বিসর্জন কেন গুরুত্বপূর্ণ?
যে জন্ম নিয়েছে, তার মৃত্যু অনিবার্য। ঠিক তেমনি যাকে আবাহন (আমন্ত্রণ) করা হয়, তার বিসর্জনও অনিবার্য। বিসর্জনের মাধ্যমেই পুনরায় আগমনের আশা সঞ্চারিত হয়। এই কারণেই প্রতি বছর হৃদয়স্থ ঈশ্বরকে মাটির প্রতিমা রুপে গড়ে তাকে বাহ্যিক ভাবে পূজা করা হয় এবং পূজা শেষে বিসর্জনের মাধ্যমে তাকে আবার হৃদয়ে স্থানান্তরিত করা হয়। ফলে শচীন কর্তা যখন বলছেন:
'বিসর্জনের ব্যাথা ভোলায় আগমনের খুশিতে'
এই আগমন পরের বছরের প্রস্তুতি অর্থে আগমন নয়। এই আগমন হচ্ছে ব্যক্তির হৃদয়ে দেবীর ফিরে আসার আগমন!
ভারতীয় দর্শনশাস্ত্র মনে করে, মানুষের দেহ পাঁচটি উপাদান দিয়ে তৈরি। আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও মাটি। তাই মৃত্যুর পর এই দেহ আগুনে দাহ করা হয় অথবা মাটি দেওয়া হয়। যে উপাদান দিয়ে এই দেহ তৈরি, মৃত্যুর পর আবার সেই একই উপাদানে মিশে যায় দেহ।
সর্বেশ্বরবাদীদের মতে ঈশ্বর সর্বত্রই বিরাজমান। প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই চেতনা রুপে ঈশ্বর বিরাজমান আছেন। পঞ্চ ভূতে (উপাদানে) গড়া এই মানব দেহের প্রতীকী হিসেবেই পূজার সময় প্রতিমা তৈরি করা হয় মাটি দিয়ে। মন্ত্রে বলা হয়:
"যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমোঃ নমঃ"
এই মন্ত্রের অর্থ হচ্ছে, 'যে দেবী সকল ভূতে* মাতৃরূপে অবস্থিত, তাকে নমস্কার'।
এই ভূত পদার্থ আছে পাঁচটি। যথা: আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও মাটি। এবারে ভারতীয় দর্শনশাস্ত্র মনে করে এই বিশ্বজগত পাঁচ ভূত পদার্থ দিয়েই নির্মিত, আবার আমরা আগেই আলাপ করেছি মানব দেহও একই পাঁচ ভূত পদার্থ দিয়ে নির্মিত।
যেই ভূত পদার্থ দিয়ে জগতের নির্মাণ সেই ভূত পদার্থ দিয়েই দেবী প্রতিমাকেও নির্মাণ করা হয়। মাটির দেবী মূলত গোটা বিশ্বজগতেরই একটা প্রতিবম্ব।
এবার দেবী মূর্তি নির্মাণের পর সেই মাটির প্রতিমায় মন্ত্রপাঠ করে চেতনা প্রতিষ্ঠা করে তাকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করা হয়। এই পূজার সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে বিসর্জন।
পঞ্চভূতের এক ভূত জলের মাধ্যমেই যেন মাটির প্রতিমা পুনরায় প্রকৃতিতে মিশে যায়, সেই জন্যই জলে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়।
মানুষের হৃদয়ে যে নিরাকার ঈশ্বরের বসবাস, উপসনার নিমিত্তে মাটির প্রতিমা তৈরি করে তাকে সাকার রূপ দেওয়া হয়। পূজা শেষে পুনরায় সেই সাকার রূপকে বিসর্জন দিয়ে নিরাকার ঈশ্বরকে হৃদয়ে স্থান দেওয়া হয়।
এই কারণেই দুর্গা পূজার সময় যখন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় তখন মায়ের প্রতি সবার প্রার্থনা থাকে, “মা, তুমি আবার এসো আমাদের মাঝে। এই একটি বছর তুমি থাকবে আমাদের হৃদয়ে। আবার, বছর পরে তোমার প্রতিমা গড়ে আমরা সাড়ম্বরে তোমার পূজা করবো।”
নাড়ীজাত সন্তানের প্রতি নাড়ীর স্পন্দনে মা'য়ের অস্তিত্বই প্রতিফলিত হয়। সুতরাং বিসর্জন মানে চলে যাওয়া নয়, বরং সাকারের বিসর্জন মানে নিরাকারের প্রতিষ্ঠার সূচনা। অর্থাৎ মা'কে বিসর্জন দিয়ে পূজারী নিজের ভেতরে মা'কে প্রতিষ্ঠা করেন। মা অন্তরে প্রতিষ্ঠিত থাকেন দিবানিশিই। রবি ঠাকুর তাই দায়িত্ব নিয়ে লিখছেন:
'আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল
দেবলোক থেকে মানবলোকে,
আকাশে জ্যোতির্ময় পুরুষে
আর মনের মানুষে আমার অন্তরতম আনন্দে।'
সেই অন্তরের মনের মানুষের অস্তিত্ব বান্দা টের পায় কি-না সেটাই এখন দেখবার বিষয়।
শুভ বিজয়া!
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................