১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবে মুসলমানরা হিন্দু দেবতা রামের স্ত্রী সীতাকে পতিতা আখ্যা দিয়ে একটি বই বের করেছিলো।

ইলমুদ্দিনের জানাজায় দুই লক্ষ মুসলমান অংশগ্রহণ করেছিলো। কবি আল্লামা ইকবাল তার লাশ কবরে নামাতে নামাতে বলেছিলেন, এই অশিক্ষিত ছেলেটি আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বোম্বেতে আইন প্রক্টিস করতেন, তিনি ইলমুদ্দিনের মামলা লড়তে সেখান থেকে লাহোর ছুটে গিয়েছিলেন। কে এই ইলমুদ্দিন? একজন গরীব কাঠমিস্ত্রির সন্তান। কিন্তু তার নামে পাকিস্তানে রাস্তাঘাট প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছিলো কারণ সে ‘রঙ্গীলা রসূল’ নামের একটি বইয়ের প্রকাশককে খুন করেছিলো!

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবে মুসলমানরা হিন্দু দেবতা রামের স্ত্রী সীতাকে পতিতা আখ্যা দিয়ে একটি বই বের করেছিলো। এই বইয়ে হিন্দু সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হলে ‘আর্য সমাজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বামী দয়ান্দের একজন শিষ্য কৃষ্ণ প্রসাদ মুসলমানদের বইয়ের পাল্টি হিসেবে ‘রঙ্গীলা রসূল’ নামের একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে নবী মুহাম্মদের শিশু স্ত্রী আয়েশা ও তার বহু বিবাহ নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুত করে লেখা হয়। লেখার জবাব লেখা দিয়ে যদি পরিশোধ করা হয় তাহলে এটি ছিলো সব দিক থেকেই ভালো। কিন্তু ‘রঙ্গীলা রসূল’ মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সীতাকে পতিতা বলার কাহিনী চাপা পড়ে যায়। কেউ আর বলে না কেন হিন্দুদের দেবদেবীদের নিয়ে আগে ওরা লিখতে গেলো। এখন যেমন কেউ বলে না কেন ফ্রান্সের শিক্ষককে অকারণে হত্যা করা হলো- সবাই বলছে কেন ফ্রান্স মুহাম্মদের কার্টুন প্রকাশ করতে গেলো?



রঙ্গীলা রসূল বইটিকে প্রথমে আদালতে মামলা হিসেবে উঠানো হলো। সীতাকে নিয়ে লেখা বইয়ের বিষয়ে কিন্তু কোন মামলা মোকাদ্দমা হলো না। পাঁচ বছর মামলা চলার পর কোর্টের রায়ে রসূলা রসূলের প্রকাশক রাজপালকে আদালত দায়ী করে দোষী সাব্যস্ত করে। কিন্তু হাইকোর্টে গিয়ে রাজপাল নিদোর্ষ বলে প্রমাণিত হয়। কারণ বই প্রকাশ করে ভারতীয় পেনাল কোর্ডের ১৫৩ ধারা অনুযায়ী রাজপাল কোন অপরাধ করেননি। প্রকাশক রাজপাল মামলা চলাকালীন অনেকবার প্রাণনাশের শিকার হয়ে বারবার বেঁচে যান। এত কিছুর পরও তিনি একবারের জন্যও বইয়ের লেখক কৃষ্ণ প্রসাদের নাম গোপন রাখেন। নিজের জীবন বিপন্ন করেও প্রকাশক লেখকের নামটি শেষদিন পর্যন্ত গোপন রাখেন।

এই রায়ে মুসলিমদের পরাজয় হলে এবার চলে মসজিদে মসজিদে রঙ্গীলা রসূলের লেখক প্রকাশকে খুন করার জন্য ফতোয়া দেয়ার প্রতিযোগীতা। এরকম একটি মসজিদ লাহোরের ওয়াজি খানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল ১৯ বছর বয়সী ইলমুদ্দিন। মসজিদের ভেতর তখন মাওলানা সৈয়দ আতাউল্লাহ শাহ বুখারী জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে রঙ্গীলা রসূলের লেখক প্রকাশকে খুন করে নবী অবমাননার প্রতিশোধ নিতে মুসলমানদের আহ্বান করছিলো। এই ভাষণে প্রচন্ডভাবে ইলমুদ্দিন প্রভাবিত হয়ে এক রূপী দিয়ে একটি ছুরি কিনে রাজপালের বইয়ের দোকানে গিয়ে তাকে খুন করে আসে।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল ইলমুদ্দিন যাকে খুন করল সে কি লিখেছে বা রঙ্গীলা রসূল বইতে কিভাবে নবীকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে তার কিছু না জেনেই হুজুরের প্ররোচনায় খুন করে ফেলল। সালমান রুশদীর স্যাটানিক ভার্সেস বই কোন মুসলমানই বলতে গেলে পড়েনি। তবু তার ফাঁসি চেয়ে ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশে পাড়ায় পাড়ায় মিছিল মিটিং হয়েছে। রুশদী ধনী ও সুরক্ষিত লেখক বলেই এ যুগের কোন ইলমুদ্দিন তার কল্লা ধর থেকে আলাদা করতে পারেনি।

ইলমুদ্দিন খুন করে পালায়নি। সে নিজে থেকে ধরা দিয়েছে। সে অনুতপ্ত নয়। সে ঝোঁকের মাথায়ও এই খুন করেনি। সে বলেছে তার ভেতরে নবীর জন্য যে প্রেম সেটাই তাকে এই খুন করতে একটুও পিছপা হতে দেয়নি। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৩১ অক্টোবর ইলমুদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর হয়। তার লাশ লাহোরে কবর দিতে ইংরেজ সরকার ভীত হয়ে পড়ে এই ভয়ে যে এটা স্থানীয় হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে আরো বড় রকমের বিপদ ঘটাতে পারে। ইলমুদ্দিনকে মিয়ানওয়ালিতে কবর দেয়া হয়। কিন্তু কবি আল্লামা ইকবালের পরিস্থিতি কোন রকম অবণতি হবে না আশ্বাসে ১৪ দিন পর কবর থেকে ইলমুদ্দিনের লাশ তুলে লাহোরে পাঠানো হয়। ইলমুদ্দিনের বাবা কবি ইকবালকে জানাজা পড়াতে বললে তিনি অপারগতা জানিয়ে বলেন, আমি একজন পাপী বান্দা, ইসলামের এই বীরের জানাজা পড়ানোর যোগ্যতা আমার নেই। দুই লক্ষ মুসলমান সেদিন জানাজায় অংশগ্রহণ করেছিলো। ইলমুদ্দিনের নামে রাস্তাঘাট নামকরণ করা হয়েছিলো পাকিস্তান হবার পর। ইলমুদ্দিনের কারণেই পাকিস্তানে ইসলাম অবমাননার বিরুদ্ধে কঠর আইন করা হয়। সব সময় বলা হয় গুটি কয়েক উগ্র অসহি লোকজনের জন্য গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে দোষ দেয়া ঠিক নয়। কিংবা গুটি কয়েক জঙ্গির জন্য সব মুসলমানকে দোষী করা ঠিক নয়। কিন্তু ইতিহাস থেকে দেখালাম ইলমুদ্দিনের পাশে গোটা মুসলিম কমিউনিটির পাশাপাশি মুসলিম লেখক বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদরা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওসামা বিন লাদেনের পোস্টার বাংলাদেশে ৯০ দশকে কেমন বিক্রি হত আর কারা সেগুলোর ক্রেতা ছিলো স্মরণ করুন। ইমাম খোমিনির ছবিসহ ক্যালেন্ডার কি বাংলাদেশে ভরে গিয়েছিলো না? ফ্রান্সে একজন শিক্ষককে হত্যার মত জঘন্য ঘটনা কি কার্টুন প্রদর্শনির মত ঘটনার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে না? গোটা মুসলিম বিশ্ব কিন্তু কার্টুনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে হত্যার বিরুদ্ধে নয়! এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কোন পরিবর্তন নেই!

©Susupto Pathok সুষুপ্ত পাঠক

ব্লগ শেয়ার -

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted