পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম উস্কানিমূলক বই হিসাবে নিষিদ্ধ হয় যে বইটি।

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম উস্কানিমূলক বই হিসাবে নিষিদ্ধ হয় যে বইটি, সেটি ‘পবিত্র বাইবেল’। পাঁচশত বছর আগে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত উইলিয়াম টেইন্ডাল এর ইংরেজিতে অনুদিত বাইবেল। বাইবেল নিষিদ্ধ করেন তৎকালীন রাজা অষ্টম হেনরি। রাজা হেনরির দাবি তার বিবাহ ধর্মসম্মত সঠিক হয় নি, তাই ওই বিয়ের কোন বৈধতা নেই। কিন্তু বাইবেল বলছে অন্য কথা। রাজা হেনরি ক্যাথলিক চার্চ থেকে ইংল্যান্ডের চার্চকে আলাদা করে নিজেকে 'ডিফেন্ডার অব ফেইথ' ঘোষণা করেন। পুড়িয়ে ফেলা হয় অনুদিত বাইবেলের ছ’হাজার কপি। শুধু তাই নয়, প্রাণে বাঁচতে টেইন্ডালকেও করতে হয়েছিলো দেশত্যাগ। বর্তমানে সেই অনুদিত বাইবেলটিই পুরো বিশ্বের খ্রিস্টান ধর্মানুসারি মানুষ অনুসরণ করছে।

চার্চের ধর্মগুরুদের ধারণা ছিল, পৃথিবী স্থির এবং অন্যসব গ্রহনক্ষত্র পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু গ্যালিলিও তাঁর ‘বিশ্ববিধান সম্পর্কে কথোপকথন’ গ্রন্থে বললেন: পৃথিবীসহ অন্যসব গ্রহনক্ষত্র সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। উস্কানিমূলক চরমসত্য কথাটি চার্চের বিরুদ্ধে চলে যায়। পরবর্তীতে ক্ষুব্ধ পোপ অনির্দিষ্টকালের জন্য গ্যালিলিওকে বন্দি করার নির্দেশ দেন। ১৬৪২ সালে বন্দি থাকা অবস্থায় গ্যালিলিওর মৃত্যু হয়। তবে বন্দিদশা থেকে কোনো এক উপায়ে তার লেখা চালান করে ছিলেন স্ট্রসবুর্গে, যা পরে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। গ্যালিলিওর সেই উস্কানিমূলক বিশ্ববিধান জোর্তিবিদ্যার আমূল বদলে দিয়েছে।

“দ্য রামায়ানা অ্যাজ টোল্ড বাই অব্রে মেনেন” নিষিদ্ধ ঘোষিত আরেকটি ধর্মীয়গ্রন্থ। আধুনিক আঙ্গিকে রামায়ণকে ব্যাখ্যা করায় গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করা হয়। দেবদেবীকে মানবরূপে উপস্থাপনের কারণে ভারত সরকার গ্রন্থটি ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই উস্কানিমূলক বই হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

মার্ক টোয়েন রচিত সুখপাঠ্য এই কিশোর উপন্যাসটি উস্কানিমূলক ভাষার অজুহাত দেখিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত এ বইয়ের শ্বেতাঙ্গ হাকলবেরির সাথে কালো জিমের বন্ধুত্বের গল্প বর্ণান্ধতার কারণে মেনে নিতে পারেনি শ্বেতঙ্গ শাসকেরা। বর্তমান বিশ্বে ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’ সবচেয়ে জনপ্রিয় বইগুলোর অন্যতম।

দাসপ্রথার বিরুদ্ধে কঠোর উস্কানিমূলক আঘাত হানে হেরিয়েট বিচার স্টো রচিত ‘‘আঙ্কেল টম’স কেবিন’’ উপন্যাসটি। দাসত্ববিরোধী উপাদান থাকায় কনফেডারেট স্টেটস-এ বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৮৫২ সালে বইটি রাশিয়াতেও নিষিদ্ধ করা হয় এর উস্কানী মূলক ‘সাম্যবাদী’ তত্ত্বের কারণে।

‘ইউলিসিস’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পুড়িয়ে ফেলা হয় উস্কানিমূলক উপন্যাসটির ৪৯৯ কপি। বইটি কেবল উপন্যাস নয়, জীবন্ত ইতিহাসও বটে। বর্তমানে উইলিসিস সেরা উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি।

ডি এইচ লরেন্স এর 'লেডি চ্যাটারিজ লাভার' বইটিতে ঘন ঘন fuck এবং sex শব্দ দুটি ব্যবহৃত হওয়ায় বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। পরে অবশ্য কোর্টে বইটি নির্দোষ প্রমাণিত হয়।

জর্জ অরওয়েলের ‘এনিমেল ফার্ম অ্যা ফেয়রি টেল’ বইটি মূলত সাংকেতিক উস্কানিমূলক উপন্যাস। এ উপন্যাসে রাশিয়ার স্ট্যালিন যুগের ভয়াবহতাকে তুলে ধরা হয়েছিল। উস্কানিমূলক বইটি রাশিয়ায় নিষিদ্ধ হয়। ১৯৯১ সালে কেনিয়ায় নিষিদ্ধ করা হয় ‘এনিমেল ফার্ম’ অবলম্বনে তৈরি নাটক, কারণ এটিতে দুর্নীতিপরায়ণ নেতাদের উস্কানিমূলক ব্যঙ্গ করা হয়। ২০০২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্কুলগুলোতে নিষিদ্ধ হয় এই বই ছবি সম্বলিত  হওয়ায়। বিশেষ করে উস্কানিমূলক শুকরের কথা বলতে পারার বিষয়টির কারণে। বইটি এখনো দক্ষিণ কোরিয়া ও কিউবায় উস্কানিমূলক বই হিসাবে নিষিদ্ধ।

'দ্য স্যাটানিক ভার্সেস' সালমান রুশদির উপন্যাসটি ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই মুসলিম বিশ্বে ঝড় তোলে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে এক বছর পরই বইটি নিষিদ্ধ হয়। স্যাটানিক ভার্সেস লেখার অপরাধে ১৯৮৯ সালে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড জারি করে ফতোয়া দেন। তখন মুসলিমদের বিক্ষোভ ও দাঙ্গার পর ভারতে তার উপন্যাস নিষিদ্ধ করা হয়। এ বইটির জন্য অনেকে হত্যা ও হামলার শিকারও হয়েছেন। হিতোশি ইগারাশি স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসটির জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেন। তাকে ১৯৯১ সালে তাকে ছুরিকাঘাতে মেরে ফেলা হয়। ইতালির অনুবাদক ইতোরে ক্যাপ্রিওলোকেও ছুরিকাঘাত করা হয়, তবে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। নরওয়ের প্রকাশক উইলিয়াম নাইগার্ডকেও আততায়ীরা গুলি ছোঁড়ে, কিন্তু অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। সম্প্রতি বইটির লেখক সালমান রুশদিকে নিউইয়র্কে হামলার শিকার হলে তিনিও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। রুশদির এজেন্টের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘সালমান রুশদির একটি চোখ হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।’

বাংলাভাষায়ও নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা নেহায়েৎ কম নয়। প্রথম নিষিদ্ধ হয় কাজী নজরুল ইসলামের যুগবাণী, বিষের বাঁশি, প্রলয় শিখা ও দুর্দিনের যাত্রী। এছাড়া হুমায়ুন আজাদের নারী বই নিষিদ্ধ হয়। তসলিমা নাসরিনের ৬ টি বই নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ হয় 'বিষফোঁড়া' বইটি। সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ নিষিদ্ধ করে জান্নাতুল নাঈম প্রীতির লেখা "জন্ম ও যোনির ইতিহাস"।  

শুধু মাত্র নিষিদ্ধ করার উপর কোন সত্য কি প্রতিষ্ঠায় বাঁধা হতে পেরেছে? উত্তর হল না। সত্য চিরকাল থাকবে, কোন বাঁধাই সত্য প্রকাশের অন্তরায় হয়ে টেকে না। যে কোন বই নিষিদ্ধ করার আগে কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted