হিন্দুদের বিয়েতে ঠিকুজি-কুষ্ঠির ব্যবহার ও বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল স্যাগানের অমর উক্তি.. "আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান।"
চলুন, একটু ভিন্নভাবে বিষয়টা জানি। ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পৃথিবী থেকে ভয়েজার-১ নামক এক কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়, সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহ সমূহের তথ্যানুসন্ধানই ছিলো যার লক্ষ্য। সেই থেকে ভয়েজার-১ বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের ছবি পাঠিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। ১৯৯০ সালের ১৪-ই ফেব্রুয়ারি ভয়েজার-১ যখন আমাদের সৌরজগতকে বিদায় জানাচ্ছিল,তখন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল স্যাগান(Carl sagan) -এর অনুরোধে ক্যামেরা ঘুরিয়ে প্রায় ৬ বিলিয়ন(ছয়শত কৌটি) দূর থেকে কেবল পৃথিবীকে ফোকাস করে ছবি তোলা হয়। বিশাল আলোকরাশির মাঝে আমাদের পৃথিবীকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক বিন্দুর মতোই লাগছিল,আর ওখানেই আমাদের বসতি! ছবিতে গোলচিহ্নিত পৃথিবীকে দেখুন। আর এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পৃথিবী "The pale blue dot" নামে পরিচিত।
সেই বিখ্যাত জ্যোতিবিজ্ঞানী কার্ল স্যাগানের একটা অমর উক্তি হলো, "আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান"। তিনি বিভিন্ন তথ্য, ত্বত্ত্ব ও উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে,আমাদের শরীরের গাঠনিক উপাদানসমূহ নক্ষত্রের মতোই। যেহেতু নক্ষত্র থেকেই অন্যসব গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি, সেহেতু সেসবের উপর নক্ষত্র তথা সূর্যের প্রভাব সতত। পৃথিবীর বুকে আজ আমরা যে বিভিন্ন ধরনের ভারী মৌলিক পদার্থসমূহ পাই, এমনকি আমাদের দেহ যেসব পদার্থ দিয়ে তৈরি, তা সবই কোন এক নক্ষত্রের গর্ভে সুপারনোভা নামক বিস্ফোরণকালে সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের দাঁতের ক্যালসিয়াম, রক্তের লৌহ, হাড়ের গড়ন, সবকিছুর উপাদান নক্ষত্র থেকেই প্রাপ্ত। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে "আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান।"
তাহলে বলুন তো, যে নক্ষত্র থেকেই আমাদের উৎপত্তি ও বিকাশ, আমরা কি কখনও সেই নক্ষত্র ও তার গ্রহ-উপগ্রহগুলো থেকে প্রভাবমুক্ত থাকতে পারি? কখনও নয়। আমাদের বেঁচে থাকা প্রতিটি ক্ষণের উপর নক্ষত্র তো বটেই,অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলোর সুবিশাল প্রভাব রয়েছে। আর এজন্যই হিন্দুশাস্ত্রে সূর্য দেবতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে যে,"সূর্যই সকল শক্তির উৎস।" আধুনিক বিজ্ঞান সেই কথাই বলে। এজন্যই হিন্দুরা ঘুম থেকে জেগে প্রথমে সূর্যপ্রণাম করে।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। যেহেতু আগেই বলেছি যে, যেহেতু আমরা নক্ষত্রের সন্তানহেতু নক্ষত্রের প্রভাবমুক্ত নই,সেহেতু হিন্দুদের বিয়েতে শুরুতেই ঠিকুজি-কুষ্ঠি মিলিয়ে রাশি নির্ণয় করে এবং অপরাপর বিষয়গুলো যাচাই করা হয়,যাতে নির্ণয় করা হয় দম্পতির উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব কেমন হতে পারে। এখন প্রশ্ন করতে পারেন ঠিকুজি ও কুষ্ঠি কী! চলুন, জেনে নিই:
ঠিকুজি হলো জন্মের সময় অর্থাৎ যেই ক্ষণে জন্মেছে,সেই ক্ষণে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয়পূর্বক ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত জীবনী। আর কুষ্ঠি হলো সেই ঠিকুজির উপর নির্ভর করে সৃষ্ট জন্মকুণ্ডলী, যেখানে বিভিন্ন বয়সে ব্যক্তির উপর গ্রহ-নক্ষত্রের সমূহ প্রভাবের বর্ণনা থাকে।
অবাক হচ্ছেন? অবাক করা ব্যাপারই বটে! মহাবিশ্ব ঘূর্ণায়মান। ফলে আপনি যে ক্ষণে জন্মেছেন, ঠিক সেই ক্ষণ থেকেই আপনি ঘূর্ণায়মান পৃথিবীসমেত উক্ত গ্রহ-উপগ্রহ ও নক্ষত্রের সাথে একই তালে ঘুরেছেন। ফলে আপনার উপর গ্রহ-উপগ্রহ ও নক্ষত্রের নিহিত প্রভাব রয়েছে। আচ্ছা,আরেকটু স্পষ্ট করি। ধরুন,আপনার জন্মক্ষণে পৃথিবী সূর্যের নিকটবর্তী(অনুসূর) ছিলো, আর শনি ও শুক্র গ্রহও পৃথিবীর নিকটবর্তী ছিলো, সেক্ষেত্রে সূর্য ও ভয়ঙ্কর শুক্র এবং শনি গ্রহের প্রভাব সর্বদা আপনার উপর ক্রিয়াশীল হবে। আর জন্মলগ্নে পৃথিবী যদি সূর্য থেকে দুরে(অপসূর) থাকে, সেক্ষেত্রে প্রভাব হবে ভিন্ন। আবার বৃহস্পতি গ্রহের প্রভাব যদি আপনার উপর থাকে,সেক্ষেত্রে আপনার উপর শুভপ্রভাবই থাকবে। সনাতনশাস্ত্র অনুযায়ী বৃহস্পতি শুভ গ্রহ। বিজ্ঞানও বলছে, সুবিশাল বৃহস্পতি গ্রহের বায়ুমণ্ডল মহাকাশ থেকে ধেয়ে আসা গ্রহাণুগুলোকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে পৃথিবীকে রক্ষা করে।
না জেনে, অতিবিজ্ঞতায় কিংবা অজ্ঞতার কারণে অনেকেই কুষ্ঠি ও ঠিকুজি নিয়ে হাসিতামাশা ও বিদ্রুপ করেন। কিন্তু তাঁরা কখনও বুজতে পারেননি যে, ওই ঠিকুজি-কুষ্ঠির মাঝে সুপ্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রের কি নিখুঁত বিধান নিহিত আছে! ভাবুন তো একবার, আমরা কত সহজেই বলে দিতে পারি, কবে ও কখন চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ হবে; কবে ও কোন তারিখে ঈদ কিংবা পূজা হবে তা পঞ্জিকা দেখে আমরা অগ্রিম বলে দিতে পারি। কুষ্ঠি কিংবা ঠিকুজি পঞ্জিকার পূর্বানুমানের মতো শতভাগ নিঁখুত না হলেও অনেকটাই মিলে যায়। তাই আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কুষ্ঠি, ঠিকুজি কেবল বিশ্বাস করি তা নয়,বরং এমন নিখুঁত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বিশ্বাস করে গর্বিত ও বিস্মিত হই!
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................