'মুক্তচিন্তা' মানেই কি নাস্তিকতা?

আমার এক বন্ধু জানতে চেয়েছেন 'মুক্তচিন্তা' মানেই কি নাস্তিকতা?  "মুক্ত চিন্তার" বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যাই বা কী?

মুক্তমনা' অর্থ বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে. জ্ঞান কী? জ্ঞানের স্বরূপই বা কী?  

প্রাচীন উত্তর হলো ‘যথার্থ জ্ঞানের’ অনুসান করা। ’যথার্থ জ্ঞান’ হচ্ছে ‘বিশুদ্ধ জ্ঞান’। আর ‘বিশুদ্ধ জ্ঞান’ হলো- পরমসত্তা সম্পর্কিত জ্ঞান।

এই ভূমিতে'বিশুদ্ধ জ্ঞানের’ দার্শনিক চর্চা শুরু হয় ঋগ্বেদ রচনার মধ্যে দিয়ে।

এর বাইরে প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থের মুক্তচিন্তার বিশদ ধারনা দিয়েছেন। সমগ্র গ্রন্থে চেতনাকে ধরা হয়েছে বস্তু থেকে স্বতন্ত্র হিসাবে। আর স্বতন্ত্র মন দাবি করে বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে কিছুএকটা রয়েছে।

‘বাস্তব জগৎ’ এবং ‘ভাবজগৎ’ এই পর্যায়ে দার্শনিকদের মূল জিজ্ঞাসা শুরু হয় : জ্ঞান কী বিষয়ীগত না বিষয়গত?

এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে দর্শনে ভাববাদ বনাম বস্তবাদ বিতর্ক শুরু হয়। উল্লিখিত বিতর্কের কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসা হলো : জগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কী মন বা চেতনার ওপর নির্ভরশীল, নাকি বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল?

ভাববাদ দাবি করে আমাদের জ্ঞান চেতনার ওপর নির্ভরশীল, চেতনার বাইরে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। বার্কলের দর্শনে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন রয়েছে। আবার ডেভিড হিউম মনে করেন প্রত্যক্ষণের বাইরে বস্তর কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। জ্ঞানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা বা ইন্দ্রিয় জ্ঞানই মুখ্য। 

কান্ট দেখালেন এককভাবে  প্রত্যক্ষণনির্ভরতা পরিপূর্ণ জ্ঞানের উপাদান নয়। বস্তুত প্রত্যক্ষণশক্তি এবং বোধশক্তি উভয়ের সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে মন প্রকৃত জ্ঞান লাভ করে। তিনি বলেন মানব-প্রজ্ঞায় যা সত্য হিসাবে প্রতীয়মান হয় তা-ই সমাজের কাছে সত্য হিসাবে বিবেচিত হয়।
 
কান্টের জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারা এবং হেগেলের বিষয়গত-ভাববাদে ব্যবহৃত দ্বান্দ্বিকতা উভয়ের তাত্ত্বিক প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় মার্কসীয় জ্ঞানতত্ত্বে। জ্ঞানতত্ত্বের এই ধারাটি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নামেই অধিক পরিচিত।

মানুষের ক্রিয়াকলাপ তার উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞানতত্ত্ব বস্তুজগতকে ধরা হয় জ্ঞানের মূল উৎস হিসাবে। এই উৎসই মানুষের মধ্যে তৈরি করে বোধ-বুদ্ধি, ধারণা এবং সংবেদনশীলতা।

প্লেটো থেকে শুরু করে মার্ক্স পর্যন্ত বিশুদ্ধ জ্ঞান সম্পর্কিত যতো দর্শন এসেছে কোনোটার মধ্যেই ভাববাদকে একচেটিয়া ভাবে অবজ্ঞা করা হয় নাই। ভাববাদীরাও আবার একচেটিয়া ভাবে বস্তবাদকে নিরার্থক বলতে পারে নাই। 

কেউ আবার কান্টের মতো দুটোর মধ্যে সমঝোতা  করেছেন। তবে ক্রিটিক অব পিওর রিজনের মতো দার্শনিক গ্রন্থ খুব কমই এসেছে বিচারবাদের ক্ষেত্রে। যত গ্রন্থই পড়া হোক মানুষের চলমান চিন্তনের ধারাকে কোনও ভাবাদর্শ থামিয়ে রাখতে পারে না। তাই দেখা যায় একই আদর্শগত ধারনাতে বিভিন্ন উপধারা ও তা নিয়ে তর্কযুদ্ধ। সুতরাং বলা যায় যে মানবীয় কোনো জ্ঞানই শেষ কথা নয়। কারণ, বিশুদ্ধ জ্ঞানের ধারাটা বুঝে গেলে জ্ঞান চর্চাই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিশুদ্ধ জ্ঞানের কোনো গ্রান্ড ইউনিফাইড মেথডের ধারে কাছেও মানব বুদ্ধি পৌছে নাই। তাই এ বিতর্ক চলবেই।

এখন প্রশ্ন হল, "মুক্ত চিন্তার" বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা কী?

