এদিকে বৈষ্ণব সাহিত্যের কৃষ্ণ ভাববাদী কাব্যরসের সৃষ্টি। যে রস থেকে “মুসলমান কবিরা” পর্যন্ত বাদ যান নাই।

শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার প্রেম কাহিনী হচ্ছে বৈষ্ণব সাহিত্যের কাহিনী। পুরোটাই কবি কল্পনা। বিশ্বাসী সনাতন ধর্মী মানুষ তাকে কি মনে করে সেটা বিষয় না। মহাভারতের কৃষ্ণ যে বৈষ্ণব সাহিত্যের কৃষ্ণ এক নয় সেটি সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকজনও খুব কম জানে। মহাভারতের কৃষ্ণ হচ্ছেন উচ্চমার্গের রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, দক্ষ কুটনৈতিক। মহাভারতের একটি চরিত্র হচ্ছে কৃষ্ণ।

এদিকে বৈষ্ণব সাহিত্যের কৃষ্ণ ভাববাদী কাব্যরসের সৃষ্টি। যে রস থেকে “মুসলমান কবিরা” পর্যন্ত বাদ যান নাই। সপ্তাদশ শতকের এইসব কবিরা কৃষ্ণ প্রেমে দিয়ানা ছিলেন। মুসলমান কবিদের লেখা বৈষ্ণব কবিতায় শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের কথা কতজন জানেন? কবি আলী রাজ যিনি বৈষ্ণব কবিতায় একটি উল্লেখ্যযোগ্য নাম। আলী রাজ তার কাব্য শুরু করেছেন এভাবে-

“যার নাম বেদশাস্ত্র অক্ষরে না ধরে।
পরম বংশীর স্বনে সে নাম নিঃসরে।।
সাহা কেয়ামদ্দিন গুরু বংশীনাদে বশ।
আলী রাজ কহে বাশী অমূল্য পরশ।“

বৈষ্ণব এইসব “মুসলমান” কবিদের মধ্যে আরো বিখ্যাত নাম হচ্ছে আকবর, লাল মামুদ, সৈয়দ মুর্তোজা, নাসির মামুদ, চম্পা গাজী, মুহাম্মদ কাসিম, আমর আলী...। সৈয়দ মুর্তোজা কাব্য শুরু করেছেন এভাবে-

“সৈয়দ মুর্তোজা ভনে কানুর চরণে
নিবেদন শুন হরি।
সকল ছাড়িয়া রহিল তুয়া পায়ে
জীবন মরণ ভরি।“

বৈষ্ণব কবিদের লেখা রাধাকৃষ্ণের এই প্রেমকাহিনী শ্রীচৈতন্যদেবের ফলে পুরো ভারতের উত্তর দক্ষিণে ‘বৈষ্ণব ধর্ম’ নামে একটি ধর্ম প্রসার লাভ করে। যে ধর্মে নেই কোন জাতিভেদ। নেই কোন ব্রাহ্মণ। প্রেমই হচ্ছে শেষকথা। রাধা এখানে জীবাত্মা, কৃষ্ণ পরমাত্মা। চৈতন্যদেবের জন্মের বহু আগে থেকে যদিও এই মাটি মানুষের কৃষ্ণ কবিদের রচনাতে জীবন্ত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের আদিরূপ চর্যাপদের পরেই যে প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন পাওয়া যায় তা বডু চন্ডীদাস রচিত “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”। বিস্ময়কর হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ও তার সঙ্গে রাজা কংসের বিবাদ এই একই কাহিনী মেসোপটেমিয়ার সভ্যতায় পাওয়া গেছে যা পরে সেমিটিক নবী মুসার আখ্যান হিসেবে ছড়িয়েছে। কংসের জায়গায় ভিলেন সেখানে মিশরের রাজা। কালিন্দি নদীতে কৃষ্ণ ভেসেছিলো ওদিকে নীলনদে মোজেস...। হুবহু একই কাহিনী। যেন সাউথ ইন্ডিয়ান মুভি বলিউডে রিমেইক হয়েছে!

বৈষ্ণব ধর্মটি পুরোটাই কবিদের সৃষ্টি। মধ্যযুগের কবিদের হাতে রাধাকৃষ্ণ প্রাণ পেয়েছেন। এ কারণেই সাহিত্যের রসে কখনো কৃষ্ণ ‘ননীচোর’, কখনো ‘কানু হারামজাদা’। সাহিত্য না বুঝে কেবল ভগবান বুঝলে এইসব শব্দে আহত হতেই পারে যে কেউ। আগের হিন্দুরা ‘কানুহারামজাদা’ গান শুনে রসে চোখ মুঁদেছে। এখন হয়ত আহত হয়। তেমনি কৃষ্ণের বিন্দাবন লীলা নিয়ে আদিরসাত্মক মশকরা করা নাস্তিকদের কৃষ্ণকে ‘ভগবান’ ধরেই করা। আমাদেরকে রাধাকৃষ্ণকে বৈষ্ণব সাহিত্য হিসেবে জানতে হবে। প্রকৃতপক্ষে এটা বৈষ্ণব সাহিত্য ছাড়া আর কিছু নয়। মহাভারতের কৃষ্ণের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। কৃষ্ণের জন্মদিন হবার কোন কারণও নেই। কাব্যের নায়কের আবার জন্মদিন কি? এই যে ভাদ্রমাসে তাল দিয়ে কৃষ্ণের জন্মতিথি পালন -এ হচ্ছে বাংলার বারো মাসে তেরো পর্বাণের অংশ। কবে কোথায় কাকে গ্রামীণ জীবনে গৃহস্ত তাল দিয়ে জন্মতিথি করেছিলো, কবে কখন বৈষ্ণব সাহিত্যের কৃষ্ণ সেখানে এসে গেলো- ইতিহাসে সব স্থান পায় না...।

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted