দেবশ্রী মিত্রের লেখা একটা অসাধারণ লেখা পড়লাম । আমি দু তিনটি শব্দ পরিবর্তন করেছি মাত্র লেখাটিতে আরো মাধুর্য আনতে
সভ্যতা কিভাবে বেঁচে থাকে? কেন মরে যায়? মানুষের মধ্যে? তার প্রথার মধ্যে? ইতিহাসে? স্থাপত্যে? উপাস্যে? কে কে মহম্মদ, ভারতীয় পুরা তত্ত্ববিদ, এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "আমি যতই মসজিদের নিচে বা ভাঙা মন্দির স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছি, ততই অবাক হয়েছি যে এত বিপুল ধ্বংসলীলার মধ্যেও ভারতীয় সভ্যতা কিভাবে জীবিত রইল!" সেই সাক্ষাৎকারটি ক'জন শুনেছেন জানা নেই, এমনিতেও কে কে মুহম্মদ এদেশে একজন ব্রাত্য মানুষ। কিন্তু তিনি যে কথাগুলি বলেছিলেন, তা অদ্ভুতভাবে ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার সারভাইভালের ছকটির মধ্যে খাপেখাপে ধরে যায়। তিনি বলেছিলেন, "আপাতদৃষ্টিতে দেখলে হিন্দুধর্ম একটি অতি ফ্লেক্সিবল ধর্ম। ফলে তাকে ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে যে এ ধর্মের টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু উদার এবং সহনশীল বলেই সে বেঁচে গেছে, এটা আমার মনে হয়। একজন মানুষ কোন ধর্মীয় আচার না মেনেও শুধু তার উপাস্যের উদ্দেশ্যে গান গেয়ে গেছে, বা তার গল্প বলে গেছে। কেউ শুধু পড়ে মনস্থ করে রেখেছে তার মূল গ্রন্থ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম! কিছুই না করতে পারলেও শুধু এইটুকুর মধ্যেও ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে হিন্দুরা। কম পরিসরেও তার সভ্যতার স্মৃতি রয়ে গেছে অটুট।"
এই যে সভ্যতার স্মৃতি বা সিভিলাইজেশানাল মেমোরি, এ বড় শক্তিশালী জিনিস। এ জিনিস, যেমন মহম্মদ বলেছেন, কিসের মধ্যে দিয়ে একটি সভ্যতা বয়ে নিয়ে যাবে, তা বলা ভারি শক্ত। বিহারে এবং নেপালে, অর্থাৎ ঐতিহাসিকভাবে যা ছিল সীতার পিত্রালয় জনকপুর, সেখানে আজও মহিলারা বিয়ের সময় যে গান গেয়ে থাকেন, তাতে রাম, লক্ষ্মণ, দশরথ এনাদের প্রথমে গালি দিয়ে (বরযাত্রীদের সেখানে এলে আগে গালি দেওয়াই নিয়ম 😁) পরে সম্মান করা হয়।
"মিথিলা কা কন কন খিলা/
জামাই রাজা রাম মিলা।
জনক-সুতি সঙ্গ তুম রহিয়ো অ্যায়সে/
কনক-কমল পর ভঁওরা য্যায়সে।
রামচন্দ্র চকোরি সিয়া/
জামাই রাজা রাম মিলা।"
অযোধ্যায় রামমন্দিরে প্রতিমার প্রাণপ্রতিষ্ঠা উপলক্ষে নেপাল থেকে এসেছে হাজারের ওপর উপহার, সোনার গহনা, ফল-মিষ্টি থেকে শুরু করে বাসনকোসন অবধি। যারা বয়ে এনেছেন, তাঁরা বলছেন, "আমাদের মেয়ের গৃহপ্রবেশ হবে। সেই উপলক্ষে উপহার দেওয়া আমাদের প্রথা তো! তাই এনেছি এসব।" এ হল সিভিলাইজেশানাল মেমোরি। কবে কোন কালে এক মেয়ে এসেছিল মিথিলা থেকে অযোধ্যায় বিহাতা হয়ে, সেই পথ ধরে আজ হাজার বছর পরেও মানুষ মাথায় বয়ে উপহার আনছে, "আমাদের মেয়ের নতুন মহলে গৃহপ্রবেশ কিনা, তাই।"
ঝাড়খণ্ড থেকে আসছে তিনশো কুইন্টাল চাল, প্রসাদ হবে তার। কেন? রাঘবের মায়ের বাড়ি কোশলে, মামাভাতের চাল তারাই তো দেবে গৃহপ্রবেশের দিন! এ হল সিভিলাইজেশানাল মেমোরি। কোশলের কন্যার পুত্র হলেন স্বয়ং উপাস্য, কোশল এমন ভাগনার গৃহপ্রবেশের দিন তার অতিথিসৎকার করবে না, তা কখনো হয়? কিন্তু এ কথা কোশল কিভাবে মনে রেখেছে এত বছর পরেও? রামলীলার মধ্যে দিয়ে, সন্তদের গানে, চারণদের কথায়,
"ঠুমক চলত রামচন্দ্র বাজত পাঁয়জরিয়া"।
অযোধ্যা কিভাবে মনে রেখেছে যে এ তাদের পূণ্যভূমি? ১৫২৮ এ মীর বাকি মন্দিরটি ধ্বংস করেন বাবরের নির্দেশে। আর ১৮৫৭ তে অর্থাৎ তার তিনশোর বেশি বছর পরে অযোধ্যায় একটি পুলিশ এফ আই আর দর্জ করা হয়, যাতে বলা হয় যে জনা পঞ্চাশ নিহাং শিখ "মসজিদ -এ-জনমস্থান"এ ঢুকে পড়েছেন এবং তাঁরা মসজিদের দেওয়াল জুড়ে "রাম রাম" লিখে দিয়েছেন। এই সশস্ত্র নিহাং শিখদের সামলাতে সশস্ত্র পুলিশ পাঠানো নয়। তাঁদের কী পরিণতি হয়, সহজেই অনুমেয়, কিন্তু যা উল্লেখ্য তা হল, ধ্বংস হওয়ার তিনশো বছর পরেও স্থানটি উল্লিখিত হত "মসজিদ-এ-জনমস্থান" হিসেবে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ তাদের সভ্যতার স্মৃতি এই কয়েকটি অক্ষরের মধ্যে দিয়ে ধরে রেখেছিল তিনশোরও বেশি বছর! সামান্য কয়েকটি শব্দ বাঁচিয়ে রেখেছিল তাদের আরধ্যের জন্মস্থানের যথাযথ স্থানের পরিচয়! এ হল কে কে মহম্মদের বলা সেই "সিভিলাইজেশানাল মেমোরি", যার ক্ষমতা অসীম।
১৯৭৬ এ, কে কে মহম্মদের কথায়, মসজিদের নিচে মন্দিরের স্থাপত্য পাওয়া শুরু হওয়ায় ইন্দিরা সরকার খোদাই বন্ধ করিয়ে দেয়। বামপন্থী সাহিত্যিকরা উঠেপড়ে লাগেন এ কথা প্রমাণ করতে যে ওখানে কখনো কোন মন্দির ছিল না। পরবর্তীতে রাডার ম্যাপিং টেকনোলজি আসায় না খুঁড়েই বোঝার উপায় পাওয়া যায় যে সত্যিই মসজিদের নিচে কোন ধ্বংসাবশেষ আছে কিনা। তার পজিটিভ রেজাল্টের ভিত্তিতে আবার শুরু হয় খোদাই। এবং খোদাই করার পর যা যা পাওয়া গেছে, স্তম্ভ, লেখ, মূর্তি, সবই আলাদা করে মন্দির সংলগ্ন একটি মিউজিয়ামে রাখার ব্যবস্থা করা হবে বলে খবর।
যদিও যে সভ্যতা হাজার হাজার বছর ধরে একের পর এক আঘাত সয়ে বেঁচে রয়েছে, তার অধিবাসীদের এইসব প্রমাণ ইত্যাদির প্রয়োজন হয় না ইতিহাস মনে রাখার জন্য। তারা জানে মূর্তি বা মন্দির ভেঙে ফেলা যায়, রাজ্য জিতে নেওয়া যায়, করোটির পাহাড় তৈরি করা যায়, কিন্তু তাদের গল্প, গান, কবিতা, মাথার মধ্যে বয়ে বেড়ানো ধর্মগ্রন্থকে ধ্বংস করতে পারে, এমন আক্রমণকারী এখনো জন্মায় নি এ জগতে। তাই তার উপাস্যের মত তার সভ্যতাও অজর, অমর, অক্ষয়।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................