মুক্ত চিন্তা অর্থ উন্মুক্ত চিন্তা, যে চিন্তা কারো দ্বারা প্রভাবিত নয়। মুক্তচিন্তা ছাড়া নতুন কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।

সহজ কথায় যিনি কোনো বিষয়ে কোনো বদ্ধমূল ধারনা পোষণ করেন না তিনিই মুক্তচিন্তক। তিনি আস্তিক হতে পারেন, নাস্তিক হতে পারেন, আবার মিস্টিক রিয়ালিস্টিকও হতে পারেন; যেমন হাফিজ, গালিব, রুমি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

পুরো মানব সমাজ জুড়ে আবহমান কাল ধরে যে অযৌক্তিক ভ্রান্তি, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা চেতনা বহমান তার ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত জীবন দর্শন এবং এই উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশই তো মুক্ত চিন্তা বা মুক্ত মানসিকতা।

চিন্তায় যে পরাধীন, সে সৃষ্টি করতে পারে না, বা বাড়তে পারে না। বটগাছ আর বনসাই এর যে পার্থক্য। মুক্তমনা আর প্রতিক্রিয়াশীলের সে পার্থক্য।

লিও তলস্তয় ব্যাখ্যা দিয়েছেন, নিজ প্রথা, অধিকার অথবা বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক এমন কোনো বিষয়বস্তু উপলব্ধি করতে, যারা স্বেচ্ছায় তাদের ভয় ও সংস্কারের ঊর্ধ্বে তাদের মননকে বিকশিত করতে পারে, তারাই মুক্তচিন্তক। মনের এই অবস্থা কিন্তু সর্বজনীন নয়, যদিও সঠিক চিন্তার জন্য তার প্রয়োজন হয়, যেখানে মুক্তচিন্তা নেই যুক্তি সেখানে অসহায়।

আরও জটিল দার্শনিক পথ আছে বোঝার। আবার সহজভাবেও চিনে নেয়া যায়।

মুক্তমনা বলে কথিত যে কারো লেখায় দ্বিমত পোষণ, বিরুদ্ধমত অথবা ভিন্নমত বা যুক্তিখন্ডন করার পর তার প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যায় সে কতখানি মুক্তমনা।

যদি দেখা যায় কথিত মুক্তমনা সেই ভিন্নমত বা যুক্তিখন্ডনে  তার প্রতিক্রিয়াটি যুক্তির পথ ধরছেনা বা ভিন্নমত তাকে বিচলিত করছে বা যুক্তিতে হেরেও নতুন মতকে স্বাগত জানাতে দ্বিধাগ্রস্থ হচ্ছে, ব্যক্তি আক্রমন হিসেবে নিচ্ছে অর্থাৎ রেগে যাচ্ছে তাহলে বোঝা যাবে মনের সব কটা জানালা খুলে রাখে নি সে। কিছুটা খোলা, কিছুটা ভেজিয়ে রাখা, কিছুটা বন্ধ। সব মত পথের বাতাস সব অলিন্দে ঢোকে না তাদের। তারা তবে মুক্তমনা নন।

প্রকৃত মুক্তমনারা খুন হয়ে যায় যুগে যুগে এটা সত্যি; তবুও তারা সহনশীল রয়ে যায়। তারা লড়াকু। তারা অবিচল। সর্বোচ্চ ঝু্ঁকি নিয়েও অপ্রচলিত মত প্রচারে কুন্ঠিত হয় না তারা। বিরুদ্ধবাদীদের সাথে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে পারে কেবল তারাই।

রাজনৈতিক দর্শনের তথা মুক্তবুদ্ধির বিশিষ্ট প্রবক্তা ভলতেয়ার এর কথা মনে পড়ে -" I DISAPPROVE OF WHAT YOU SAY BUT I WILL DEFEND YOU TO THE DEATH YOUR RIGHT TO SAY IT"

দার্শনিক নিৎসের লেখা বহুল পঠিত এক চিঠি যা তিনি লিখেছিলেন Carl Fuchs কে ২৯ জুলাই ,১৮৮৮ সালে। অপূর্ব সে চিঠি আমাদের বিস্মিত ও মুগ্ধ করে। নিৎসে লিখেছিলেন  –

“একদমই দরকার নাই , এমনকি আমার পক্ষে তুমি কারো সঙ্গে তর্ক কর সেটা আমি চাইও না ; বরং অন্য যে কোন কিছুর তুলনায় আমার প্রতি অনেক বেশি বুদ্ধিমান আচরণ হবে যদি অমীমাংসিত তাচ্ছিল্যের দূরত্ব বজায় রেখে আমার প্রতি কিছু মাত্রার ঔৎসুক্য বহাল রাখো , ঠিক যেন তুমি ভীন জগতের কোন একটি উদ্ভিদ পর্যবেক্ষণ করছ।"

এই ঔদার্য, এই হৃদ্যতা কে পারবে দেখাতে? মুক্তমনারাই পারবে। পেরেছেও।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted