বরফ ঢাকা এন্টার্কটিকে এক ধর্ম প্রচারক একবার ধর্ম প্রচারের জন্য গেলো। মৃত্যুর পর স্বর্গে গিয়ে কী কী সুবিধা পাবে, খাওয়ার জন্য মধু-দুধের সাথে কী কী থাকবে ইত্যাদি যখন ধর্ম প্রচারক বর্ণনা দিচ্ছিল, তখন সেখানকার লোক হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলো স্বর্গে শিকার করার জন্য সিল মাছ পাওয়া যাবে কিনা! ধর্ম প্রচারক থতমত খেয়ে বললো, এমন কিছু তো কখনো শুনি নি! তবে যেহেতু স্বর্গে সব পাওয়া যাওয়ার কথা সেহেতু সেখানে শিকার করার জন্য সিল মাছও থাকার কথা! এন্টার্কটিকবাসী বললো- যে ধর্ম আমাদের সিল মাছ শিকারের গ্যারান্টি দেয়না সে ধর্ম আমাদের দরকার নেই!
কিন্তু কথা হলো ধর্মে মধু, দুধ, খেঁজুর বা হুরের বর্ণনা থাকলেও পেঙ্গুইন বা সিলের বর্ণনা থাকলো না কেন! উত্তর হতে পারে দুইটা- এক. সবকিছুর আলাদা আলাদা বর্ণনা করা সম্ভব না বা দরকারও নেই। আর দুই- ধর্ম প্রচারকগণ যে এলাকাতে জন্মেছিলেন বা ধর্মপ্রচার করেছেন সে এলাকাতে এসব এভেইলেবলও ছিলনা বা সে এলাকার মানুষ এসব সম্পর্কে জানতেনও না যে এসবের বর্ণনা তারা দিয়ে যাবেন।
রমজান মাস এলেই এদেশে খেঁজুরের রমরমা ব্যবসা শুরু হয়, কারন খেঁজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নত। কিন্তু পেয়ারা বা আম দিয়ে ইফতার করা সুন্নত না কেন? কারন আরবে তো তখন পেয়ারা-আম ছিলই না! খেঁজুর দিয়ে ইফতার সুন্নত না বলে যদি বলা হতো ফল দিয়ে ইফতার করা সুন্নত কারন নবীজী (সা) ইফতারে ফল খেয়েছেন, তাহলে ধর্মটাও রক্ষা পেত, আর এদেশের ফলগুলোও আরেকটু ইজ্জত পেত। কোন এক বিদেশী ফল এসে এদেশের ইফতারের বাজার দখল করা লাগতোনা তখন।
শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন হারাম বলছেন, কারন ফুল দিয়ে পূজা করা হয়। আর ইসলামে ফুল দিয়ে কাউকে শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্যাপারে কিছু বলা নেই। বলা থাকার তো কথাও না। ইসলাম আবির্ভাবের সময় আরবে তো আর গোলাপ বা গাদা ফুল ছিলনা যে ফুল নিয়ে কিছু বলা থাকবে। দুই হাত জোড় করে ভগবানকে পূজা করা যায়, মানুষকে স্বাগত বা বিদায় জানানো যায়, আবার কারো কাছে ক্ষমাও চাওয়া যায়। হাত জোড় করার কারন বা নিয়তের উপর নির্ভর করছে আপনি হাত জোড় করে কী করতে চাচ্ছেন। ইন্নামাল আ’মালু বিন নিয়াহ- সব কর্মের ফলাফলই নির্ভর করে নিয়তের উপরে। ফুল দেয়ার সময় যদি নিয়ত থাকে পূজা করার, তবে সেটা পূজাই হচ্ছে। ফুল দেয়ার সময় নিয়ত যদি থাকে শ্রদ্ধা জানানোর, তবে সেটা শ্রদ্ধা জানানোই হচ্ছে, পূজা নয়। এই সহজ বিষয়টা না বোঝার মতো মানুষ আপনারা না। আপনারা বুঝেও বিতর্ক করেন, কারন আপনাদের মূল সমস্যা আসলে বাঙালির 'জাতিসত্তা'টাতেই।
দুনিয়াতে একটা মানুষের যত রকম পরিচয় হতে পারে তার মধ্যে সবচেয়ে ঠুনকো পরিচয় হচ্ছে ধর্মীয় পরিচয়। ধর্ম ব্যাপারটা এতোই ঠুনকো যে এক সেকেন্ডের মধ্যে মানুষের ধর্ম পরিচয় পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। আজ আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি বলে আমি মুসলমান। এই মূহুর্তে যদি আমি ঘোষণা দেই যে আল্লাহকে বিশ্বাস করি না ভগবানকে বিশ্বাস করি আমি সাথে সাথে হিন্দু হয়ে যাব। যদি বলি আমি যিশু খৃষ্ট আর ইশ্বরকে বিশ্বাস করি তাহলে আমি খৃষ্টান হয়ে যাব। বিশ্বাস পরিবর্তনের কারনে জাস্ট চোখের পলকে মানুষের ধর্ম পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে! যে ইবলিস লক্ষ কোটি বছর আল্লাহর ইবাদত করে আল্লাহর সব চেয়ে প্রিয় ফেরেশতা হয়েছিল, সে আল্লাহর একটা আদেশ না মানার কারনে মূহুর্তে ফেরেশতা থেকে শয়তান হয়ে গিয়েছিল! এজন্য ইসলামেও বারবার সতর্ক করা হয়েছে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে। ধর্ম বেঁচে থাকে বিশ্বাসে। কিন্তু আপনার জাতিসত্তা কোনদিনও পরিবর্তন হবেনা আপনি চাইলেও।
একবার বাঙালির ঘরে জন্ম নিয়েছেন মানে মরার আগ পর্যন্ত আপনি বাঙালি। আপনি সেটা মানেন বা না মানেন, বিশ্বাস করেন বা না করেন, আপনার জাতীয়তা বাংলাদেশী থেকে আমেরিকান হোক বা আফ্রিকান তাতে কিচ্ছু যায় আসেনা, আপনি বাঙালি হয়ে জন্মেছেন মানে আপনার জাতিসত্তা আজীবন বাঙালি। অথচ এটা নিয়েও তর্ক হয় যে আমি আগে অমুক ধর্মের লোক তারপর বাঙালি! সুযোগই নেই এটা বলার! আপনি মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়ে হসপিটাল থেকে চুরি হয়ে আজীবন এক হিন্দু পরিবারে বড় হয়ে হিন্দু হয়ে মারা যেতে পারেন। কারন আপনার ধর্ম পরিচয় আপনি পেয়েছেন আপনার বিশ্বাস করার বয়স হবার পর হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই যেখানেই যার ঘরেই যে বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে থাকেন না কেন, আপনার বাঙালি পরিচয় মুছে ফেলার কোন উপায়ই নেই।
যারা বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে বাঙালির উৎসব আর উদযাপনকে ধর্মের দোহায় দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়, তাদের জন্য আমার করুণা হয়। কাকের পালক ফেলে ময়ূরের পালক লাগিয়ে তারা ময়ূর সাজতে চায়। কিন্তু দিন শেষে না পারে ময়ূর হতে, না পারে আবার কাকের সাথে মিশতে। গলাছিলা মুরগির মতো আত্মপরিচয় ছিলা একটা জীবন তাদের হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াতে ছড়াতে পার হয়ে যায়।
ধর্মটাকে আপনারা ধর্মের জায়গাতেই থাকতে দেন প্লিজ। যে লোকটা ফজরের নামাজ পড়ে খালি পায়ে শহীদ মিনারে যেয়ে শহীদদের উদ্দ্যেশ্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করলো, সে ঠিক কী অধর্মটা করলো সেটা কোনভাবেই আমার বোধগম্য হয়না। শহীদ মিনারে ফুল দেয়া হারাম, পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা হারাম, বাঙালির সব উদযাপনকে যখন আপনি হারাম হারাম বলে দূরে ঠেলে দেবেন, তখন আলামুল আরওয়াহতে রূহ হয়ে যখন ছিলেন তখন আল্লাহর কাছে আবেদন করতেন আল্লাহ দুনিয়াতে আর যাই বানাও বাঙালি বানাইয়ো না!
ধর্ম বলে দেয়নি দেখেই যদি সবকিছু হারাম হয়ে যেত, তাহলে খেঁজুর বাদে দুনিয়ার সব ফল হারাম হতো। পেঙ্গুইন বা সিল মাছ স্বর্গে পাওয়া যেতেও পারে বলে সন্দেহ হতোনা, সাথে সাথেই বলে দেওয়া যেত যে পাওয়া যাবে না। ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলো অপরিবর্তিত থেকে ধর্ম যদি স্থান ও কাল ভেদে স্থানীয় সংস্কৃতিকে নিজের করে না নিতে পারে, সেটা ধর্ম বা সংস্কৃতি কারোর জন্যই মঙ্গলজনক না।///
লিখেছেন-
এ্যাডিশনাল এসপি
মাহফুজ হোসেন।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................