ইসলাম কতটা আত্মঘাতি, তার জ্ঞানী সন্তানদের কী ভাবে হত্যা করেছে, এবং আজও সে ধারা অব্যাহত রেখে আজ দেউলিয়া, তা এই ছোট্ট লেখাটি থেকে বেশ বোঝা যাবে। এটি বাংলাদেশের একজন নিবেদিত জ্ঞান সাধক, সুষুপ্ত পাঠকের লেখা। তিনি মুসলিম পরিবারের জন্মের অভিশাপে ছদ্মনামে লেখালেখি করেন। তিনি আমার প্রিয় একজন আলোর দিশারী।
মুক্তচিন্তক হত্যা
ইসলামী শাসনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ বলে ইসলামকে বা ইসলামী শাসনকে মহান করে তোলার একটা প্রচেষ্টা মডারেট মুসলমান থেকে শুরু করে বামপন্থিদের সব সময় থাকে। তাই ইসলামী শাসনে বিজ্ঞানী দার্শনিকদের কি হাল হয়েছিলো সেই ইতিহাস সবার জানা উচিত। কেমন করে ইসলামী দর্শন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধকদের দমন করেছিলো ইতিহাসের সেরকম কিছু চিত্র দেখুন। “আল্লাহ যা করেন মানুষের ভালর জন্যই করেন বা সবই আল্লার ইচ্ছা” ইসলামের এই মূল সুরকে অস্বীকার করে “স্বাধীন ইচ্ছা মতবাদ” প্রথম শুরু করেন মা’বাদ ইবনে খালিদ আল জুহানি। তারা বলেন ভাল-মন্দ কাজের ভূমিকা স্বয়ং মানুষের, মানুষ স্বাধীন, আল্লার এতে কোন প্রভাব নেই। বলে রাখা ভাল মা’বাদ ইবনে খালিদ আল জুহানিরা নাস্তিক ছিলেন না, ধর্ম পালনকারী মুসলিম ছিলেন। তবু ৬৯৯ সালে খলিফার নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়।
মা’বাদ ইবনে খালিদ আল জুহানিকে হত্যা করে তার মতবাদকে অবশ্য হত্যা করা যায়নি। বরং তার অনুপ্রেরণায় ওয়াসিল বিন আতা ও আমর বিন ওবায়েদ ইতিহাসে বিখ্যাত “মুতাযিলা” মতবাদ নিয়ে হাজির হন। ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিরুৎসাহিত, অনুসন্ধানী মনন বিরোধী অবস্থান থেকে ইসলামী দর্শনকে এক মুক্ত চিন্তার ভয়হীনতা, অজানাকে জানার সাহস মুসলিম মননে প্রবেশ করান মুতাযিলারা। এটি সম্ভব হয় যখন স্বয়ং মুসলিম শাসকরা মুতাযিলা মতবাদকে গ্রহণ করেন। রাজশক্তির সমর্থন ছাড়া পৃথিবীর কোন দর্শন-ধর্ম প্রতিষ্ঠা পায়নি। উমাইয়াদের পতনের পর আব্বাসিয়া শাসনামলে মুতাযিলা মতবাদ প্রসার লাভ করে। খলিফা আল মনসুর, আল মামুন, আল মুতাসিম ছিলেন মুতাযিলা মতবাদের ঘোর সমর্থক।
কিন্তু পরবর্তী শাসকরা আলেম ওলামাদের পরামর্শে ইসলামের দ্বিনী দর্শন দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে প্রচার ও মুতাযিলাসহ দার্শনিক বিজ্ঞানীদের ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সমস্ত লেখা বক্তব্য বাতিলের ব্যবস্থা নেন। কঠরভাবে জ্ঞান অন্বেষে নিযুক্ত মানুষগুলির উপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। আল কিন্দিকে তার “কুফরী চিন্তার” কারণে বেত্রাঘাতের শাস্তি দিয়েছিল খলিফা! এই ছিল একজন জ্ঞান সাধকের পুরস্কার। ১১৫০ সালে ইবনে সিনার দার্শনিক রচনাবলী নাস্তিকতার অভিযোগে পুড়িয়ে ফেলা হয়। সিনা প্রাণ নিয়ে দেশান্তরিত হন। মুক্তচিন্তক আল রুকন আল সালাম নাস্তিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং তার সমস্ত রচনা পুড়িয়ে ফেলা হয়। আহমদ বিন আল তায়েব সারাখশি ছিলেন ধর্মতত্ত্ববিদ যিনি তার রচনায় ঈশ্বর বিষয়ে তার সংশয়কে প্রকাশ্যে উল্লেখ করেন। ৮৯৯ সালে তাকে