“আর্য্যরা কি বহিরাগত ?”
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ
ছোট বেলায় ইতিহাসের বই পড়ার সময় যে বিষয় টা আমাকে সর্বাধিক ভাবিয়ে তুলতো সেটা হলো “আর্য্যদের ভারত আক্রমন”। এই নিয়ে নাতিদীর্ঘ লেখা পড়েছি। যা পড়েছি, পরীক্ষার খাতায় সুন্দর করে লিখেও দিয়েছি। কিন্তু মনের মধ্যে ধন্দ রয়েই গেছে। সেই ধন্দ আজো যায়নি।
বলা হয়, আর্য্য একটি জাতি, যাদের মুল উৎপত্তিস্থল ককেশাস পর্বতের আশ পাস এবং ভোলগা নদীর তীরে। অর্থ্যৎ তারা রাশিয়ান। তারা যাযাবর ছিলো, ঘোড়া চরাতো, চাষ বাস জানতো না। ঘুরতে ঘুরতে তারা হিন্দুকুশ পেরিয়ে এসে পড়লো ভারতে। তারপর প্রচন্ড যুদ্ধ বিগ্রহ করে, স্থানীয় ভুমিপুত্রদের মেরে কেটে শেষ করে দিয়ে তাদের নিজেদের এক সভ্যতা তৈরী করলো যার নাম “আর্য্য সভ্যতা”। এরাই নাকি বেদের শ্রষ্টা, রামায়ন না হলেও (কারন রামায়ন নাকি পুরোপুরি কল্প কাহিনী) মহাভারতের যুদ্ধটাও এই বহিরাগত আর্য্যরাই করেছিলো। এদেশের স্থানীয় ভুমি পুত্রদের এরা অনার্য্য , দ্রাবিড়, ম্লেচ্ছ, যবন, দস্যু এং আরো নানা আকথা কু কথা বলে গালা গাল করতো। জাতি প্রথা সৃষ্টি করে, নিজেদের ব্রাহ্মন বলে জাহির করে, এই আর্য্যরাই ভারতের অন্ত্যজ শ্রেনীকে চিরদিনের মতো চাকর বানিয়ে রেখেছিলো, যার ফল বর্তমান প্রজন্ম অবধি ভুগতে হচ্ছে।
যাযাবর জাতি আগেও ছিলো, এখনো আছে। ইউরোপে ১২ মিলিয়ন ‘জিপসী’ (যাদের বলা হয় ‘রোমা’, কারন তারা রামের ভক্ত এবং মুসলমানি আমলে নিয়ে যাওয়া ভারতীয় দাসদের বংশধর) আছে। তারা তো আজ ১৫০০ বছরেও একটি পুস্তক লিখতে পারলো না। তা তারা না হয় ভারতীয়, তাই জ্ঞান গম্যি নেই, তা হুন রা কেনো বেদের মতো একটি দর্শন শাস্ত্র বানালো না ? হাল আমলের আরবী বেদুইন রা যুদ্ধ বাজ ছিলো, মারামারি হানা হানি করতে ওস্তাদ ছিলো, সারা দুনিয়া দখল করে ফেলেছে । তারা আজো একটি দর্শন শাস্ত্র তৈরী করতে পারলো না।
বড় হয়ে, ঈশ্বর প্রদত্ত নিজের মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবতে শিখে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরী হয়েছে, যার উত্তর খুজতে খুজতে বুড়ো হয়ে গেলাম।
আর্য্যরা এলো কবে ? বলা হয় বেদ লেখা হয়েছে ১৫০০ -৫০০ খ্রীষ্ট পুর্বাব্দে। সেটা হলো আজ থেকে ৩৫০০ – ২৫০০ বছর আগে। আমার প্রশ্ন, ঋক বেদে সরস্বতী নদীর কথা অসংখ্য বার ঊল্লেখ আছে। সরস্বতী নদী একটি গল্প কথা (মিথ) বলে আর পার পাওয়া যাচ্ছে না, কারন স্যাটেলাইট ইমেজিং বলে প্রায় ৪০০০ বছর আগেই ওই নদীটির উৎসস্থান এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে (ভুমিকম্পে) বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সরস্বতী নদী অল্প কালেই শুকিয়ে যায়। এই নদীর জলধারা ও স্যাটেলাইট ইমেজিং এ ধরা পড়েছে। তাহলে? ৩৫০০ হাজার বছর আগে এসে, ৪০০০ বছরের পুরানো বেদ কি করে লেখা হলো? সরস্বতী শুকিয়ে যেতে তো সময় লেগেছ খুব কম হলেও বেশ কয়েক শতাব্দী। আর শুকিয়ে যাবার পরে তো তারা সরস্বতী নদীর বন্দনা গীত গাইতে পারে না? তাকে নদীতমা বলতে পারে না। নিশ্চয়ই ওই যুদ্ধ বাজ গুলো সেই সরস্বতী নদীরে তীরে বেশ কিছু কাল বসবাস করেছে???? বাস করে , এক সভ্যতা সংষ্কৃতি তৈরী করেছে ? শুদ্ধ বুদ্ধ সংষ্কৃতি তৈরী করতে কতো সময় লাগে???
বেদ কে বলা হয় শ্রুতি। গুরু শিষ্য পরম্পরায় শুনে মনে রাখা হতো তাই শ্রুতি, লেখা হয়েছে ৩৫০০ বছর আগে। একটি যাযাবর জাতি, যারা ঘোড়াকে ঘাস খাওয়ানো ছাড়া আর কিছুই জানতো না, পারতো না, তারা এই দেশে এলো ঘোড়ার পিঠে চড়ে বরফে ঢাকা দুর্গম হিন্দুকুশ পেরিয়ে , যুদ্ধ বিগ্রহ করলো দেশ দখল করলো ইত্যাদি । এই সবের সংগে সংগে তারা বেদের সুক্তের মতো জ্ঞান গর্ভ দার্শনিক চিন্তা ভাবনা করলো, যা কিনা এখনো পৃথিবীর উন্নত শিক্ষিত বৈজ্ঞানিক মানুষ তৈরী করতে পারেনি। এ কি ভাবা যায়????? (অবশ্য ছাগলে কি না খায় আর পাগোলে কিনা বলে?)
সিন্ধু নদীর তীরে যে অতি উন্নত সভ্যতার নিদর্শন মিলেছে, তাকে বহুদিন ধরে শুধু মাত্র “সিন্ধু সভ্যতা” নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তার কথাও ইতিহাসে পড়েছি। আজ থেকে প্রায় ৫১ বছর আগে (আমি যখন ইতিহাস পড়েছি বিদ্যালয়ে) পন্ডিতেরা ঐ হরপ্পা মহেঞ্জোদারো ছাড়া আর কোনো কিছুর সন্ধান পাননি। তাহলে অবশ্যই আর কিছু নেই বা কোনোদিন ছিলো না। তা বেশ। কিন্তু এখন যে রাজস্থান এবং গুজরাটের বিস্তীর্ন অঞ্চল জুড়ে, যা কিনা দশটা হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর সমান এবং সমসাময়িক সে গুলো কি???? এই পন্ডিতেরা তখন “লোথাল” নামে কোনো প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন খুজে পাওয়া যাবে তা তাদের উর্বর মস্তিষ্কে বুঝতে পারেন নি এবং অহংকারী মনে জায়গা দিতে পারেন নি। এখনকার পন্ডিতেরা বলছেন, এই গুজরাট এবং রাজস্থানের বিস্তীর্ন অঞ্চলে হরপ্পা –মহেঞ্জোদারোর সময়ে যে উন্নতা সভ্যতা ছিলো তা একই সভ্যতা এবং আজকের তুলনায় অতি উন্নত। সুইমিং পুল ও নাকি ছিলো তখন!
