স্বর্ণযুগ কি আরবের না ইসলামের?
ইসলামি স্বর্ণযুগ নিয়ে অনেকের হাহাকার দেখি৷ এ নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই৷ তারা ধরেই নেয় স্বর্ণযুগের বিজ্ঞানি ও দার্শনিকগণ মক্কা-মদিনা কেন্দ্রিক পবিত্র মরুভূমির সন্তান৷ বাস্তবিক তা নয়৷ খ্যাতিমানদের জন্মস্থান দেখলে বিস্মিত হতে হয়—
১) ইবনে সিনা- দার্শনিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানি, জন্ম- বোখারা, উজবেকিস্তান
২) আল-খারেজমি- জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ, জন্ম- খোরাসান, উজবেকিস্তান
৩) আল-বেরনি- গণিতজ্ঞ ও জ্যোতি-পদার্থবিদ, জন্ম- খোরাসান, উজবেকিস্তান
৪) ইবনে খালদুন- সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ, জন্ম- তিউনিস, তিউনেশিয়া
৫) আল-ফারাবি- বিজ্ঞানী ও সংগীতজ্ঞ, জন্ম- ফারাব, আফগানিস্তান
৬) আল রাজি- চিকিৎসক ও বিজ্ঞানি, জন্ম- তেহরান, ইরান
৭) আল-কিন্দি- দার্শনিক ও বিজ্ঞানী, জন্ম- আল কুফা, ইরাক
৮) ইবনে রুশদ- দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ, জন্ম- কর্ডোভা, স্পেন
৯) জাবির ইবনে হায়য়ান- রসায়নবিদ ও জ্যোতির্বিদ, জন্ম- তুস, ইরান
১০) ওমর খৈয়াম- কবি ও দার্শনিক, জন্ম- নিশাপুর, ইরান
অর্থাৎ তারা কেউই পশ্চিম এশিয়ার আরব থেকে আসেনি৷ ওই সময়ের শ্রেষ্ঠ নগরী বাগদাদে তারা সমবেত হয়েছিল দূরদূরান্ত থেকেই৷ তাদের সকলে মুসলিমও ছিলেন না৷ এমনকি তাদের গবেষণাও ধর্ম সংশ্লিষ্ট নয়৷
আরো অনেক নাম৷ তাঁরা অনেকেই বহুমাত্রিক প্রতিভাধর৷ তারা দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থ, গণিত, সাহিত্যসহ বহুদিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন৷ আমরা আজও তাদের নিয়ে গর্ববোধ করি৷ সারা পৃথিবীও শ্রদ্ধা জানায়৷ তাঁরা কখনো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন, কখনো চরম নিগৃহিত হয়েছেন৷ কিন্তু জ্ঞান অন্বেষণ থামাননি৷
ওই সময় আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক এবং চিন্তার স্বাধীনতা দেখি৷ তাদের চিন্তা ইসলাম ধর্মের বিপক্ষেও গিয়েছে প্রয়াশই৷ দার্শনিক আল কিন্দি বলেছিলেন, 'আল্লা জগতের স্রষ্টা কিন্তু তিনি জগতের কোন কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন না৷' তিনি ছিলেন মোতাজিলা সম্প্রদায়ের৷ পুরো মতবাদটিকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়৷ আল ফারাবী স্রষ্টার সর্বাধিপত্য স্বীকারের পাশাপাশি সৃষ্টিকেও শাশ্বত বলে মনে করতেন৷ বলেছিলেন, স্রষ্টা জড় বস্তুর উৎস৷ ইবনে সিনা বলেছেন, 'জগতের প্রতিটি বস্তুই অসম্পূর্ণ এবং এ অসম্পূর্ণ বস্তুগুলো পূর্ণতা পাওয়ার জন্য সচেষ্ট৷' এ বক্তব্য বিবর্তনবাদকেই সমর্থন করে৷ তিনিও সে বিতর্কিত প্রশ্নটি করেছিলেন, 'তাহলে স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করেছেন?' তিনিও বহু নিপীড়নের স্বীকার হন৷ আল বেরুনী বলেছেন, 'বৃত্তিক গতিতে পৃথিবী ঘোরে৷' সূর্যগ্রহণের নকশা করেছিলেন৷ জাবির একজন আল কেমি ছিলেন৷ কেমিষ্ট্রির জনক বলা হয় তাকে৷ আল খোয়ারিজমিকে বলা হয় এলজেবরার জনক৷ তাঁর একটি বইর নাম থেকেই নামটি এসেছে৷ তাঁরা সকলেই কখনো পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন৷ কখনো থেকেছেন দৌড়ের উপর৷
ওমর খৈয়াম বিখ্যাত হয়েছেন কবি হিসেবে৷ তবে তিনিও বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী ছিলেন৷ তিনি একটি রুবাইতে লিখেছেন, 'পাপীরা যদি বেহেস্তে না যায় তবে সেটা দয়া নয়৷' ইবনে রুশদ বলেছেন, 'অজ্ঞতা থেকে ভীতি তৈরি হয়, ভীতি ঘৃণার সৃষ্টি করে আর ঘৃণা থেকে আসে হিংস্রতা৷' তিনি আরো বলেছেন, 'যে ব্যক্তির যৌক্তিকতা পৃথিবীকে যতবেশি বুঝতে সক্ষম হয়, তিনি তার কাজে কর্মে তত বেশি যৌক্তিক এবং নৈতিক হন৷' শুরুতে তিনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন৷ শেষে তাকে নাস্তিক বলেই তাড়ানো হয়৷ তাঁর সমস্ত বই পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ শেষ জীবনে আর লিখবেন না এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেশে ফিরতে পারেন৷ জ্ঞানচর্চাকারী অনেকেরই ইসলামি ধর্মবিশ্বাস ছিল না৷ ধর্ম চেপে বসলে জ্ঞানের দমবন্ধ হয়ে ওঠে৷
আমরা হালাকু খানকে দায়ী করি ইসলামি স্বর্ণযুগকে ধ্বংস করার জন্য। বাস্তবিক তার আগেই ইসলামি স্বর্ণযুগের ধ্বংস শুরু হয়ে যায়। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ জয়েল মার্কারের মতে, আল গাজালি ছিলেন ইসলামী বিজ্ঞান ধ্বংসের মূল হোতা। অনেকে ইসলামী বিজ্ঞানের পতনের জন্য, একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে সুন্নি পুনরুজ্জীবনকে দায়ী করেন। তারা বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের সৃষ্টি করেন যা বৈজ্ঞানিক কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। মাদ্রাসা বিস্তার এবং ধর্মীয় নেতাদের বিপুল প্রভাব তৈরি হয়৷ ধর্মীয় জ্ঞান আরও লাভজনক হয়ে ওঠে। কেউ কেউ বলেন যে, সৃজনশীল চিন্তার অভাবে স্বর্ণযুগ শেষ হয়৷ বিজ্ঞানকে সবসময় ধর্মীয় যুক্তি থেকে আলাদা রাখতে হয়— এর ব্যত্যয় প্রকট হলে জ্ঞান স্তব্ধ হবেই। বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক এবং চিন্তার স্বাধীনতার প্রতি সহনশীলতার অভাব প্রকট হয়ে উঠে৷ ক্রসেডও ভূমিকা রাখে৷ বলা যায় ধর্মীয় প্রভাব বৃদ্ধির সাথেই পতন ঘটে অধর্মীয় স্বর্ণযুগের৷ এটা আরবের বা ইসলামের ছিল না৷ ধর্মান্ধতা আর জ্ঞানচর্চাতো একসাথে চলে না৷ এটা মুসলিমরা আজো বুঝতে পারছে না৷
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................