উর্দু ভাষার নিজস্ব কোন হরফ নেই। আরবী হরফ দিয়ে এটি লিখতে হয়। তাই উর্দু হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিচ্ছবি। মুসলমানদের যেমন নিজের বলে কিছু নেই, উর্দু ভাষারও নিজের বলে কিছু নেই।
মুঘল সৈন্য শিবিরে এর জন্ম। মূলত মুঘল সৈন্যরা স্থানীয় বাজারে সদাই করতে হিন্দি ফারসী আরবীর খিচুরি পাঁকিয়ে কেনাকাটায় ব্যবহার করত যে ভাষা- সেটাই উর্দু ভাষা। বিদেশী শাসকদের সঙ্গে স্থানীয়দের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেও দ্রুত উর্দু জনপ্রিয় হতে থাকে। এটি যখন সম্রাট শাহজাহানের সময় দরবারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয় তখন উর্দুর মর্যাদা বেড়ে যায়। উর্দু শুরু থেকে সচেতনভাবে ‘মুসলমানদের ভাষা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এর হরফ আরবী। এরমধ্যে আরবী ফারসী ভাষায় মুসলমানিত্ব পরিচয় বজায় রাখা হয়েছে। মহান কিছু কবি সাহিত্যিক উর্দু ভাষায় সাহিত্য চর্চা করলে উর্দু ভাষা হিসেবে জাতে উঠে যায়। কিন্তু শুরু থেকে আজ পর্যন্ত উর্দুকে ভারতীয় মুসলমানদের জাতীয় ভাষা মনে করা হয়।
ভারতবর্ষের মুসলমানদের অভিভাবকরা মনে করতেন উর্দু ছাড়া ভারতীয় মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যাবে। তারা সবাই নিজেদের বৈশিষ্ঠ হারিয়ে হিন্দু হয়ে যাবে। ভারতীয় ‘আর্য ভাষা’ মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দিবে না। মুসলমানরা আরব তুর্কি ইরানীদের বংশধর। তারা কেন ভারতবর্ষের ভাষায় কথা বলবে?...
আজগুবি কিছু বলছি মনে হতে পারে কি? একদম ইতিহাসের নির্জলা সত্য এগুলো। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগে বিতর্ক উঠতে শুরু করে বাংলা দেশের মুসলমানদের “মাতৃভাষা” কোনটি হওয়া উচিত? শুনতে হাস্যকর হলেও তর্ক বিতর্ক করে নিজেদের “মাতৃভাষা” ঠিক করার জন্য দুটি পক্ষ তখন দাঁড়িয়ে যায়। একদল নবাব জমিদার শ্রেণী- তারা সরাসরি মত প্রকাশ করেন ‘আশরাফ মুসলমান’ অর্থ্যাত সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের জন্য উর্দু হবে তাদের মাতৃভাষা। আর ‘আতরাফ মুসলমান’ মানে নিন্মজাতের মুসলমানদের জন্য বাংলা হবে মাতৃভাষা... তবে এখানেও কথা আছে শর্ত আছে। সেই বাংলা হতে হবে সংস্কৃত দুহিতা বাংলা থেকে পৃথক, প্রচুর আরবী ফারসী উর্দু শব্দের মিশেলে এক ‘মুসলমান-বাংলা’।
শিক্ষা কমিশনে নবাব আব্দুল লতিফ এই মত প্রকাশ করেন। তার এই মতামত দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। আরবী ফারসী উর্দু শেখা ও আয়ত্ব কষ্টকর হওয়ায় আব্দুল লতিফের মুসলমানী-বাংলা ধারণা লুফে নেয় একটি শ্রেণী। কারণ এতে হিন্দুদের বাংলা থেকে মুসলমানদের বাংলা থাকবে পৃথক, এতে জাতীয়তাবাদ নষ্ট হবে না। নিজেরা মুসলমানই থাকছেন। কারণ উর্দু ছাড়া ভারতীয় মুসলমানদের নিজস্বতা বলতে কিছু নেই সেটি তারাও সত্য বলে মানত। এই ভাষা ছাড়া মুসলমানদের যে ভাষাতেই কথা বলতে হবে তা যে ভারতের মাটিতে প্রথিত হাজার বছরের ইতিহাস। মুসলমানরা তো সেই ইতিহাসের কেউ নয়! তারা যে সেই খুরমা খেজুরের দেশ থেকে এসেছে! এটি বাংলা ভাষী মুসলমানরাও জানত। অথচ বাংলা মুখের ভাষা হওয়ায় আরবী ফারসী উর্দুতে দক্ষ হওয়া সহজ নয়। ফলে নতুন ‘মুসলমানী-বাংলা’ হওয়াতে জাতধর্মও বাঁচলো আবার অন্য ভাষায় দক্ষ হওয়ার বেকায়দা থেকেও বাঁচা গেলো।
এই ‘মুসলমানী-বাংলা’ দ্রুত জনপ্রিয় হতে লাগলো। এরকম ভাষায় উনবিংশ শতাব্দীতে সাহিত্য চর্চা শুরু হতে থাকে যাকে ‘মুসলমান বাংলা সাহিত্য’ নামে পন্ডিতরা উল্লেখ করেছেন। আপনাদের বলে রাখা ভালো, উর্দু মুসলমানদের মাতৃভাষা হওয়ার বিরোধীতাকারীদের একজনও বলেননি ‘বাঙালি মুসলমানদের’ মাতৃভাষা বাংলা হওয়া উচিত, তারা বলেছেন বাংলার মুসলমানদের মাতৃ ভাষা হওয়া উচিত বাংলা তবে সেটি হতে হবে মুসলমানী-বাংলা। লেখক সৈয়দ এমদাদ আলী লিখেছিলেন, ‘এই বঙ্গ ভাষা রূপ নতুন দুর্গের মধ্যে নিরাপদে আমরা আমাদের জন্য স্বতন্ত্র স্থান করিয়া লইতে পারি এবং তাহা করাই আমাদের পক্ষে একান্ত কর্তব্য। নতুবা হিন্দু ভাব, হিন্দু আদর্শপূর্ণ সাহিত্যপাঠে মুসলমান সমাজ ক্রমে ক্রমে নিজেদের বিশেষত্ব বর্জিত হইয়া এক অদ্ভূত মূর্তি পরিগ্রহ করিবে...’
এই হচ্ছে উর্দুর বদলে বাংলাকে মাতৃভাষা করার পক্ষের একজন বুদ্ধিজীবীর মতামত। এটি কোন স্বতন্ত্র মতামত নয়। তখনকার সকলের মতামত ছিলো এটিই। তারা এসব লেখা যেসব কাগজে প্রকাশ করেছিলেন সেসব বাংলা কাগজের নামগুলোও সব উর্দু, ফারসী, আরবীতে রাখা। পাকিস্তান আমলেও উর্দুর বদলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে আদাজল খেয়ে লেগে থেকে যেসব পত্রিকা লড়াই করেছিলো তাদের নামগুলোও আরবী ফারসী না হয় উর্দু! ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কোনভাবেই বাংলা ভাষার প্রেম ছিলো না। এটি ছিলো উর্দুতে বাংলাভাষী মুসলমানদের চির অপটুতা। এর ফলে তারা উর্দুভাষী আশরাফ মুসলমানদের থেকে পিছিয়ে পড়বে। তাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। সেইকালে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প সাহিত্যের নামকরণ সবই সেই ‘মুসলমানী-ভাষাতে’ চলছিলো। সাহিত্যে আরবি উর্দু ফারসি চলছিলো। যদিও ষাটের দশকে একদমই আত্মসচেতন একদল সাহিত্যিকদের উদয় হয়েছিলো যারা বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের সংকটটি দেখাতে শুরু করলেন। সে অন্য প্রসঙ্গ...।
তো এই হচ্ছে বিষয়। সত্যের মত তিতা, বদমাশ, নগ্নতা বোধহয় আর কিছুতেই নেই। তাই এটা বললে হজম হবে না অনেকেরই। মুসলমানিত্ব ও বাঙালিত্ব একসঙ্গে কোনদিন যায়নি যাবেও না। তাই ‘বাঙালি মুসলমান’ বা ‘মুসলমান বাঙালি’ দুটিই কাঁঠালের আমসত্ত্ব! তাদেরকে বড়জোর বলা চলে “বাংলা ভাষী মুসলমান”! তাও সেটা “মুসলমানী-বাংলা” ভাষা!
©সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................