এই ভয়ংকর ব্যক্তিপুজা একটা সম্প্রদায়কে ফ্যানিটিক করে দিয়েছে। কোথাও গান বাজলে মারতে যায়! দাড়ি না রাখলে কটুকথা শোনায়। মাথায় ঘোমটা না থাকলে, টিপ পরলে টিটকারি মারে। সবই সুন্নতের খেলা।

মুসলিম লীগ লেখকরা দেখিয়েছেন, ভারতবর্ষে মুসলমানরা যখন এলো, তখন মনিব ও চাকর একত্রে নামাজ পড়ছে। তাদের মধ্যে কোন ব্রাক্ষণ বড় জাত নেই। এটা দেখে হিন্দুরা সবাই দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যায়!

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান সমাজ ধর্মের নামে চরম অসহিষ্ণু হওয়ার পিছনে মুসলিম লীগ ও বাপপন্থীদের বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। ভারতবর্ষে আফগান তুর্কি আরবি শাসনকে এরা কখনো ইসলামী শাসন, কখনো মুসলিম শাসন বলেছে। বাংলার মুসলিম সুলতানদের যারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তাদের এই উদ্যোগকে কখনো ‘বাংলা ভাষা প্রসারে মুসলমানদের অবদান’ বলেছে না হয় ‘ইসলামী শাসনে বাংলা ভাষার মর্যাদা’ এই রকম হাইলাইট হয়েছে। তাহলে আর্য ভট্ট বা বরাহ মিহিরকে বলা হবে হিন্দু ধর্মের অবদান নাকি হিন্দু শাসনের অবদান?

এই কথা বললে কেউ কেউ বলেন, মুসলমানরা তো লেখাপড়ায় পিছিয়ে ছিল, তাই তাদের মধ্যে কেউ কিছু হলে সেটাকে মুসলমান হিসেবে দেখানো হতো অনুপ্রাণিত করতে...। একদমই বাজে একটা তথ্য! মুসলমানরা ভারতবর্ষে লেখাপড়ায় পিছিয়ে ছিল না। তারা আরবি ফারসি উর্দুতে লেখাপড়া করত। গরীর কৃষক মুসলমান যেমন অক্ষরহীন ছিল তেমন গরীব হিন্দু কৃষকও অক্ষরহীন ছিল। আশরাফ অর্থ্যাত উচ্চবংশীয় মুসলমান নিজেদের সিংহাসন হারানো রাজা বাদশার জাত মনে করত। ফলে তারা ইংরেজি শিখত না। এর ফলে ইংরেজ দুশো বছরে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ছিল। পিছিয়ে গিয়ে হিন্দুদের দোষ দিল। ওদের কারণে আমরা পিছিয়ে গেছি! অথচ মুসলিম লীগ যারা বানিয়েছে, সেই শিক্ষিত মুসলমানদের ইংরেজি লেখাপড়া করার সুযোগই হয়েছিল যখন হিন্দু জমিদাররা গ্রামগঞ্জে নিজেদের বাবা-মার স্মৃতি ধরে রাখতে স্কুল খুলছিলেন। সেসব স্কুলে ফ্রি লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছিল বাঙালি মুসলমানদের প্রথম ইংরেজি শেখা প্রজন্ম। তারাই লাহোর প্রস্তাব দিয়েছিল মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ। কোন কৃষক বলেনি মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ লাগবে। কারণ কৃষকদের কোন হিন্দু মুসলমান জাত ছিল না। কিন্তু ইংরেজি শেখা শিক্ষিত মুসলমান যখন আইন পড়ে পকেট ভরে পয়সা রোজগার করতে শুরু করল, তখন দেখলো দেশের উজির নাজির হতে গেলে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার মুসলমানদের একক নেতা হতে হবে। তথন এইসব গরীব কৃষক জেলে তাঁতিদের বুঝানো হলো পাকিস্তান হলে আর কোন কষ্ট তোমাদের নেই। এখন যে কষ্ট করছো সেগুলি এই কাফের অত্যাচারি হিন্দু জমিদারদের জন্য। এই স্বপ্ন এতটাই বড় হয়ে গেলো যে পাকিস্তানের জন্য এইসব সাধারণ মানুষ জীবন দিতে প্রস্তুত হলো। তাদেরকে যে ধোঁকা দিয়েছিল সেরওয়াসি পড়া উকিল আর ব্যবসায়ীরা তারা সেটা বুঝেনি। জমিদার বদল হয়েছে মাত্র। সেরওয়ানিঅলাদের জন্যই তাদের গরু-মোষের মত খেটে যেতে হয়েছে...।

আবার ইসলাম নিয়ে কথায় ফেরত আসি। এই যে ইসলামকে জাতপাতহীন ভ্রাতৃত্বময় ধর্ম যা ভারতের নিপীড়িত ছোটজাতের হিন্দুদের মুক্তির পথ করে দিয়েছিল- এরকম ইতিহাস বানানো হয়েছিল, এতে লাভ হয়েছে কাদের? এই ইতিহাস পুরো মুসলিম সমাজের ধর্মীয় সংস্কারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। মনুসহিংতায় নারী বিদ্বেষী কত কী আছে সেসব নিয়ে আজো লেখা হয়। অথচ মনুসংহিতা কী মুসলমানদের হাদিসের মতই প্রত্যহ অনুসরণের বই?

পৃথিবীতে মুসলমানদের মত আর কোন সম্প্রদায় ‘সুন্নত’ নামের একজন ব্যক্তি এই কাজগুলি করে গেছেন তাই আমরা করে যাবো এমন উদাহরণ নেই। যীশুর মুখে দাড়ি আছে কিন্তু খ্রিস্টানদের জন্য দাড়ি রাখা কি সুন্নত? পোপের কোন দাড়ি নেই। অথচ মুহাম্মদ সাহেব যদি একটু খঁড়িয়ে হাঁটতেন জানা যেতো তাহলে তার দেড়শো কোটি অনুসারী পৃথিবীতে আজ লেংচিয়ে লেংচিয়ে হেঁটে বেড়াতো!

বামপন্থীদের কী লাভ হয়েছে জানি না আফগান ইরান তুর্কি আরবি জাতির শাসনকে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ’ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মাঝখানে দেশীয় শাসন হিসেবে রেখে দিয়ে। ভারতে যে ইংরেজদের আগে তিনশো বছর ‘মুসলিম সাম্রাজ্যবাদ’ চলেছে তারা স্বীকার করেনি কেন? তাদের লেখায় ‘মুসলিম শাসন’ আছে কিন্তু ‘মুসলিম সাম্রাজ্যবাদ’ নেই!

ইসলাম ধর্ম যে চরমমাত্রার একটি নারী বিদ্বেষী ধর্ম সেটি নিয়ে আলোচনা হয়নি। যে মুসলিম লীগার মনুসংহিতাকে নারী বিদ্বেষী উপাদানের সঙ্গে তুলনা করে সেই একই লোক হাদিস থেকে মহান কোন বাণী কোট করে দেখায়। হাদিসের নারী বিদ্বেষী উপাদনের সামনে মনুসংহিতা রীতিমত শিশু! রামমোহন-বিদ্যাসাগর সেকালে সতীদাহ ও বিধবাবিবাহ আইন পাশ করতে পেরেছিলেন মনুসহিংতার রেফারেন্স দেখিয়েই। কিন্তু আপনি হাদিস দেখিয়ে নারীদের অবরোধবাসিনী হতে মুক্তির কোন রেফারেন্স পাবেন না! নারীদের তালাকের অধিকার, নিজের পরিচয়ে বসবাসের অধিকার, চাকরি ব্যবসা করার অধিকার কোনটাই হাদিস থেকে রেফারেন্স দেখিয়ে করতে পারবেন না। ফলে একশ্রেণীর মডারেটদের উদয় হয়েছে যারা হাদিস মানেন না!

ইরানে ফ্যাসিজমী শাসন ইসলামি বিপ্লবের পর শুরু হয়েছিল এমন একটি বক্তব্য লেখা কোন বামপন্থী কখনো বলেছে দেখাতে পারবেন না। উল্টো মিশেল ফুকোর মত বামপন্থী বুদ্ধিজীবী দার্শনিক বলেছিলেন, ইরান পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের উত্খাত করতে সক্ষম হয়েছে এটাই আমাদের কাছে বড় কথা, তারা মৌলবাদী কিনা সেটি বিবেচ্য নয়...।

এটাই তড়িকা! তীতুমীর-শরীতুল্লাহ ভারতে ইসলামী শাসনে দেখতে চেয়েছিল সেটি বিবেচ্য নয় তারা ইংরেজ আর জমিদারদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছিল সেটাই বিবেচ্য! তাই ‘হাজার চুড়াশির মা’ তীতুমীরকে নায়ক বানিয়ে উপন্যাস লিখেছিলেন। আচ্ছা তিনি কি ইরানের নারীদের কান্না নিয়ে কোন বই লিখেছিলেন? কিংবা ভারতীয় নারীদের মুসলিম পার্সোনাল ল’ আইনের জাঁতাকলে পড়ে তাদের নিপীড়িত হওয়া নিয়ে?

না, সবাইকে সব কিছু লিখতে হবে না। আমাকেও যেমন সব কিছু লিখতে হবে না। তবে প্রশ্ন তোলা যাবে। যেমন আপনারা অনেকে প্রশ্ন তোলেন শুধু ইসলাম নিয়ে এত কথা লিখি কেন? অন্য ধর্ম নিয়ে লিখেন না কেন? লিখি তো। এই লেখাতেই তো আছে দেখেছেন। কিন্তু আর কোন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে কি ‘সুন্নত’ আছে? এই ভয়ংকর ব্যক্তিপুজা একটা সম্প্রদায়কে ফ্যানিটিক করে দিয়েছে। কোথাও গান বাজলে মারতে যায়! দাড়ি না রাখলে কটুকথা শোনায়। মাথায় ঘোমটা না থাকলে, টিপ পরলে টিটকারি মারে। সবই সুন্নতের খেলা। ফলে সুন্নতের মালিককে নিয়ে কথা তো বেশি হবেই!

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted