যীশু নিজেই ‘খ্রিস্টান’ ছিলেন না!

আপনি যদি খাঁটি খ্রিস্টান হতে চান, যীশুর খ্রিস্টান ধর্মে ফিরতে চান তাহলে আপনাকে হতাশ হতে হবে। কেননা যীশু নিজেই ‘খ্রিস্টান’ ছিলেন না! যীশু ইহুদী ছিলেন এবং তিনি নতুন করে কোন আইন নিয়ম বিধি কিছুই দেননি। এমনকি কাউকে ‘খ্রিস্টান’ বানাননি। পৃথিবী প্রথম খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা দিয়ে মানুষজনকে খ্রিস্টান বানিয়েছিলেন যীশুর মৃত্যুর পর সাধু পল। তিনিই গির্জা বানান, ‘খ্রিস্টান ধর্ম’ বনান। এবং ইহুদী রোমান গ্রীকদের ‘খ্রিস্টান’ বানান। খ্রিস্টান মিশনারী তিনিই সৃষ্টি করেন।



#ইহুদীরা হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করে ছিলো তাদের প্রতিশ্রুত নবী আসবে যিনি তরোয়াল হাতে ডেভিড নবীর মত ইহুদীদের জন্য একটা রাজ্য তৈরি করে দিবেন। সমগ্র পৃথিবী হবে ইহুদীদের অধিনে। তাদের সেই নবী যুদ্ধ করে তাদের হারানো রাষ্ট্র আবার ফিরিয়ে দিবেন। মানে এক রক্তক্ষয় যুদ্ধের মাধ্যমে ইহুদীরা আবার তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরে পাবে। কিন্তু যীশু এসে বলা শুরু করলেন একদম উল্টো কথা। তিনি বললেন, তার কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই। রাজনৈতিক কোন উচ্চাভিলাষ নেই। তিনি ক্ষমতায় নিতে আসেননি। দেশ শাসন করতে আসেননি। দেশে কারা শাসক সেটি তিনি ভাবছেন না। তার কাজ ‘ঈশ্বরের স্বর্গরাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করা। কি সেই স্বর্গরাজ্য? নিজের ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, প্রতিবেশির প্রতি ভালোবাসা, এমনকি আমাদের শত্রুদের প্রতিও ক্ষমা ও ভালোবাসা। যীশু পতিতাদের দীক্ষা দিয়েছেন। তাদের কর্মকে সমাজের তথাকথিত ভালো মানুষদের নিজেদের পাপহীনতা নিক্তিতে মাপতে বলেছিলেন। বলা বাহুল্য কেউই পাপহীন নই তাহলে আমরা কে অন্যকে বিচার করার? যীশু এরকমই এক সাধু ছিলেন। যীশু ও গৌতম বুদ্ধ নিয়ে লিখতে গেলে নাস্তিক হিসেবে কখনো কখনো অস্বস্তিতে পড়তে হয় কেননা এতে করে দুটি ধর্মের প্রধান দুই পুরুষকে প্রশংসা করা হয়ে যায়। বুদ্ধ ছিলেন একজন ‘বুদ্ধবাদী’ দার্শনিক।

বুদ্ধও নিজেই ‘বৌদ্ধ’ ছিলেন না! তিনার জন্ম সনাতনেই। তার মৃত্যুর ৪০০ বছর পরে কিছু ভক্ত ধর্মের রুপ দেওয়। যদিো তা সনাতনীরী অংশ ছিল। তবে ভারতে ইসলামে প্রবেশের পরেই তা ধর্ম রুপ নেয়।
 ভারতে এই ‘বুদ্ধবাদ’ অনেক প্রাচীন। ‘বুদ্ধবাদ’ গ্রীসেও পৌঁছেছিলো এবং গ্রীক দার্শনিকদের অনেকে ‘নির্বান লাভ’ সম্পর্কে ধারণা রাখতেন। যীশুর জন্মের ক্ষণে ইহুদীদের একাংশ বুদ্ধবাদে বিশ্বাসী ছিলো এটি আমার আগের একটি লেখায় উল্লেখ্য করলে আমাকে গাঁজাখুরি বলতেও দ্বিধা করেননি। সেদিন একজন বললেন, আমাকে এজন্য মনে মনে গালাগালি করলেও তিনি যখন ‘সোফির জগত’ পড়েছেন তখন নাকি এই তথ্যটি সেখানে পেয়েছেন। আমাকে সরিও বলেছেন শেষে। যাই হোক, গৌতমের আগেও অনেক ‘বুদ্ধ’ এসে গেছেন। গৌতম ছিলেন আসলে একজন দার্শনিক। গ্রীক দার্শনিকদের হাজার বছর আগেই তিনি মৌলিক কিছু দর্শন প্রদান করেছিলেন মানুষ ও জগত সম্পর্কে। বুদ্ধও কোন ধর্ম রীতি প্রথা কিছুই দিয়ে যাননি। বিষ্ণু ব্রক্ষাকে নাকচও করেননি। তাদেরকে দিয়ে কোন কাজ হয় তাও বলেননি। প্রচলিত ধর্ম নিয়ে তিনি কিছু বলেননি। তিনি মানুষের ‘নির্বান’ লাভের জন্য, মানুষের দার্শনিক মুক্তি লাভের কথা বলে গেছেন। যীশুর মৃত্যুর পর যেমন তার বড় রকমের ভক্ত পল তাকে ঈশ্বর বানিয়ে আশ্রম বানিয়েছিলেন গৌতমের মৃত্যুর পর সেটাই ঘটেছে। তাই বার্মার উগ্রবাদী ভিক্ষুদের সন্ত্রাসের উত্স খুঁজতে গেলে গৌতম বুদ্ধ আসবে না। যেমন খ্রিস্টান ধর্মের অতিতের উগ্রতা সন্ত্রাসের উত্স খুঁজতে গেলে যীশু আসে না। আজকের ভান্তে মঠের ভিক্ষুরা যদি গৌতমের সময়ের বৌদ্ধ হতে চায়, সেই শেকড়ে ফিরতে ‘মৌলবাদী’ হতে চায় তো দেখত পাবেন একজন দার্শনিক (গৌতম) তার শিষ্যদের বলছেন, তুমিই তোমার মুক্তির পথ দেখতে পাবে আর কেউ নয়। নির্বান লাভের পথ তোমাকেই খুঁজতে হবে। তিনি শিষ্যদের বলছে, ‘আমি’ বলতে কিছু নেই। ‘আমার’ বলতেও কিছু নেই। কেননা শাপের খোলসের মত আমরা আমাদের খোলস বদলে ফেলছি। আজকের আমি আর কালকের আমি এক নই...। এ কিন্তু কোন ভাবের কথা নয়। ২১ বছরের তরুণ তরুণী কি ৩০ বছরে গিয়ে তাকে আর নিজের মধ্যে দেখতে পায়? ৫০-এর কোঠায় পা দিয়ে কেউ নিজের ২৫ বছরের মানুষটিকে নিজের মধ্যে দেখে? না শরীরের কথা হচ্ছে না, সেটা তো বুড়ো হয়ই, আমি বলছি আমাদের ভেতরে যে ‘আমি’ অনুভূতি তা কি এক থাকে? থাকে না। বুদ্ধের দর্শনই হচ্ছে জীবের সঙ্গে এই জগতের সম্পর্ক নিয়ে। এখানে তরোয়াল বন্দুক রাজনৈতিক ক্ষমতা এসবের কোন সম্পর্ক নেই। খোদ বুদ্ধের জীবনে তার শিষ্য শ্যালক তাকে না জানিয়ে রাজবিদ্রোহের ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়লে তাকে অনেক ভুগতে হয়েছিলো। শ্যালককে আশ্রম থেকে বের করে দেন এবং শ্যালক তাকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সেখানে হযরত মুহাম্মদ ছোটবড় অনেকগুলি যুদ্ধ করেছিলেন! তার প্রতিষ্ঠিত মসজিদে ‘মেহরাব’ নামে অর্ধ ডিমাকৃতি স্থান থাকে যেখানে অস্ত্র রাখার জন্য নির্দিষ্ট। মুহাম্মদ জীবিত থাকতে তার সঙ্গীদের বিভিন্ন স্থানে আক্রমন করতে পাঠাতেন ‘গণিমতের মাল’ লুটে আনতে কারণ তার সাম্রাজ্যের একমাত্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিলো এই গণিমতের মাল। মৃত্যুর চারদিন আগেও তিনি অভিযানে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। তিনি দাস ব্যবসা করেছেন। বহু ইহুদী তার হাতে দাস হয়েছে। তার দেখানো পথে পরবর্তী সাতশো বছর বহু জাতি দাস হিসেবে মুসলমানদের হাত বন্দি হয়েছে। একজন মুসলমান যখন খাঁটি মুসলমান হতে চায়, নবী মুহাম্মদের মত মুসলমান হতে চায়, তার দেখানো পথে চলতে চায় তখনই সমস্যাটা প্রকট হয়ে যায়! অথচ জার্মানির মার্টিন লুথার এলেন কঠিন এক মৌলবাদী হয়ে যিনি একদম যীশুর ধর্মে ফিরে যেতে চাইলেন। যীশুর দিকে যেতে যেতে তিনি দেখতে পেলেন সেখানে গির্জা নেই, পোপ নেই, ফাদার বিশপ কিছুই নেই! তাই তার হাতে জন্ম হলো খ্রিস্টান ধর্মের আরেকটি গ্রুপ ‘প্রোটেস্ট্যান্ট’। বিপরীতে আবদুল ওহাব যখন নবী মুহাম্মদের দেখানো ইসলামে ফিরতে তার উত্স সন্ধানে বের হলেন তিনি দেখলেন সেখানে জিহাদ করে কাফেরদের হাত থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা কেড়ে নেয়াই আল্লার একমাত্র উদ্দেশ্য। নামাজ রোজা হজ যাকাতই এই ধর্মের প্রধান কিছু নয়। ফলে জন্ম নিলো ‘সালাফি’ গ্রুপ যার অর্থ ‘পূর্ব পুরুষ’। অর্থাত পূর্ব পুরুষদের ইসলামে ফেরা। আজকের ‘জঙ্গিবাদ’ বলতে আমার যাদেরকে জানি তারা এই সালাফি গ্রুপের ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

