কেউ ভাগ্য নিয়ে জন্মায় না। ভাগ্য লিখন বলতে কিচ্ছু নেই।

কেউ ভাগ্য নিয়ে জন্মায় না। ভাগ্য লিখন বলতে কিচ্ছু নেই। তবে মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক পরিবেশ, ধর্মীয় পরিবেশ দ্বারা ‘দুর্ভাগ্যের’ শিকার হয়। যেমন আজকে আফগানিস্থানের যে মুসলিম ঘরে কন্যা সন্তানটি জন্মালো সে আর ভারতের একটি মুসলিম ঘরে যে কন্যা সন্তানটি জন্মালো তারা দুজনই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে যথাক্রমে দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্যের শিকার হয়েছে। বর্তমান আফগানিস্থানে মেয়েদের লেখাপড়াসহ সমস্ত রকম অধিকার রদ করা হয়েছে। নয়-দশ বছর বয়সে শরীয়া অনুযায়ী তাদের কোন পুরুষের একাধিক স্ত্রীর একজন হয়ে বাকী জীবন দাসীবাঁদীর মত করে কাটাতে হবে। পক্ষান্তরে ভারতে জন্মানো মেয়েটির লেখাপড়া শেখায় কোন বাঁধা নেই। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বিয়ে না দিতে ভারতে আইন আছে। মোটকথা আফগানিস্তানে জন্মানো মেয়েটির থেকে কি ভারতে জন্মানো মেয়েটি “সৌভাগ্যবতী” নয়?



আবার মনে করেন দুটি মুসলিম মেয়ে যারা পূর্ব নির্ধারিত কোন ভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি কিন্তু তাদের একজনের বাবা কট্টর মৌলবাদী মানসিকতার আরেকজনের বাবা প্রগতিশীল সংস্কৃতিমনা উদার মানুষ। তাদের দুজনের জীবন কি এক হবে? এই যে দুজনের জীবন দুইভাবে বয়ে যাবে এটি ভাগ্য লিখন নয়। তবে অবশ্যই প্রাকৃতিক নির্বাচনে পড়ে ‘সৌভাগ্য’ ‘দুর্ভাগ্য’ নির্ধারণ হয়েছে।

নিশ্চয় বাংলাদেশের তারুণ্য থেকে ইউরোপ আমেরিকার তারুণ্য অনেক উপভোগ্য আর আকর্ষণীয়। আমাকে অনেক মেয়ে জানিয়েছে বাংলাদেশ থেকে তারা কোলকাতার রাস্তায় অনেক বেশি স্বস্তি ফিল করেন। তাদের বাড়তি ওড়না পরে নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করতে হয় না। ফলে ঢাকার একটি মেয়ে থেকে কোলকাতার একটি মেয়ে নিজেকে “সৌভাগ্যবতী’ ভাবতে পারে কিন্তু এটা সে কপালের লিখন হিসেবে লিখে আনেনি।

আমি একটা কথা অনেক লেখায় বলি অমুসলিম প্রধান দেশের মুসলিমদের সৌভাগ্য যে তারা কোন “মুসলিম দেশে” জন্মায়নি। কারণ অমুসলিম প্রধান দেশে কোনদিন ইসলামী শাসন আসার সম্ভাবনা নেই। সেখানে হেফাজত ইসলাম বা চরমোনই পরীদের উত্থান হতে পারবে না। সেখানে নারীদের পর্দা বা শরীয়া দিয়ে আটকাতে পারবে না। কিন্তু মুসলিম প্রধান দেশের মুসলিমদের সে শংকা থাকবেই। তাই “ভাগ্য” বলতে যাকে আমরা দোষ দেই তা আসলে “বাস্তবতা”। যে বাস্তবতা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পারিবারিক ধর্মীয় কারণে ঘটে থাকে। একশো বছর আগের, পঞ্চাশ বছর আগের হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়ার ‘দুর্ভাগ্য’ আজকের হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়া ছেলেমেয়েদের পোহাতে হয় না। নিশ্চিত করেই এটা তাদেরকে “সৌভাগ্যবাণ” ভাবায়! কিন্তু কিছুই পূর্ব নির্ধারিত নয়। আমাদের জন্ম একটি আকস্মিক ঘটনা। কোটি কোটি শক্রাণুর এক দৌড় প্রতিযোগিতায় সম্পূর্ণ অনির্ধারিতভাবে যেমনভাবে আপনি কোন দৌড় প্রতিযোগিতায় জেতেন বা হারেন সেভাবেই ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন বলে এখন আপনি একটি নাম পরিচয় নিয়ে বেঁচে বর্তে আছেন। যে দেশে জন্মেছেন, যে পরিবারে, সেটাই আপনার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যার জন্য আপনি দায়ী নন। আপনি আপনার ‘কপাল’ লিখে আনেননি।

বিষয়টা তবু আরো জটিল হয়ে যায় এই প্রাকৃতিক নির্বাচনে থেকেই কিছু মানুষ তার বাস্তবতাকে পরাজিত করে উদাহরণ হয়ে থাকেন। তাদের এই সফলতাই “ভাগ্যে বিশ্বাস” জোড়দার করে মানুষের মধ্যে। গরীব হয়ে জন্মানো ভাগ্য লিখন নয়। অর্থনীতি রাজনীতিই মানুষের দারিদ্রতার জন্য দায়ী। এই বিজ্ঞান জানার পর দারিদ্রতা ভাগ্য লিখন বা ঈশ্বরের পরীক্ষা এটি কেউ আর বিশ্বাস করবে না। কিন্তু একদম রাস্তা থেকে সমাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠাকে মানুষ মেলাতে পারে না বলে একসময় সেটাকে ভাগ্য বলে বিশ্বাস করে ফেলে। কিন্তু একটু বুঝিয়ে বললে বুঝবেন এই গুটিকয়েক অসম্ভব সফল মানুষদের সফল হওয়ার পেছনেও আছে সামাজিক রাজনৈতিক ধর্মীয় কারণ।

আমাদের মত দেশগুলি যে রাষ্ট্রযন্ত্র সেগুলো আসলে একটা জেলখানা। চারদিকে কঠিন লৌহ গরাদ দিয়ে ঘেরা থাকলেও মাথার উপর কিছু নেই। সুউচ্চ কঠিন সেই গরাদ বেয়ে একবার কেউ উঠে পড়তে পারলেই গরাদ টপকে বাইরের স্বাধীন জীবনে সে প্রবেশ করতে পারবে। এই বাস্তবতার দেশগুলির মানুষই দেখবেন শূন্য থেকে বিত্ত তৈরি করে ফেলে। কিন্তু কমিউনিস্ট বা ইসলামিক বা অন্য কোন ফ্যাসিস্ট দেশের গরাদের মাথায় ধাতব একটি ছাদ এঁটে থাকে। এখান থেকে পালানোর কোন সুযোগ নেই। ফলে সেই ব্যাতিক্রম ঘটনাগুলো সেখানে আপনি দেখতে পাবেন না। অতি সাধারণ একটি গ্রামের মেয়ের বিশ্ববিখ্যাত মডেল বা অভিনেত্রী হওয়াটাকে “তার কপালে ছিলো” বলে ভাগ্য বিশ্বাস করায় আরো জোর আনা যায় ঠিকই কিন্তু সৌদি আরবে এমন ঘটনা কেন ঘটে না? কারণ সৌদি, আফগানিস্থানে এমন ঘটার কোন সুযোগ কোন মেয়ের নেই। ফলে সেখানে ব্যাতিক্রমও ঘটে না।

কলেরার টিকা আবিস্কারের আগে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ কলেরায় মরত কারণ সেগুলো তাদের ভাগ্যে লেখা ছিলো তারা কলেরাতে মরবে। কিন্তু টিকা আবিস্কারের পর সেরকম ভাগ্য কোন মানুষের কপালে আর কেন লিখছেন না কোন অদৃশ্য ভাগ্যবিধাতা?

জীবন যুদ্ধে লড়াই করা মানুষ যখন বারবার অসফল হয় তখন তাকে ভাগ্যে অবিশ্বাস করানো কঠিন। তাদের জন্যই সম্ভবত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিশন বলে গেছেন, যখন তারা অসফল হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলো তারা জানে না তারা কতটা সফলতার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলো।

টমাস আলভা এডিশন যতই বলুন পৃথিবীতে কিছু মানুষ হাজার চেষ্টা করেও সমকালে সফল হননি। কাফকা, জীবনানন্দ দাশ- কেউ জীবিতকালে সফল হতে পারেননি। তারা তাদের কাজ করে গেছেন সফলতা অসফলতার চিন্তা না করে। ভাগ্য বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাস করেও তাতে অটল থাকেননি মনে হয়। তারা কাজ করে গেছেন। মানুষ তাই ভাগ্যে বিশ্বাস করেও ভাগ্য বিশ্বাসে আস্থা রাখে না। 

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted