হিন্দুত্ববাদীদের এক শ্যামা সংগীত দিয়েই জব্দ করা যায়!

হিন্দুত্ববাদীদের এক শ্যামা সংগীত দিয়েই জব্দ করা যায়! শ্যামা সংগীতের ভক্তসাধক কয়েকজন কবির নাম বলি যাদের লেখা গান দিয়েই আজো কালীর প্রতি অর্ঘ্য জানানো হয়। চট্টগ্রামের সা বিরিদ খাঁ, নওয়াজিস খান, আলি রজা, আকবর আলি, মির্জা হুসেন আলি, মুনসি বেলায়েত হোসেন, সৈয়দ জাফর খাঁ...। এর মধ্য যদি হাসন রাজার নাম করি তো সকলেই তাকে চেনেন। সিলেটের হাসন রাজা যে শ্যামা সংগীতই শুধু লিখেননি, তিনি যে কালী সাধনায় মজে ছিলেন, কী বিপুল ছিলো তাঁর কালীর প্রতি প্রস্বস্তি তা তার লেখা গান থেকেই তুলে দেই-

“আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি
আমি কি তোর যমকে ভয় করি।
শত যমকে তেড়ে দিব,
সহায় শিবশঙ্করী”

আরেক গানে বলেছেন-
“ওমা কালী! কালী গো।
এতনি ভঙ্গিমা জান।
কত রঙ্গ ঢঙ্গ কর যা ইচ্ছা হয় মন...”

হাসন রাজাকে নিয়ে এখন কোন অনুষ্ঠান হলে সুকৌশলে তার রচিত শ্যামা সংগীতকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। তাকে একজন ‘মুসলিম মরমী সংগীত ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই উদ্দেশ্য। প্যান ইসলামিজম এখন প্রচন্ডভাবে শিল্প সাহিত্য সংগীত জগতের মানুষের মধ্যে সক্রিয়। যেকালে কথিত এইসব ‘মুসলিম কবিরা’ শ্যামা সংগীত রচনা করেছেন সেকালে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে তারা স্বাদরে গৃহিত হয়েছিলেন তা নয়। নজরুল ইসলামকে তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছিলো। এখন অবশ্য নজরুল ইসলামের শ্যামা সংগীত রচনা, তার কালী প্রতিমার সামনে বসে চোখ মুঁদে ধ্যান সাধনাকে আড়াল করে তাকে একজন ‘মুসলিম জাগরণের কবি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সর্বাত্ম চেষ্টা সলিমুল্লাদের। নজরুল ইসলামকে নিয়ে আজকে কিছু লিখবো না। অন্য কবিদের লেখা শ্যামা সংগীতের কিছু উদাহরণ দিয়ে শুরুতে হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ে যে কথা বলছিলাম তার আখ্যান শেষ করবো।




সৈয়দ জাফরের লেখা শ্যামা সংগীতের কয়েকটি লাইন-
“কেন গো ধরেছ নাম দয়াময়ী তায়
সৈয়দ জাফর তরে
কী ধন রেখেছ ধরে
সম্পদ দুখানি পদ হরের হৃদয়”

মুনসি বেলায়ত হোসেনের শ্যামা সংগীত-
“কালী কালী বলে কালী, সহায় হইলে কালী
নাথেরে পাইবে কালী
ঘুচিবে এ বিরহানল”

মির্জা হুসেন আলীর শ্যামা সংগীত-
“আমি তোমার কি ধার ধারি,
শ্যামা মায়ের খাসতালুকে বসত করি।
বলে মির্জা হুসেন আলী যা করেন মা জয়কালী,
পূণ্যের ঘরে শুন্য দিয়ে, পাপ নিয়ে যাও নিলাম করি”

কেয়ামত আলি খাঁ মুনসির শ্যামা সংগীত-
“হরিকে কালী বলা ভুল,
কালীকে হরি বলা ভুল।
আমি ভেবে ভেবে হলাম পাগল, পেলাম না তার মুলামূল”

এসব রচনা যে কোন ‘মুসলমান কবির’ সেকথা কি হিন্দুরা জানত না? নিশ্চয় জানত! মুনসি বেলায়ত হোসেনকে হিন্দুরা ভালোবেসে ‘কালীপ্রসন্ন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলো! ভজন হিন্দু ধর্মের উপাসনার অনুসঙ্গ। সংগীত এই ধর্মের দেবতাদের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম। হিন্দু দেবীদের হাতে থাকে বাদ্যযন্ত্র। সেই সংগীত মুসলমান রচনা করে দিলে হিন্দুদের কোন সমস্যা আবহমানকাল ধরে হয়নি। তাহলে এখানে হিন্দুত্ববাদীরা কি করে জায়গা করে নিবে? হিন্দুত্ববাদ তো হিন্দু ধর্মের অংশই না। যদি হতো তাহলে বিশ্বনাথের মন্দিরে বিসমিল্লাহ খাঁ সানাই বাজাতে পারতেন? বিসমিল্লাহ খাঁ বহুবার ইন্টারভিউতে বলেছেন, তিনি ‘বাবা বিশ্বনাথের চরণ ছেড়ে আর কোথাও যাবেন না। এখানে বসেই তিনি সানাই বাঁজাবেন...’। হিন্দুদের তো কোন সমস্যা হয়নি বিসমিল্লাহ খাঁকে নিয়ে। মক্কার সামনে কোন হিন্দু সাধুকে তো মুসলমানরা বসে থাকতে দিবে না। কোন অমুসলিমের লেখা ধর্মীয় শ্লোক কি মুসলমানরা ব্যবহার করবে? খ্রিস্টানরা? ইহুদীরা? পারবে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, হিন্দু ধর্মটা আসলে কবিদের সৃষ্টি। সত্যিই তাই। ব্যাসদেব থেকে বাল্মীকি, কৃত্তিবাস ওঝা সবাই কবি। আর শ্যাসা ভজন তো হিন্দু মুসলমান মিলেই লিখল! কবি নির্মেলেন্দু গুণের ছেলেবেলা বইতে তিনি লিখেছেন ময়মনসিংহের মিজানুর রহমান নামের একজন শিল্পীর বানানো দুর্গা প্রতিমা দিয়ে পুজা হতো। মুসলমান শিল্পীর হাতে বানানো প্রতিমা দিয়ে পুজা করতে সমস্যা হয়নি এককালের হিন্দুদের। কবি জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন ফরিদপুরে কবিগানের হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে যে ছেলেটির পান্ডিত্য যে কোন হিন্দুদের চেয়ে বেশি ছিলো তার নাম ইসমাইল। তাকেও হিন্দুরা সাদরে গ্রহণ করেছিলো। হিন্দুদের শেষ করে দিয়েছে জাতপাত। মানুষকে ছোট জাত বলে যে ঘৃণা হিন্দু করে থাকে তার তুলনা পৃথিবীতে বিরল। আজো একই রকম রয়ে গেছে হিন্দুর ঘৃণা মানুষের প্রতি...।

তো, হিন্দুত্ববাদ কি করতে পারে হিন্দুদের? কিছুই না। ইসলামিজম যেমন ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিন্দুত্ব তেমন নয়। হিন্দুত্ব বলতে সিন্ধু সভ্যতার মানুষজনের লোকাচার বুঝায়। ‘হিন্দু ধর্ম’ বলতে কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই! শিব তো হাল চাষ করত! শশ্মানে বসে গাঁজা খেতো। ভাং খেয়ে খেয়ে ভূড়ি বড় করে ফেলেছিলো। এই শিব বাংলার কৃষিজীবী গৃহস্ত। এ আমাদের চিরচেনা বাপ কাকাদের চরিত্র। এই হিন্দুত্ব কোন হিন্দু রাষ্ট্রে কথা বলে না। ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ এরচেয়ে আজগুবি জিনিস আর হয় না। আমরা সবাই ‘হিন্দু’। ভারতবর্ষের মুসলমানদের সামাজিক পারিবারিক জীবনে চোরাস্রোতের মত বয়ে চলে হিন্দুত্ব। ধার্মিক মুসলমানেও সমস্যা নেই যদি তার হিন্দুত্ব নিয়ে তিনি সজাগ থাকেন। ‘হিন্দুত্ব’ এই অঞ্চলের মুসলমানদেরও সংস্কৃতি। রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষে ‘হিন্দু-হিন্দু’ ‘হিন্দু-মুসলমান’ ‘হিন্দু-খ্রিস্টান’ ‘হিন্দু-বৌদ্ধ’ হতে বলেছিলেন এ কারণেই। ‘হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি’ দিয়ে আপনারা কোনদিনই জিততে পারবেন না ধ্বংস ছাড়া। ইসলামিজম, গজওয়াতুল হিন্দ, লাভ জিহাদ যে যা বলেন না কেন, এই অসুখের ঔষধ ‘হিন্দুত্ববাদ’ নয়। ইসলমামিজম ধ্বংস হবে লোকায়েত ‘হিন্দুত্বের’ কাছে। আজকে যাকে আমরা ‘হিন্দু ধর্ম’ বলি তার কাছে নয়। যে উদার বাহু দিয়ে বুকে টেনে নেয় সেই বহুত্বের কাছে হারবে খিলাফতবাদীরা। সেই হিন্দুত্বের কাছে ‘হিন্দুত্ববাদীরাও’ হেরে যাবে! বিসমিল্লা খাঁ আর বিশ্বনাথের মন্দির যে একাকার হয়ে গেছে! হিন্দুত্ববাদের সাধ্য কি তাকে দূরে সরায়? আমি শ্যামা সংগীত বা কীর্তনের প্রশংসা করতে আসিনি। যদিও সংগীত নিরপেক্ষ হিসেবে সেটা নাস্তিকেরও ভালো লাগতে পারে। কঠোরভাবে নাস্তিক ড. আহমদ শরীফের কীর্তন খুব পছন্দ ছিলো। আমার ভক্তিরস একদমই নেই। আমি শুধু এই রচনায় এটাই বুঝাতে চেয়েছি ‘সাঁওতালদের দেবী’ কালীর ভজন সংগীত যদি মুসলমান লিখতে পারে আর সেটা হিন্দুরা সাদরে গ্রহণ করে তো সেখানে হিন্দুত্ববাদী খিলাফতবাদী সব পক্ষই হেরে যায়...। এই সহজ সহিষ্ণুতাটুকুই আমাদের সংস্কৃতি। এটাই সিন্ধু পাড়ের ‘হিন্দুত্ব’।

©Susupto Pathok সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted