলের একটি ভালো নামের সঙ্গে সঙ্গে ডাক নাম আছে রাম শ্যাম কৃষ্ণ... এরকম। কুষ্টিয়া, কৃষ্ণনগর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গায় সাধারণ মুসলমানদের নাম হিসেবে মীর দেখেছেন নন্দ, গৌর, কালাচাঁদ, লক্ষণ...।

১৯৪৭ সালের আগে ঈদ উত্সবই খুব সাদামাটা চেহারার ছিলো। আশ্চর্য যে মাত্র দেড়শো বছর আগে গ্রাম-বাংলায় ঈদ নামাজ পড়তে পারে এমন মুসলমান পাওয়া যেতো না। মুঘল আমলে ঈদ ছিলো বিদেশী এইসব মুসলমানদের উত্সব। সাধারণ দেশীয় কৃষক মুসলমানদের জীবনে ঈদ পার্বনের কোন প্রভাব ছিলো না। তাই বলা যেতে পারে আজকের কুরবানীতে যে গরুর জবাই দেয়ার সমারোহ তার পুরোটাই রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় সৃষ্টি। গরু কোরবানী মীরের সময়ে উচ্চ সমাজের ধর্মীয় উত্সব ছিলো। এই ঈদকে ‘বকরির ঈদ’ বলা হতো কারণ এই সময়ে মুসলমানরা বকরি কুরবানী দিতো তাদের ঈশ্বরকে খুশি করতে। মীরের প্রথম জীবনের একটি বইয়ের নাম ‘গোজীবন’ যেটি লিখে তিনি মামলা মোক্কাদমে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আশরাফ মুসলমান নেতাদের ফতোয়া ছিলো মীরের বউ তালাক হয়ে গেছে ও তিনি নিজে অমুসলমান হয়ে গেছেন। মীর তার বইতে লিখেছেন গরু খেতেই হবে না খেলে দোযগে যেতে হবে এরকম কোন কথা তো ইসলামে নেই। তাহলে মুসলমানরা গরু খাওয়া বর্জন করতে পারে। এতে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন মনোমালিন্য সৃষ্টির কোন সুযোগ থাকে না। ‘গো-জীবন’ মীরের জীবনে অভিশাপ হয়ে আসে। তিনি সমাজ চ্যুত হোন। আদালতে যেত হয় তাকে। মুসলমান ধর্মগুরু ও সম্ভ্রান্ত সমাজ তাকে কাফের হিসেবে একঘরে করে রাখে। এর পরবর্তীকালেই মীর আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকেন। যে ফতোয়াবাজরা তাকে কাফের আখ্যা দিয়েছিলো তিনি নিজে সেই ফতোয়াবাজদের একজন হয়ে উঠেন।

খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে মীর মোশাররফ হোসেন যে কাজগুলি করছেন তার সবটাই মুসলমান উচ্চ শ্রেণীদের হাতে বাধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে অথচ নিন্মশ্রেণীর মুসলমান সমাজ সংস্কৃতি তখন ছিলো হিন্দুদের অনুরূপ। যেমন মোশাররফ নিজের সন্তানদের নাম রাখতে গিয়ে প্রচন্ড বাঁধার সম্মুখিন হয়েছেন। সন্তানের নাম ‘শরত’ রাখায় তার সমাজ সেটাকে ‘হিন্দুদের মত নাম’ বলছে কিন্তু মোশাররফ নিজেই জানিয়েছেন সাধারণ মুসলমানদের নাম তখন হিন্দুদের মতই রাখতে দেখেছেন তিনি। মোশাররফ হোসেন সেকালে নিজের সন্তানদের নাম রেখেছিলেন তার সমাজের একদম বিপরীত। একটি ভালো নামের সঙ্গে একটি ডাক নাম যে নামটি একদমই বাংলা যেটাকে ‘হিন্দুয়ানী’ বলা হতো। যেমন তার ছেলের নাম রেখেছিলেন মীর এব্রাহীম হোসেন ওরফে ‘সত্যবান’। আরেক ছেলের নাম আসরাফ হোসেন ওরফে ‘রণজিত’। ওমরদারাজ ওরফে ‘সধুম্ব’। মহবুব হোসেন ওরফে ‘ধর্মরাজ’। মেয়েদের নাম রেখেছিলেন এভাবে: রওসান আরা ওরফে ‘সতী’। আমিনা খাতুন ওরফে ‘কুকি’। ছালেহা ওরফে ‘সুনীতি। সালেমা ওরফে ‘সুমতী’।

অথচ দেখা যাচ্ছে মীরের স্ত্রীর কুলসুমের নাম ছিলো ‘কালী’ তা নিয়ে তো সেই গ্রামীণ সমাজে কোন সমালোচনা হয়নি। অর্থ্যাত আমরা এটা বলতে পারি মুসলমান স্বাতন্ত্র্যতার চেতনা মূলত কথিত আশরাফ শ্রেণীর সামন্ত প্রভূদের। আমরা জানি যে মুসলিম লীগের জন্মই হয়েছিলো ইংরেজদের কাছ থেকে দেনদরবার করে মুসলমানদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেয়ার জন্য। এই মুসলিম লীগ গঠন করে ‘আশরাফ মুসলমানরা’। তারাই উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের জন্য উর্দু আর বাংলা ভাষাকে হেয় করে নিন্মশ্রেণীর জন্য বাংলা ভাষায় শিক্ষার সুপারিশ করেছিলো।

মোশাররফ যে যুগের মানুষ সেকালে লেখাপড়া উচ্চশ্রেণীর মুসলমান ছাড়া কল্পনাও করা যেতো না। সেই উচ্চশ্রেণীর মুসলমান মূলত শিক্ষা লাভ করত আরবী ফার্সি শিখে। বাংলা কোন বিবেচনাতেই ছিলো না। যে কারণে মীর মোশাররফ হোসেনের আগে বাংলায় বলার মত কোন লেখক ছিলেন না। মীরের সমাজে ইংরেজি না শেখার কারণে ইংরেজ আমলে পিছিয়ে পড়েছিলো তার জন্য যে সেকালের মুসলমান সমাজই দায়ী তার প্রমাণ মীর তার ‘আমার জীবনী’ বইতে বলছেন, তাদের সমাজে (উচ্চ মুসলমান সমাজ) ইংরেজি পড়লে মুসলমানদের যে পাপ হবে শুধু এটাই বিশ্বাস করত তাই নয়, আরো মনে করা হতো, ইংরেজি পড়লে খ্রিস্টান হয়ে যাবে, দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করবে, মরণ কালে আল্লার নাম মুখে আসবে না ইংরেজি কথা বলে মরবে...। এ থেকেই বুঝা যায় মুসলমান চাকরি বাকরিতে পিছিয়ে পড়ার জন্য হিন্দুরা দায়ী এটি একটি ঐতিহাসিক একটি মিথ। আরবী ফার্সি ভাষায় শিক্ষিত মুসলমান তখন আশরাফ ধনী মুসলমানদের ঘরে ঘরে ভর্তি। মীর নিজে ফার্সি বই থেকে কাবালার কাহিনী বাংলায় ‘বিষাদ সিন্ধু’ লিখেছিলেন।

মুসলমানদের ভাষা কেমন হবে সেটিও এই উচ্চ শ্রেণী মুসলমানদের জাতীয়তাবাদ ছিলো। বিষাদ সিন্ধু যে ভাষায় লেখা হয়েছিলো তা ছিলো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন যে কোন বাংলা ভাষীর ভাষা। মোশাররফ হোসেন পারস্যদের মতই নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। পারস্যরা ইসলাম গ্রহণ করলেও আরবী ‘সালাত’ গ্রহণ করেনি। তারা এটাকে বলেছে ‘নামাজ’ যা তারা সূর্য পূজারী থাকার সময়ও প্রার্থনাকে বলত। তারা আরবী ‘সওম’-কে গ্রহণ করেনি তাদের নিজ ভাষায় আগে থেকে প্রচলিত ‘রোজা’ হিসেবে রোজাকে নিয়েছে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের ভাষা হিসেবে পারস্য থেকে ইসলাম প্রচার করতে আসা ধর্মগুরুদের ভাষাকেই তাদের নিজস্বতা হিসেবে আজো বিশ্বাস করে। অথচ মীর তার বিষাদ সিন্ধুতে আল্লাকে ‘ঈশ্বর’ ‘জগেদীশ্বর’ লিখছেন। বিষাদ সিন্ধুর ভাষাশৈলি এভাবেই ফুটিয়ে তুলেছিলেন মোশাররফ-

“স্বয়ং ঈশ্বর তুর পব্বতে যাহার কথা কহিয়াছিলেন, মুসা সেই সচ্চিদানন্দের তেজোময় কান্তি দেখিবার জন্য নিতান্ত উৎসুক হইলে কিঞ্চিৎ আভামাত্র যাহা মুসার নয়নগােচর হইয়াছিল, তাহাতেই মুসা স্বীয় শিষ্যসহ সে তেজ ধারণে অক্ষম হইয়া তখনই অজ্ঞান অবস্থায় ধরাশায়ী হইয়াছিলেন, শিষ্যগণ পঞ্চত্ব পাইয়াছিলেন, আবার করুণাময় জগদীধর, মুসার প্রার্থনায় শিষ্যগণকে পুনরুজ্জীবিত করিয়া মুসার অন্তরে অটল ভক্তির নবভাব আবির্ভাব করিয়াছিলেনÍসে মহামতি সত্য-তার্কিক মুসাও আজি হাসেন শোকে কাতর, কারবালায় সমাসীন।” 

বাঙালি মুসলমানের স্বাতন্ত্র্যতা আনতে মোশাররফ পরবর্তী অন্যান্য লেখকরা আমদানী করেছিলেন আরবী ফার্সি শব্দ মুসলিম পরিচয়ের ছাপ রাখতে। মোশারফের ভাষাকে কায়কোবাদ কলঙ্ক বলেছেন। কায়কোবাদদের ভাষা হিন্দুর ভাষা হতে আলাদা সেটি মানা যেতো যদি সত্যিই সেরকম কিছু থাকত। নিজের বলে পরের জিনিস আমদানী করাটা হীনমন্যতা। ছফা-রাজ্জাক ও তাদের শিষ্যরা নিশ্চিত করেই বিষাদ সিন্ধুর ভাষাতে রীতিমত বিছুটি লাগার মত চুলকানি অনুভব করে। মীর মোশাররফ হোসেন সম্ভবত বিষাদ সিন্ধু লিখে যদি আর না লিখতেন তাহলে সম্ভবত বাঙালি মুসলমানরা তার নামটিও নিতো না। কিন্তু মোশাররফের জীবন দ্বৈত সত্ত্বায় সাজানো। মোশাররফ তার নিজের বিরোধীতা নিজেই করেছিলেন শেষ ধাপে। তিনি হিন্দুয়ানীর চরম বিরোধীতা করেছিলেন এভাবে-

“আমি সেই সময়ের কথা বলিতেছি। পঠন পরিচ্ছেদ হিন্দুয়ানী, চালচলন হিন্দুয়ানী, রাগ ক্রোধ হিন্দুয়ানী, কান্নাকাটি হিন্দুয়ানী, মুসলমানদের নামও হিন্দুয়ানী। যথা- সামসুদ্দিন – সতীশ, নাজমুল হক-নাজু, বোরহান-বীরু, লতিফ-লতু, মশাররফ-মশা, দায়েম-ডাশ, মেহেদি-মাছি, ফজলুল করিম-ফড়িং এই প্রকার নামে ডাকা হয়”।

এই মোশাররফই যিনি নিজের সন্তানদের নাম দেশীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী রেখেছিলেন? তিনিই তো বিষাদ সিন্ধুর কথিত হিন্দুয়ানী ভাষায় নবীর নাতির জন্য কোন্দন করেছিলেন? ...হায়, ব্রুটাস তুমিও!

রেফারেন্স ফাইল: https://pathoksusupto.blogspot.com/2023/02/blog-post_10.html 

লিখেছেন: Susupto Pathok

#বিষাদসিন্ধু #মীরমোশাররফহোনে #সুষুপ্তপাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted