বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা, ধর্ষণ ও এক কোটি মানুষের শরণার্থী হওয়ার ঘটনায় ফিলিস্তিনি জনগণ কি বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলো? ‘স্টপ জেনোসাইড’ লিখে কোন ফিলিস্তিনি কি প্রতিবাদ করেছিলো পাকিস্তানের গণহত্যাকে?
উত্তর হচ্ছে, ফিলিস্তিনি জনগণ ও তাদের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে। ফিলিস্তিনের আরব জাতীয়তাবাদ ও ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন গ্রুপের নেতা মোহাম্মদ আমিন আল হুসাইনি বিবৃতি দেন, ফিলিস্তিনির মুক্তির জন্য মুসলিম দেশগুলির ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরী আর তার জন্য পাকিস্তানের অখন্ডতা কাম্য।
খুবই স্বাভাবিক যে মুসলমানদের মধ্যে চিরকাল ‘মুসলিম ভ্রাতৃত্ব’ রাজনীতিতে এসেছে, আসবে। ফলে ফিলিস্তিনিরা পাকিস্তানের সমর্থন করেছিলো। কিন্তু সেই একাত্তর সালে ইজরায়েলের সাধারণ জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের গণহত্যার সমালোচনা করেছে। ইজরায়েল সরকার দুবার, এপ্রিল ১৯৭১, ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলো। ইজরায়েল বাংলাদেশকে একটা অস্ত্রের চালান, কলেরার টিকা দিতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধের সরকার সেটা নিতে অস্বীকার করে। ফলে ইজরায়েল সেগুলো ভারতকে দিলে ভারত সেগুলো মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণ করে। শরণার্থী শিবিরে কলেরা দেখা দিলে ইজরায়েলের কলেরা টিকা প্রয়োগ করা হয়।
আমরা তো সব কিছু মধ্যে আমেরিকার হাত দেখতে পাই। এবার আসুন কমিউনিস্টদের কিছু ডান হাত বাম দেখে নেই। ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার সময় এই দেশটিকে প্রথম যে স্বীকৃতি দেয় তার নাম সোভিয়েত ইউনিয়ন! প্রথম দিকে ইজরায়েল সোভেয়েত ঘেঁষাই ছিলো। পরে আমেরিকার বলয়ে চলে গেলে সোভিয়েত ঘোর ইজরায়েল বিরোধী হয়ে যায় এবং পিএলও অর্থ্যাত ইয়াসির আরাফাতকে তৈরি করে কেজিবি! তৈরি করেছে মানে অর্থ অস্ত্র দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া তাকে পৃষ্টপোষকতা করে গেছে। ইজরায়েল রাষ্ট্র ও ফিলিস্তিন রাষ্ট- দুটিরই স্বীকৃতি দাতা সোভিয়েত রাশিয়া!
ফিলিস্তিন বাংলাদেশে পক্ষে ছিলো নাকি বিপক্ষে- এটা নিয়ে এত কেন রাখঢাক? কারণ ঘটনাগুলো ঘটেছে আনঅফিসিয়ালি। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের তো সে অর্থে কোন কাগুজে অবস্থান তখনো ছিলো না। ফিলিস্তিনের জনগণের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ইয়াসির আরাফাত যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিলেন সেটি দিনের আলোর মত পরিস্কার। তবে সেটি বাংলাদেশকে সমর্থন করে নয়। ঘটনা হচ্ছে, ফিলিস্তিন জর্ডান যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিলো সেসময়। যুদ্ধে ২৫ হাজার ফিলিস্তিনি মারা গেছে এটা বোধহয় এখনকার পাঠকদের অনেকেই জানেন না। দুই ‘মুসলিম ভাইয়ের’ এই যুদ্ধে পাকিস্তান জর্ডানের পক্ষ নিয়ে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলো। ফলে ইয়াসির আরাফাত সে ঘটনায় পাকিস্তানের প্রতি নাখোশ ছিলো। কিন্তু পুরো আরব বিশ্ব তো বাংলাদেশের জন্মের বিরুদ্ধে। ইয়াসির আরাফাতের বাংলাদেশের পক্ষে একটি বিবৃতি কোথাও থেকে কেউ দেখাতে পারেনি। বরং ১৯৭৩ সালে মুজিব সরকার আরব ইজরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে মেডিকেল টিম ও ত্রাণ পাঠালে আরব মুসলিম দেশগুলির বাংলাদেশ সম্পর্কে নমনীয় হবার লক্ষণ দেখা যায়। যার ফলে সৌদি আরব পাকিস্তানকে ওআইসির সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ করার কথা বলে। এই সৌদি আরব যে ঢাকার গণহত্যাকে ‘জিহাদ-ই ফি সাবিলিল্লাহ’ বা ধর্মরক্ষার যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছিলো। এখান থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, ৭৩ সালের আগে আরব বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান কতখানি নাজুক ছিলো। সেখানে ইয়াসির আরাফাত কি করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একা সমর্থন জানাবে? পুরো আরব বিশ্বে ফিলিস্তিন ইজরায়েল বিরোধকে ইহুদী মুসলমান দ্বন্দ্ব মনে করা হয়। পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন মুসলিম মিল্লাতের প্রতি সমর্থন মনে করা হয়। যে ফিলিস্তিনের জন্য বাংলাদেশের জনগণ কেঁদে বুক ভাসায় তারা একাত্তরে পাকিস্তানের অখন্ডতার জন্য পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিলো। এই বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মুসলিম লীগারদের বক্তব্য পাওয়া যায় না।
এখানে একটা কথা না বলে পারছি না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থীদের ৯৫ ভাগই ছিলো হিন্দু। গণহত্যার যত লিস্ট আছে তাতে হিন্দু জেনোসাইড ছিলো একমাত্র লক্ষ্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যারা তারাও মুসলিম লীগের ঔরসজাত এটা ভুলে গেলে চলবে না। ফলে আলাদা করে ‘হিন্দু জেনোসাইড’ তারা স্বীকৃতি দেয়নি। সাধারণভাবে একটা কথা প্রচলিত ছিলো, পাকিস্তানীরা মুসলমানদের কোন সমস্যা করেনি। তারা হিন্দুদের ধরতে এসেছিলো আর যারা আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদের সমর্থক ছিলো তাদের ধরত। আরব বিশ্বের কাছেও এই সংবাদ ছিলো। তাহলে ফিলিস্তিনি বা আন্তর্জাতিক মুসলিম লীগের কেন মানবতাবাদ আসতে যাবে? এই যে লিবিয়া, আরবের সমাজতান্ত্রিক গাদ্দাফি- এই লোক বাংলাদেশের গণহত্যা দেখেও তাই পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন নির্দ্বিধায়? মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার বিরোধীতাকে এখন খুব বড় করে দেখানো হয়- কিন্তু মিশর, সিরিয়া, সৌদি আরব, লিবিয়া, ইরাক, ইরানের বিরোধীতা বেমালুম চেপে যায় কেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন? যে আহমদ ছফা কথায় কথায় ‘বাল ফেলতে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম’ বলতেন সেই তিনি এই গাদ্দাফির পয়সা খেয়ে ইসলামী সমাজতন্ত্র প্রচার করেছিলেন!
বাংলাদেশের অভিনেত্রী বাঁধন ভারতের একটি হিন্দি ওয়েব সিরিজে অভিনয় করে খুব নাম করেছেন। কিন্তু সেই সিরিজে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এমন কিছু দেখানো হয়েছে সেটা দেখে মডারেট মুসলিম লীগার আবদুর নুন তুষার ফেইসবুকে লিখেছেন, ভারত এই সিনেমায় বাংলাদেশকে বেঈমান হিসেবে তুলে ধরে বাংলাদেশকে হেয় করেছে।...
আরে তুষার, বাংলাদেশ বেঈমান নয়? যে ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য গোটা বিশ্ব চষে ফেললো তার জন্য একটি স্মৃতি স্মরণী কি বানিয়েছেন? যে ভারতীয় সৈন্যরা এদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিলো তাদের সন্মান জানিয়ে কোন স্মৃতিসৌধ করেছেন? এগুলো বেঈমানী নয়? ইজরায়েলের অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করে, তাদের ঔষধ খেয়ে কলেরা থেকে বেঁচে তাদেরই বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ফিলিস্তিনিদের ঔষধ পাঠানো বেঈমানী নয়? ফিলিস্তিনিরা কেন বাংলাদেশের সমর্থন করেনি তার একটি যৌক্তিক কারণ অন্তত ব্যাখ্যা করে যান দেখি...
আ মলো! বারবার একই ভুল করি! গণহত্যা বলো আর দেশান্তরীন, তার সিংহভাগই তো হিন্দুরা সয়েছে। তুষারদের তো এ কারণেই মুসলিম উম্মার প্রেমে ভাটা পড়েনি! বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার মাত্র আড়াই বছরের মাথায় কী করে পাকিস্তানের ফ্যান হতে পেরেছিলো এটাই তার কারণ!
©সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................