জ্ঞানচর্চায় মুসলিমদের পতন কি অনিবার্য?
এথেন্সের জ্ঞানচর্চা বিশ্বকে দ্রুতই এগিয়ে দিয়েছিল৷ আলেকজান্দ্রিয়া কেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চাও ভূমিকা রাখছিল৷ কিন্তু রোমান সাম্রাজ্য ও খৃষ্ট ধর্মের উত্থান সব কিছু তছনছ করে দেয়৷ তারা গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক হাইপেশিয়াকে হত্যা করে শুরু করে৷ ব্রুনোকে হত্যার মধ্য দিয়ে শেষের শুরু হয় উগ্র খৃষ্টানদের তাণ্ডব৷ ইউরোপের অন্ধকার যুগের মাঝে বাগদাদ কেন্দ্রিক একটা জ্ঞানচর্চার ধারা ছিল৷ মুসলিমরা এটাকে ইসলামী স্বর্ণযুগ বলে গর্ব করে৷ ইবনে সিনা, আল রাযী, আল ফারাবী, আল বিরুনী, জাবির, আল খোয়ারিজমি, আল কিন্দি, ওমর খৈয়াম, ইবনে রুশদ এবং আরো অনেক উজ্জ্বল নাম৷ তাঁরা অনেকেই বহুমাত্রিক প্রতিভাধর৷ তারা দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, সাহিত্যসহ বহুদিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন৷ তাঁরা কখনো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন, কখনো চরম নিগৃহিত হয়েছেন৷ নিগৃহিত হওয়া চূড়ান্ত হলেই বন্ধ হয়ে যায় মুসলিমদের জ্ঞান সাধনা, যা আজও বন্ধ৷ সেই পতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। এর শেষটা এখনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
দার্শনিক আল কিন্দি বলেছিলেন, 'আল্লা জগতের স্রষ্টা কিন্তু তিনি জগতের কোন কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন না৷' তিনি ছিলেন মোতাজিলা সম্প্রদায়ের৷ পুরো মতবাদটিকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয় কট্টরপন্থীরা৷ আল ফারাবী স্রষ্টার সর্বাধিপত্য স্বীকারের পাশাপাশি সৃষ্টিকেও শাশ্বত বলে মনে করতেন৷ বলেছিলেন, 'স্রষ্টা জড় বস্তুর উৎস'৷ ইবনে সিনা বলেছেন, 'জগতের প্রতিটি বস্তুই অসম্পূর্ণ এবং এ অসম্পূর্ণ বস্তুগুলো পূর্ণতা পাওয়ার জন্য সচেষ্ট৷' এ বক্তব্য বিবর্তনবাদকেই সমর্থন করে৷ তিনিও সেই বিতর্কিত প্রশ্নটি করেছিলেন, 'তাহলে স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করেছেন?' তিনিও বহু নিপীড়নের স্বীকার হন৷ আল বিরুনী বলেছেন, 'বৃত্তিক গতিতে পৃথিবী ঘোরে৷' তিনি সূর্যগ্রহণের নকশা করেছিলেন৷ জাবির একজন আল কেমি ছিলেন৷ কেমিষ্ট্রির জনক বলা হয় তাকে৷ আল কেমি থেকেই কেমিস্ট্রি শব্দটির উৎপত্তি। আল খোয়ারিজমিকে বলা হয় এলজেবরার জনক৷ তাঁর একটি বইর নাম থেকেই নামটি এসেছে৷ তাঁরা সকলেই কখনো পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন৷ কখনো থেকেছেন মৌলবাদীদের ধাওয়ায় দৌড়ের উপর৷
ওমর খৈয়াম বিখ্যাত হয়েছেন কবি হিসেবে৷ তবে তিনিও বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী ছিলেন৷ তিনি একটি রুবাইতে লিখেছেন, 'পাপীরা যদি বেহেস্তে না যায় তবে সেটা দয়া নয়৷' ইবনে রুশদ বলেছেন, 'অজ্ঞতা থেকে ভীতি তৈরি হয়, ভীতি ঘৃণার সৃষ্টি করে আর ঘৃণা থেকে আসে হিংস্রতা৷' তিনি আরো বলেছেন, 'যে ব্যক্তির যৌক্তিকতা পৃথিবীকে যতবেশি বুঝতে সক্ষম হয়, তিনি তার কাজে কর্মে তত বেশি যৌক্তিক এবং নৈতিক হন৷' শুরুতে তিনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন৷ শেষে তাকে নাস্তিক বলেই তাড়ানো হয়৷ তাঁর সমস্ত বই পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ শেষ জীবনে আর লিখবেন না এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেশে ফিরতে পারেন৷ আরো পরে গ্যালিলিওকে দিয়েও এমনটি করিয়েছিল খ্রিষ্টান মৌলবাদীরা৷
জ্ঞানচর্চা বিনাশ করতে খ্রিষ্টান মৌলবাদীরা যে হিংস্রতা সূচনা করে তাতে আরব ও মেসোপটেমিয়ার বাইরে জ্ঞানচর্চা বন্ধ হয়ে যায়৷ মুসলিম বিশ্বে প্রথমে ইমাম গাজ্জালীর কট্টরপন্থা— চাপে থাকা প্রগতিপন্থীদের থামিয়ে দেয় এবং চেঙ্গিশ খানের হাতে বাগদাদ নগরী ধ্বংস হলে মুসলিম মৌলবাদেরই তীব্র উত্থান ঘটে৷ সমাপ্তি ঘটে মুসলিমদের জ্ঞানচর্চার। বলা যায় ধর্মীয় কট্টরপন্থাই মুসলিমদের জ্ঞানচর্চার প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল। সাম্প্রতিক সালাফি মতবাদ উগ্রপন্থীদেরই দাপুটে করে তুলেছে৷ রেনেসাঁর মাধ্যমে তবুও খ্রিষ্টানরা অন্ধকার যুগ কাটিয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য গড়ে তুলেন৷খ্রিস্টান-ইহুদীদের বলয়ে জ্ঞানের বাতি জ্বলে উঠে৷ তারা এগিয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু মুসলিম দুনিয়া এখনো মৌলবাদের অন্ধকারে নিমজ্জিত৷ জাগরণের হালকা আভাস কখনো কখনো দেখা দিলেও সেটা প্রকৃত জাগরণ ঘটাতে পারছে না৷
জ্ঞানচর্চার জন্য দরকার মুক্ত পরিবেশ। হত্যা, ঘৃণা ও ধাওয়ার মধ্যে থেকে জ্ঞানচর্চা সম্ভব হয় না। মানুষ জীবন বাঁচাবে না, জ্ঞানচর্চা করবে? যেসকল মুসলিমদের জ্ঞানচর্চা করার কথা তারা এখনো থাকছেন দৌড়ের উপর। পাকিস্তানে জ্ঞানের আধার নিয়ে এসেছিলেন আব্দুস সালাম। তাঁকে দমাতে পাকিস্তান সরকার শুরু করে আহমদিয়া বিরোধী ষড়যন্ত্র। সালাম আহমদিয়া সেটাই সমস্যা ছিল না। সালামকে দমাতেই আহমদিয়াদের অস্ত্র বানানো হয়। সালাম পাকিস্তান ছাড়তে বাধ্য হন। একজন জ্ঞানীর বিরুদ্ধে পুরো পাকিস্তানই দাঁড়িয়ে যায়। আজ যেমন মনে হচ্ছে সারা বাংলাদেশ ইউনুসের বিরুদ্ধে। ইউনুসও দারিদ্র্যতা দূরীকরণের জ্ঞান নিয়ে এসে সফল হয়েছিলেন। মুসলিম দেশগুলোতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে স্টাবলিশমেন্ট করা হয়। যেমন লিবিয়ার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, ইরানে আয়াতুল্লাহ খামেনি, পাকিস্তানে কায়েদে আযম জিন্না, বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান, সৌদী আরবে বাদশাহ আব্দুল আজিজ ইবনে সৌদ এবং আরো অসংখ্য উদাহরণ টানা যায়। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরে কোন জ্ঞানকে টিকতে দেয়া হয় না। সাধারণ মানুষও মনে করে, তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বর বাইরে আর কোন জ্ঞানীরও দরকার নেই। ইংল্যান্ডে এসব কারণেই নিউটনের বা সেক্সপিয়রের উত্থান সম্ভব হয়েছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এখন ব্যক্তিপূজাটা অনেকাংশেই কমেছে। রাজনীতিবিদদের গুরুত্বও তারা কমাতে পেরেছে। মুসলিম দেশগুলোতে রাজনৈতিক শক্তি অজেয়। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছায় নির্ভর করে কে কী বলবে? আমাদের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র স্পারসো ২০২৩ সালের দুটি কাজ খুব আলোচিত হয়েছে। তাহল তারা দুটি ধর্মীয় মিলাদ মাহফিল করেছে রাজনৈতিক পরিবারের প্রায়ত লোকদের নিয়ে। ফলে তারা গবেষণায় থাকবে না। এরপরও যারা গবেষণায় আগ্রহী তারা স্পারসো ছাড়বেন এবং শেষ পর্যন্ত দেশই ছাড়বেন।
মুসলিমরা গণতন্ত্র ও মুক্তচিন্তার বিরোধী। এটা স্বৈরতন্ত্র উত্থানে খুবই সহায়ক। এমন পরিবেশে গণতন্ত্র আরো বিপন্ন হয়ে পড়ে এবং মুক্তচিন্তার সুযোগ নস্যাৎ হয়ে যায়। এখনো যে কোন ধর্মের মানুষের চেয়ে মুসলিমরা অধিক মৌলবাদী। মৌলবাদ শক্তিশালী থাকলে জ্ঞানচর্চার পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে। বিস্ময়কর যে মুসলিম বিশ্বে তাই ঘটেছে। মৌলবাদ গণতন্ত্র ও মুক্তচিন্তাকে ধ্বংস করে দিয়ে স্বৈরতন্ত্রের জয়গান গায়। এমন অবস্থায় জ্ঞানচর্চা অসম্ভব। ফলে বলতেই হয়, মুসলিমদের জ্ঞানচর্চায় পতন অনিবার্যই ছিল। নিকট ভবিষ্যতে এমন পতন তারা রুখতেও পারবে না। ফলে এখনো জ্ঞানচর্চার কোথাও মুসলিমরা নেই, খুব সামনে তাদের জ্ঞানচর্চা করতে দেখাও যাবে না।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................