নাস্তিকতার অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। দার্শনিক আবু বকর মোহাম্মদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে বাজা তার বইতে লিখেছিলেন খাঁটি দর্শনের সঙ্গে ইসলামের বিরোধ রয়েছে। নাস্তিকতার অভিযোগে পরে তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। ইবনে রুশদের নাম মুখে নিয়ে এখন মুসলিমরা ফেনা তুলে ফেলে। অসামান্য বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটিকে তার লেখার জন্য প্রহাতে হয়েছে নির্বাসনের জ্বালা। কারণও ছিল যথেষ্ঠ। তিনি ইসলামের মূল নীতিগুলোর বিরোধীতা করেছিলেন। ইবনে রুশদ দাবী করতেন নারীরা সর্ব বিষয়ে পুরুষের সমকক্ষ হতে সক্ষম। তাদের সমঅধিকার দিলে সমরক্ষত্র, সমাজে, রাষ্ট্রে পুরুষের মত সমান দক্ষতা দেখাতে পারবে। এসব পরিস্কার ইসলামী বিধানের বিরোধী মতবাদ। ইউরোপে প্রচারিত সংশয়বাদের উপর লিখিত তিন খন্ড গ্রন্থের রচিয়তা হিসেবে সন্দেহ করা হয় ইবনে রুশদকে যে বইতে মুসা, যীশু ও মুহাম্মদকে ভন্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে! ইবনে রুশদের সমস্ত বই পুড়িয়ে ফেলার হুকুম হয়। জনগণ ঘৃণাভরে ইবনে রুশদকে প্রত্যাখ্যান করে। নির্বাসিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এই মহান বিজ্ঞানী-দার্শনিক-লেখক মানুষটি।
ইসলামী শাসনামলে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান দর্শনের সর্বচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলো। প্রগতিশীলতার ছদ্মবেশে মুসলিম জাতীয়তাবাদী থেকে শুরু করে বামপন্থিরাও আমাদের এরকম ইতিহাস সময় সুযোগ পেলেই ছবক দিতে লেগে যান। এই হচ্ছে তার নমুনা! ভারতীয় বিজ্ঞানী আর্য মিহির কিংবা চরক যে সময়ে জন্মেছিলেন তাকে বিবেচনা করে কি বলা হয় হিন্দু শাসনামলে হিন্দুরা জ্ঞান বিজ্ঞানের সর্বচ্চ শিখরে পৌঁছে ছিলো? সারা পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞানের ৯৮ ভাগই করেছিলো ইউরোপীয়ানরা, তাদের কি আমরা তাদের ধর্মীয় পরিচয় ধরে খ্রিস্টান বিজ্ঞানী বলি? ইহুদী বিজ্ঞানী এরকম নাম কেউ শুনেছে? বাংলার আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, হুমায়ূন আজাদ, তসলিমা নাসরিনকে কি মুসলমান বলা যাবে? শুধুমাত্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণের কারণে তবু যদি মুসলিমরা তাদেরকে মুসলিম বলে স্বীকার করে নেয়ও, তাদের দর্শন, পান্ডিত্যকে কি কিছুতে ইসলামের অবদান বলা যাবে? যাদেরকে এক সময় মুরতাদ, নাস্তিক, কাফের বলে হত্যা করা হয়েছে, একঘরে করা হয়েছে- পরবর্তীকালের তাদেরকেই “মুসলিম দর্শনিক-জ্ঞানী” ব্যক্তি বলে প্রচারণা চালানো চরম ভন্ডামী ও প্রতারণা। তাছাড়া মুসলিম বলতে কোন জাতিকেও বুঝায় না। এরকম জাতি ধারণা অবাস্তব অবৈজ্ঞানিক। উপরন্তু ‘মুসলিম বিজ্ঞানি’ ‘মুসলিম সাহিত্যিক’ এরকম সাম্প্রদায়িক বিভাজন যারা করে তারা নাকি সাম্প্রদায়িক নয়! মুসলিমদের জন্য কি সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা আলাদা?
Written by : সুষুপ্ত পাঠক
মুক্তচিন্তক হত্যা
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................