-চৈতন্য মহাপ্রভু, আপনাকে কৃতজ্ঞতা আমাকে সময় দেয়ার জন্য।
-ধন্যবাদ।
-আমি আপনার অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে কথা বলবো আপনি আশা করি আন্দাজ করেছেন। তবে আমি আপনার দার্শনিক পরিচয়টি নিয়েও কথা বলতে চাই।
-ঠিক আছে বলো।
-দার্শনিক রোমা রোলাঁ আপনি মৃগী রোগে মারা গিয়েছিলেন বলে মত দিয়েছিলেন। কারণ আপনি শেষ দিকে দেয়ালে মুখ ঘষতেন। এতে তার এই সন্দেহ হয়েছিলো। একদম শেষের দিকে আপনার ঘনিষ্ঠজনরা আপনার মধ্যে একটা উন্মাদনাও দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু আপনার মৃত্যু যে স্বাভাবিক ছিলো না সেটি গবেষকরা বের করে দেখিয়েছিলেন। তবু কেন অন্তর্ধান রহস্য বলতে হয় আমাদের?
-কারণ আমার কোন লাশ পাওয়া যায়নি। ঐতিহাসিক নিহাররঞ্জন রায় এ কারণেই বলেছিলেন, আমার লাশ পাওয়া না যাওয়ায় তিনটি কিংবদন্তি তৈরি করতে হয়েছিলো।
-আপনার জন্ম ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র ৪৭ বছরের জীবন। ড. দীনেশচন্দ্র সেন তার 'বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য' বইয়ে বলেছেন, আপনি মনুষ্যত্বের বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। এবং বাংলায় আপনার মতো দার্শনিক তুলনারহিত বলে মন্তব্য করেছেন। দীনেশচন্দ্র সেন তার 'চৈতন্য এন্ড হিজ এজ' বইতে তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আপনাকে জগন্নাথের মন্দিরের পাণ্ডারা খুন করে লাশ গুম করে দিয়েছিলো।
-বলে যাও...
-৪৭ বছর বয়সে জগন্নাথের মন্দিরে গান গাইতে গাইতে প্রবেশ করে আর ফেরেননি। বিকেল চারটার সময় আপনি মন্দিরে প্রবেশ করেন। দীনেশচন্দ্র সেন গবেষণা করে দেখিয়েছেন, সেদিন পুরীর মন্দিরের দরজা সাধারণ্যের জন্য রাত্রি এগারোটার পর খোলা হয়। এই সময়ের মধ্যে আপনার লাশ পুঁতে ফেলে মেঝে নতুন করে মেরামত করা হয়। ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায় 'কাঁহা গেলে তোমা পাই' বইটি উড়িয়া ভাষা শিখে লিখেছিলেন আপনার অন্তর্ধান রহস্য বের করতে। দ্বিতীয় খণ্ডে সেই রহস্য ভেদ করা হবে ঘোষণার পর ১৯৯৫ সালে ১৭ এপ্রিল ড. জয়দেবকে খুন করা হয়! ফলে দ্বিতীয় বইটি আর লেখা হয়নি। জয়দেবের কাছে প্রচুর তথ্য প্রমাণ ছিলো। ড. নিহাররঞ্জন রায় বলেছেন, এই বয়সে খুন হবার কোন ইচ্ছা নেই, তাই বলতে পারবো না তাকে ঠিক কোথায় খুন করা হয়েছিলো। তবে সেটা পুরীতেই ঘটেছিলো।
-শোনো, কলিঙ্গের রাজা প্রতাপরুদ্র আমার এমন ভক্ত হয়ে যায় যে পুরীর পাণ্ডাদের প্রভাব কমে যায়। জগন্নাথের রথ টানার অধিকার আমি রাজাকে বলিয়ে কথাকথিত ছোটজাতের মানুষদের ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। এতে পাণ্ডারা তাদের ব্যবসায়ী লোকশান অনুভব করে। হিন্দুদের মধ্যে কোন জাতপাত থাকতো না আমি যদি আর দশটি বছর বাঁচতে পারতাম। কিন্তু সেটি হয়নি।
-বর্তমান রাজনৈতিক হিন্দু অর্থাৎ যারা হিন্দুত্ববাদী তারা আপনাকে হিন্দুদের আর্দশ মানতে রাজি নয়। কারণ আপনার প্রভাবেই নাকি রাজা প্রতাপরুদ্র অতিমাত্রায় কৃষ্ণপ্রেমে অহিংস দর্শন গ্রহণ করে মুসলমানদের কাছে দুর্বল হয়ে পড়ে। আপনার সর্বমানব প্রেমই নাকি হিন্দুদের ক্ষতি করেছে।
-তারা কি জানে নদীয়াতে কীর্তন নিষিদ্ধ করেছিলো সুলতানি আমলে? মুসলমান কাজির লোকেরা কীর্তনকারীদের ধরে ধরে টিকি কেটে দিচ্ছিলো, বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলছিলো। শুনে আমি নিশ্চুপ থাকিনি। ক্ষোভে ফুঁসে উঠি। ডাক দিই প্রতিবাদী কীর্তনের। আমার ডাকে সেই প্রতিবাদী কীর্তনে মশাল হাতে সবাই এলো। সেখানে ছিলো না কোন ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় শূদ্র ভেদাভেদ। তিনশো বছরের মুসলিম শাসনে এটিই ছিলো বাঙালির প্রথম প্রতিবাদ তার ধর্ম পালনের স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু তোমাদের ইতিহাস এই বিষয়টি কেন চোখে দেখলো না? কাজি ভয়ে পালিয়েছিলো জনতাকে দেখে। অথচ সেটি ছিলো অহিংস একটি কীর্তনের মিছিল। কণ্ঠে ছিলো কেবল প্রেমের জপ। তাতেই অত্যাচারী ভয়ে পালিয়েছিলো...
-তবু আপনার চ্যালাদের জন্য নদীয়া টেকা কঠিন হয়ে পড়ে। একদিকে শাসক মুসলমান, অন্যদিকে কায়েমি ব্রাহ্মণ সমাজ।
-হ্যাঁ তাই। মুসলমান প্রশাসক একদিকে। অন্যদিকে হিন্দু সমাজের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া ব্রাহ্মণরা। কাজি কীর্তনের অনুমতি দিতে বাধ্য হওয়ার পর আমি গ্রাম পরিদর্শনে বের হই। তারপর জল গ্রহণ করি একঘরে করে রাখা শ্রীধরের বাড়িতে। এতে ব্রাহ্মণরা নাখোশ হয়। আমি শাস্ত্র মানি না। জাত বেজাত মানি না...
-পুরীর পাণ্ডাদের আপনি খেপিয়ে তুলেছিলেন ঠিক এভাবেই নিজের অজান্তেই...আপনাকে মুসলমানদের গুপ্তচর বলতো ব্রাহ্মণরা...
-হাঃ হাঃ হাঃ... শোনো, উড়িষ্যা ছিলো হিন্দু রাজ্য। এদিকে বাংলার মুসলিম সুলতানদের নজর ছিলো উড়িষ্যা দখলের। আমি পুরী যেতে চাইলে ভক্তরা বাধা দেয় কারণ পথে তখন দুই পক্ষের সৈন্যরা পথচারীদের সন্দেহবশে হত্যা করছিলো। আমি অনড় থাকি আমার সিদ্ধান্তে। তিনজন শিষ্যকে নিয়ে রওনা দিই। পথে আমার একজন ভক্ত রামচন্দ্র যে হোসেন শাহের কর্মচারী ছিলো তার বাড়িতে আতিথ্য নিই। এদিকে আমি যখন পুরীতে যাই তখন হোসেন শাহের হাতে পুরী আক্রান্ত হয় এবং মন্দিরের দেবমূর্তিতে ভাংচুর চালানো হয়। ফলে আমাকে যারা শত্রু মনে করতো তারা রটনা করতে থাকে।
-মুসলিম শাসনে কেমন ছিলো বাংলা? সাম্প্রদায়িকতা...
-দেখো, শাসক ছিলো বিদেশি এটা তো সত্য। তারা এই দেশের জল হাওয়ার মানুষ ছিলেন না। তবু এই দেশকে কেউ ভালোও বেসেছিলো। তাদের কেউ মূর্তিপূজাকে ঘৃণা করত। কেউ হিন্দুদেরই অপছন্দ করতো। আবার কেউ ছিলো উদার। আমার আন্দোলন ছিলো সব রকম প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে। ফলে কাজি ও ব্রাহ্মণ উভয়েই খেপেছিলো...
-খুবই কুটনৈতিক উত্তর হলো...। যাই হোক, আপনি বাংলা সাহিত্যকে এমন একটা বেগবান ধারায় এগিয়ে নিলেন যে একশো বছর এগিয়ে গেলো কাব্য সাহিত্য। আপনি মানে বৈষ্ণব সাহিত্য, আপনাকে নিয়ে চৈতন্যমঙ্গল, এমনটা আর কাউকে নিয়ে দেখা যায়নি। যে প্রেমের বাণীর জন্য আপনার এরকম জনপ্রিয়তা, সেই বাংলা কেন ধর্মীয় কারণে ভাগ হলো?
-তোমার প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর আছে। তোমরা দেখতে পাও না। ধর্ম আর রাজনীতি নিয়ে মাতো। কিন্তু সেখানে কোন দর্শন নেই। সব শূন্য! গত একশো বছরের রাজনীতিতে দেখাও তো কী তোমাদের দর্শন ছিলো?... হিন্দু মুসলমান সবাই বৈষ্ণব হও! এটাকে ধর্ম না করে দর্শন করো। এটা এই মাটির দর্শন। তবেই মিল হবে। ঐক্য হবে। ধর্মকে দর্শন বানাও। পরকাল নয় ইহকালের জন্য দরকার দর্শন। না হলে কোন মুক্তি নেই...। পরকাল ধর্ম কিচ্ছু নেই সুষুপ্ত। পুরীর ভেতরটা তদন্ত করলে আমার কঙ্কাল পাওয়া যাবে। আমি মানুষ ছিলাম। একটা দর্শন ছয়শো বছর আগে প্রচার করেছিলাম। সে দর্শন কেবল হিন্দু নয় মুসলমানের বুকেও দোলা দিয়েছিলো। বহু সুফিরা বৈষ্ণবদের থেকে দর্শন গ্রহণ করেছিলো। সুফিবাদের যেটাকে নিয়ে এখন শান্তিবাদী দাবী করা হয়- সেটুকু এই দেশের নিজস্বতা। সুফিদের নৃত্য আর বাদ্য কোথা থেকে এলো? এসব তো ইসলামে নিষিদ্ধ?... এটা বাইরে থেকে আসেনি। বাইরে থেকে আসা সুফিরা যে চিঠিপত্র লিখে গেছে তা থেকে তফাতটা বুঝতে পারবে...।... মানুষকে ভালোবাসতে বলো সুষুপ্ত। মানবপ্রেম ছাড়া মুক্তি নেই...
-আপনাকে অনেক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা...।
-তোমার জন্যও অনেক ভালোবাসা...
[সূত্র: চৈতন্যদেব, মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল, পত্রভারতী প্রকাশনী/ শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য, যুধিষ্ঠির জানা/কাঁহা গেলে তোমা পাই, ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়]
©সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................