তবুও সমাজ বিজ্ঞানমুখীই হচ্ছে!
পৃথিবী যে সমতল নয় এবং সূর্য যে কোন পঙ্কিল জলাশয়ে ডুবে যায় না তা মানুষ মেনে নিয়েছে। রাত আর দিন যে আলাদা কিছু নয়, একটার আগে আরেকটা আসবে না— এমন কিছু নয়। মানুষ জানে আমেরিকায় যখন রাত তখন বাংলাদেশে দিন। মালেশিয়ায় যখন সন্ধ্যা পার তখন বাংলাদেশে বিকেল। সৌদিতে যখন মাগরিব পড়ছে তখন বাংলাদেশের মানুষ এশা পড়ে অনেকে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পরেছেন। ইউরোপ থেকে অফিস শেষ করে পুত্র যখন ফোন দিয়েছে, মধ্যরাতের ঘুম থেকে জেগে মা শুনছে ওখানে মাত্রই সন্ধ্যা! অর্থাৎ কোথাও রাত মানে পৃথিবীর সর্বত্র রাত নয় বা দিন নয়। কোথাও না কোথাও দিন বা রাত থাকছে অর্থাৎ সূর্য কোথাও বসে থাকছে না। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন মেনে নিয়েছে যে, সূর্যের চারদিকেই পৃথিবী ঘোরপাক খায়। তাদের অনেকে সৌরজগতের কথাও জানে ও মেনে নিয়েছে।
গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে তা আগেই আল্ট্রাসনোগ্রাম করে জানা যায়— এটাও মানুষ জানে এখন। গর্ভধারণের ৫/৬ মাস পরেই মানুষ জানতে পারছে। এতে দুটো বিষয় তারা নিশ্চিত হয়েছে— গর্ভাবস্থাতেই সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারিত হয় আর তা জানাও যায়। পিরিয়ড মিস হলেও ধরা হয় নারী গর্ভবতী হয়েছেন। কিন্তু সেটা নিশ্চিত নয়- মানুষ এখন জানে প্রেগনেন্সি টেস্ট করালেই নিশ্চিত হওয়া যায়। এ থেকে তারা সন্তান গ্রহণ বা অপ্রত্যাশিত সন্তান বর্জন করতে পারছেন। এমনকি নারীরা বিয়েবহির্ভূত অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানকে ভ্রুণাবস্থাতেই নিষ্কৃতি দিতে পারছে, মানে নিজেরা নিষ্কৃতি পাচ্ছে। আইন না থাকলেও ভ্রুণ নষ্ট করাকে সমাজ মেনে নিয়েছে।
চিকিৎসার অনেকগুলো বিষয়ও মানুষ মেনে নিয়েছে। তারা জানে হার্টএটাক বা স্ট্রোক করলে অতিদ্রুত রোগিকে হাসপাতালে নিতে হবে। যথা সময়ে নিতে পারলে রোগি শুধু বাঁচবেই না এমনকি তারা পঙ্গুও হবে না। মানুষ এখন বলে, ঠিকমতো চিকিৎসা না করানোর কারণেই ওমুকের মা মারা গেছে। অনেক সময় সন্তান সন্তুষ্টু থাকে যে, অনেক চিকিৎসা করিয়েছি তবুও বাবা বাঁচেনি। মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তির উপর নির্ভর করে হাল ছেড়ে দিচ্ছে না। খুব কম মানুষ একই সাথে হয়তো পানিপড়া বা তাবিজকবজ ব্যবহার করছে তবে তাদেরও আস্থা ডাক্তারই।
কোন পীরই আরেক পীরের পানি পড়া পান করে না৷ হেফাজতের সাবেক আমীর প্রয়াত শফি হুজুরও ভারতে গিয়েছেন চিকিৎসার জন্য৷ শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় ঢাকার এক হাসপাতালে৷ দেওয়ানবাগী পীরও ডাক্তারের কাছ থেকেই চিকিৎসা নিতেন যদিও তিনি ডিম পড়া দিয়ে সন্তান উৎপাদনের ভয়ানক প্রতারণা করে ব্যবসা করতেন৷ ভারতের বাবারাও রোগে দৌড়ায় ডাক্তারের কাছে যদিও শিষ্যদের পথ্য দেন সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য। যদিও তাতে কোন কাজ হয় না৷ এখন যারা পানি পড়া পান করে তারাও সাথে ডাক্তার দেখায়৷ মূল ভরসা ডাক্তারেই৷
বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা রাখার কারণেই বহু প্রতারণা ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে৷ সাপে কাটলেও তাই এখন ডাক্তারের কাছেই মানুষ যায়৷ মনসা দেবির প্রতি উপাসনাও কমে গেছে৷ এখন আর কেউ টিভি দেখা, মাইকে প্রচার দেয়া, মোবাইলে ভিডিও দেখার বিরুদ্ধে গলাবাজি করে না৷ মাটির নিচে পাতালপুরির কথাও মানুষ বিশ্বাস করে না৷ মাটির নিচের কোথাও নরক নেই, স্বর্গও নেই৷ কাজী ইব্রাহিম যতই মাটির নিচে সাতটি সূর্য ও আকাশ থাকার দাবি করুক তা মানুষ আর বিশ্বাস করে না৷ একটি আলাদা আসমানে চন্দ্র নেই, সূর্যের জন্যও আলাদা আসমান নেই৷ এক আকাশেই দৃশ্যমান চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র ভাসমান৷ কোন আসমানই স্বর্ণ বা রূপার তৈরি নয়৷
মহাবিশ্বের কেন্দ্র পৃথিবী নয়৷ পৃথিবীর কোন স্থাপনার উপরে মহাশূন্যের কিছু স্থির নেই৷ এসব গল্প মানুষ গল্প হিসেবেই নিচ্ছে৷ মিথ যে সত্য নয় তাও মানুষ বুঝে ফেলেছে৷ এখন পৃথিবীটা অনেকটা হাতের মুঠোয় নিয়েই দেখা যাচ্ছে৷ বহু আইনই মানুষ বিজ্ঞানসম্মত করে নিয়েছে। বাংলাদেশের মতো কিছু দেশে এখনো নিবর্তনমূলক আইন রয়েছে যা নাগরিকদের নিপীড়ন করছে কিন্তু একটু সভ্যতার ছোঁয়া পেলেই দেশগুলো আর নিকৃষ্ট আইন রাখছে না। এখনকার আইনে, চাইলেও- স্ত্রীকে প্রহার করতে পারবেন না, চারটি স্ত্রী একসাথে রাখতে পারবেন না, অন্যধর্মের মানুষের জন্য আলাদা কর চাপিয়ে দিতে পারবেন না, মুখে বলেই তিন তালাক দিতে পারবেন না, নাগরিক অধিকারে শূদ্রের ওপরে ব্রাহ্মণকে স্থান দিতে পারবেন না, ডাইনী বলে কোন বৃদ্ধাকে হত্যা করতে পারবেন না, শয়তানের দোহাই দিয়ে অপরাধ থেকে নিষ্কৃতি পাবেন না। বাংলাদেশের মতো অগণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারহীন দেশেও এমন বিষয়গুলো সিংহভাগ মানুষই মেনে নিয়েছে। আর সভ্য দুনিয়া গালগল্প ও আষাঢ়ে গল্প বলিয়েদের ছুড়ে ফেলে দিয়ে মানুষের বিজ্ঞানসম্মত কল্যাণের দিকেই এগিয়েছে। আমাদের মতো দেশেও মানুষ বিজ্ঞানের বহু কিছুই গ্রহণ করেছে বাকিটাও করবে৷ শুধু অগ্রসর মানুষকে কথা বলতে হবে৷ কথার শক্তিতেই আজ মানুষের এই পরিপবর্তন। নইলে বিজ্ঞানের এতো অগ্রযাত্রাতেও মানুষের চিন্তার জগৎ প্রসারিত হতো না। আমাদের কথাগুলো হারিয়ে যায় না। কোথাও না কোথাও পরিবর্তনের ছাপ রেখেই যায়।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................