ক্যাম্বে উপসাগরের তীরে, গুজরাটে দ্বারকাধীশের মন্দিরের কিছু দূরে সমুদ্রের জলের নীচে ৩ মাইল চওড়া, ৭ মাইল লম্বা একটি শহরের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া গেছে এই মাত্র ক’মাস আগে। বলে হচ্ছে সেই শহরের পরিকল্পনা স্থাপত্য অতি উন্নত এবং বেশ কয়েক হাজার বছর আগেকার। শ্রী কৃষ্ণের দ্বারকা নগরী দ্বীপে ছিলো এবং তা জলের তলায় তলিয়ে গিয়েছিলো। তা সে কথা কে স্বীকার করবে এখন, যে ওটাই সেই শ্রী কৃষ্ণের দ্বারকা??? স্বীকার করলেই বিপদ, কারন তাহলে ঐ আর্য্যরা বহিরাগত সেই তত্ত্বের কি হবে? সনাতনি হিন্দুরা যে শ্রী কৃষ্ণের কথা বলে ,ঈশ্বর জ্ঞানে পুজো করে সেই শ্রী কৃষ্ণকে তো স্বীকার করতে হবে। তাহলে, তিনি যে বহুবার বহু ভাবে বৈদিক দর্শনের কথা বলেছেন সেটাও মানতে হবে। দেখা যাক, পন্ডিতেরা হিসাব কষছেন, ঐ জলের তলার শহরটার বয়ষ কতো তাই ঠিক করতে। তখন দেখা যাবে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকার বয়ষ কতো। আমার তো মনে হয়, ৫০০০ বছরের ও বেশী হবে। তাহলে, কুরুক্ষেত্রে যোগ দেওয়া তাবৎ রাজ রাজড়ারা, রথী মহারথী ওই ৩০০০ বছরের পুরানো না তার বহু আগের তা বোঝা যাবে।
সমুদ্রের জলের পরিমান বেড়ে গিয়ে সারা পৃথিবীর উপকুল অঞ্চল জলের তলায় ধীরে ধীরে ডুবিয়ে দিয়েছিলো শেষ বরফ যুগের (last ice age) জমা বরফ যখন গলতে শুরু করেছিলো। শেষ বরফ যুগ শেষ হয়েছে প্রায় ১২০০০ বছর আগে। তা সেই বরফ তো একদিনে গলে যায়নি, সময় লেগেছিলো। ধীরে ধীরে গলেছে আর সমুদ্রের জল বেড়েছে, সেই সংগে সমুদ্রের উপকুল এবং বহু দ্বীপ জলের তলায় চলে গেছে। সেই মহা প্লাবন সারা পৃথিবীতে ঘটেছে, আর তার বিবরন লেখা আছে নানা পুথি পুস্তকে (যেমন বাইবেলে ‘নোয়া’র নৌকার কাহিনী—‘The ark of Noa)। কানাডার সমস্ত হ্রদের সৃষ্টি সেই বরফ গলা জল দিয়ে। আমাদের পুরানে আছে ঈশ্বর ‘কুর্ম অবতারে (কচ্ছপ অবতারে) বেদকে রক্ষা করেছিলেন প্লাবনের হাত থেকে । মনু সমহিতায় সেই একই কথা লেখা আছে।
প্রসংগত বলি, হিন্দুরা যাকে বলে “রাম সেতু”, যাকে সরকারী ভাষায় বলে “Adam’s Bridge” (আদমের সেতু—সেই সিমেটীক ধর্ম দুটির কথা), সেটা নাকি প্রকৃতি বানাই নি। সেটা নাকি “মানুষের বানানো”। আবার সেই স্যাটেলাইট ইমেজিং এই কথা বলেছে। পন্ডিতেরা কতো কষ্ট করে আর্য্যদের বহিরাগত , যুদ্ধবাজ কিন্তু যাযাবর এক জাতি বানিয়ে ফেলেছেন,যারা মাত্র হাজার তিনেকের একটু সময় আগে, ঘোড়া চরাতে চরাতে সেই ভোলগা নদীর কুল থেকে হিন্দুকুশ পেরিয়ে (তা ঐ উচু পর্বতের বরফের ওপরে ঘাস জন্মায়?) ভারতে এসেই যুদ্ধ করলো, বেদ লিখে ফেললো। এখন কিনা ঐ স্যাটেলাইট ইমেজিং সব তত্ত্ব কে মিথ্যে বলে প্রমানিত করছে, আর হিন্দুরা যে সব ভুল ভাল কথা লিখেছে তাকে সত্য বলে প্রমানিত করছে, সেটা কি ঠিক করছে?????
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................