#এদিকে ভারতে যে হিন্দু ধর্ম আমরা দেখি সেটা মুহাম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু আক্রমনের আগে তার নামগন্ধুই কেউ শুনেনি। ভারত ছিলো কয়েক হাজার রকমের প্রথা ব্রত পালনের দেশ। ছিলো স্থানীয় প্রথা ব্রত দেবতার পাশাপাশি আর্যদের প্রথা ব্রত দেবতা যারা কয়েক হাজার বছর পূর্বে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। মুসলমান আসার আগে বৌদ্ধ ধর্ম ভারতে আরো আরো ধর্মের মতই একটি সনাতনী শাখা হিসেবে বিবেচিত হতো কারণ গৌতম বিষ্ণু ব্রাহ্মকে নিয়ে অবিশ্বাসের কিছু বলে নিজে নতুন কোন ঈশ্বরের কথা শোনাননি। আজো যদি ভারতে বাইরের কোন শক্তি না আসত তাহলে ‘সনাতন ধর্ম’ বলতে আমরা এখন যা বুঝি, ‘হিন্দু’ বলতে শত শত বংশগত টাইটেলের যে মানুষজন দেখি তার প্রতিটি হতো একেকটি আলাদা ধর্শনের মত! মোটা দাগে থাকত শতেকখানে ধর্ম দর্শন। সেই ধর্মগুলির দেবতাদের মধ্যে মিল থাকলেও তারা আলাদা ধর্ম দর্শন হিসেবেই নিজেদের আলাদা রাখত। ভারতের ধর্মগুলি দর্শন মূলত প্রাচীন কিছু দার্শনিকদের জগত সম্পর্কে চিন্তা ভাবনার সমষ্ঠি। যে কারণে বেদে আমরা নাস্তিক ঋষিদের দেখতে পাই যারা ঈশ্বর ধারণাকে নাকোচ করে দিচ্ছেন। ফলে ভারতে কখনোই একক কোন মৌলবাদের জন্ম সম্ভব নয় প্রফেট মুহাম্মদের ‘উম্মাহ’ আইডলজিতে। ইসলামের বড় চিন্তা বিষয় হচ্ছে এখানে ‘প্যান ইসলামিজম’ একটি ভয়াবহ জাতীয়তাবাদ যেখানে একজন মানুষ ধর্ম পালন না করেও ‘মুসলমান’ হতে পারে। এমনকি ইসলামে বিশ্বাস না করেও ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদী’ হতে পারে। ‘মুসলিম শাসন’ নামের আরব তুর্কি আফগান শাসন ও সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস তার প্রমাণ। উপমহাদেশে ‘মুসলমানদের দেশ’ যারা প্রতিষ্ঠিত করেছিলো তারা কেউ ‘জিহাদী মুসলমান’ ছিলো না। তাদের কেউই সালাফিও ছিলো না। অনেকে ধর্ম বিশ্বাসহীন ছিলো। ধর্মকর্ম পালন করেনি কোনদিন। ইসলামে হারাম সমস্ত খাবারদাবার পোশাক আশাক চলাফেরায় ছিলো অভ্যস্থ। এই প্যান ইসলামিজম কিন্তু নবী মুহাম্মদের সময় থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। বহু হাদিসে তার প্রমাণ রয়েছে। মানে এই স্যুট বুটেডে ‘মুসলমান’ যে জাতীয়তাবাদ- তার উত্সও খোদ ধর্মের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে!

#উপসংহার: ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বর্তমান বিশ্বে ইসলাম আজকের যুগে এসেও এতখানি শোরগোল করতে পেরেছে কারণ এই মতবাদটি সরাসরি ইসলাম ধর্মের অংশ। অন্য ধর্মের মৌলবাদ তাদের ধর্মের মূল অংশ নয়। তাই তাদেরকে স্রেফ ধর্ম দিয়েও দমন করা সম্ভব। ইসলামকে তা সম্ভব নয়। 

#সুষুপ্ত #পাঠক #Jesus #Gautama #Buddha #Muhammad #Islam #Christian #Buddhist  #Sain Paul

Copyright © 2023 Susupto Pathok aka সুষুপ্ত পাঠক all rights reserved.

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted