শঠ ব্যক্তিরাই ধর্ম ত্যাগ করে
ধর্ম শাশ্বত স্বয়ং ঈশ্বর প্রণীত। সৃষ্টির শুরু থেকেই ধর্ম বহমান। তাই ধর্ম কোন ব্যক্তি কেন্দ্রিক মতবাদ নয়। কিন্তু পক্ষান্তরে ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন ব্যক্তি বিশেষের মস্তিস্কপ্রসূত। অনেক ক্ষেত্রে মতবাদগুলো সর্বজনীন মনুষ্যত্ববোধকে ধারণ না করে প্রবর্তক ব্যক্তির সংকীর্ণ মানসিকতাকে অবলম্বন করে অগ্রসর হয়। প্রবর্তক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং মানসিকতা প্রবলভাবে সেই মতবাদে দৃশ্যমান হয়। প্রবর্তক ব্যক্তির যদি কোন জাতিগোষ্ঠী বা বিশ্বাসের প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ থাকে, তবে তিনি তার নিজস্ব ক্ষোভ এবং বৈরিতাকে তার অনুসারীদের মাঝে সঞ্চারিত করার প্রচেষ্টা করেন। এ বিদ্বেষের সঞ্চারণ করতে গিয়ে অনেক সময়ে প্রবর্তক ব্যক্তি মানবসভ্যতার প্রভূত ক্ষতি সাধন করেন। ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারী মতবাদে পরিণত হয়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, এক ব্যক্তি এসে তার ইচ্ছাখুশী মত যা মনে হল তাই অনুসারিদের উপরে চাপিয়ে দিয়ে তার ধর্মীয় মতবাদটি প্রবর্তন করে। কোন একক ব্যক্তি থেকে জন্ম নেয়া ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদটি রাজশক্তির রাষ্ট্রক্ষমতা এবং বণিকশক্তির অর্থনৈতিক প্রভাবে ধীরেধীরে পরবর্তীতে ধর্ম নামে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদে কোন আধ্যাত্মিকতা থাকে না। থাকে শুধুই লোভ,ভয়, সংকীর্ণতা, হিংসা, বিদ্বেষ, যৌনতা, অমানবিকতা এবং সর্বোপরি রাজনীতি।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদ কখনই সর্বজনীন হয় না। তাই সর্বজনীন না হওয়ায় এ মতবাদ জগতের সকলের জন্যে কল্যাণকরও হয় না। একজন মানুষের রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার সহ নিজের মুক্তির পথের সকল নির্দেশনা ধর্মে পাওয়া যায়। ধর্মের শুদ্ধ পথে চলে নির্বাণলাভ করে পরবর্তীতে মুক্ত হওয়া যায়। জীবের সকলেরই লক্ষ্য, জন্মজন্মান্তরের আবর্তে ঘুরে একসময় মুক্ত হওয়া। ধর্ম মুক্তি সহ জীবন চলার প্রতিটিক্ষেত্রেই আবশ্যক। কিন্তু এরপরেও বহু মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে মুক্তির পথ ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে, অধর্মে অমানবিকতা আসুরিকতায় যুক্ত হয়। আসুরিক প্রবৃত্তি এবং মতবাদ ধীরেধীরে তাদের পাপাত্মাতে পরিণত করে।
দণ্ডেনৈব স হন্তব্যস্তং পন্থানং সমাশ্রিতঃ।
চ্যুতঃ সদৈব ধর্ম্যেভ্যোঽমানবং ধর্মমাস্থিতঃ॥
শঠঃ স্বধর্মমুৎসৃজ্য তমিচ্ছেদুপজীবিতুম্। সর্বোপায়ৈর্নিহন্তব্যঃ পাপাে নিকৃতিজীবনঃ॥
(মহাভারত :শান্তিপর্ব, ১০৬ অধ্যায়, ২৫-২৬)
"যে ব্যক্তি আপন ধর্ম হতে বিচ্যুত হয়ে, অমানবিক আসুরিক ধৰ্ম আশ্রয় করে সে নিন্দনীয় পথেই চলিতে থাকে; রাজা সেই ব্যক্তির প্রাণদণ্ড দিবেন।
একমাত্র শঠ প্রবৃত্তির ব্যক্তিই আপন ধর্ম পরিত্যাগ করে, অমানবিক আসুরিক ধর্মে জীবন যাপন করতে ইচ্ছা করে এবং সে লক্ষ্যে সারাজীবন প্রতারণাতেই নিযুক্ত থাকে। সেই পাপাত্মাকে সর্ব উপায়ে বধ করা উচিত।"
এ শ্লোকটির নীলকণ্ঠের 'ভারতভাবদীপঃ' টীকায় বলা হয়েছে, 'অমানবমাসুরম্'। হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ প্রণীত ভারতকৌমুদী টীকায় টীকাকার বলেছেন, "যো ধর্মেভ্যশ্চ্য তঃ অমানবমাসুরং ধৰ্মমাস্থিতঃ সন্, তমাসুরমেব পন্থানমাচারং সমাশ্রিতাে ভবতি, রাজ্ঞা দণ্ডেনৈব স হন্তব্যঃ।" অর্থাৎ মহাভারতের দুইজন টীকাকারই মানবের অমানবীয় আচরণকেই আসুরিক আচরণ বলে অবিহিত করেছেন। যারা অমানবীয় আসুরিক আচার এবং পন্থানুসরণ করছে, তাদের রাজা কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা উচিত। আসুরিক সম্পদ বা আচার-আচরণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করা মানুষদের কিভাবে আমরা চিনতে পারি, তা শ্রীমদ্ভগবদগীতার ষোড়শ অধ্যায়ে অত্যন্ত সুন্দর করে বর্ণিত হয়েছে। অধ্যায়টির নামই 'দৈবাসুরসম্পদ বিভাগযোগ'। একজন আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষের মধ্যে দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা ও অজ্ঞান এই নেতিবাচক দিকগুলো সুস্পষ্টভাবে থাকে। অধিকাংশ সময়ে তা জন্মগতভাবেই থাকে, আবার অনেক সময়ে পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা থেকে তামসিক আসুরিক সম্পদ বৃদ্ধি পায়।
দম্ভো দর্পোঽভিমানশ্চ ক্রোধঃ পারুষ্যমেব চ।
অজ্ঞানং চাভিজাতস্য পার্থ সম্পদমাসুরীম্।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১৬.০৪)
"হে পার্থ! দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা ও অজ্ঞান এই সকলই হল আসুরিক সম্পদ নিয়ে জন্মগ্রহণ করা মানুষের লক্ষণ।"
আসুরিক সম্পদযুক্ত ব্যক্তিরা দম্ভ, দর্প, ক্রোধ এবং অভিমানকে ধর্মের সাথে যুক্ত করে নেয়। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায় ধীরেধীরে। নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়েই তারা তখন সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। অন্যের উপাস্য বিগ্রহাদি ধ্বংস এবং অন্যের বিশ্বাসকে ধ্বংস করাকে তারা ধর্মের অঙ্গ মনে করে। অজ্ঞান দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে তারা যথাসাধ্য নিষ্ঠুরতা করে। অধিকাংশ সময়েই আসুরিক সম্পদযুক্ত মানুষেরা নিষ্ঠুরতার অজ্ঞানে দূষিত হয়ে যৌন এবং নির্মম জল্লাদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। যে ব্যক্তি নিজের ধর্ম পরিত্যাগ করে অমানবিক সেই আসুরিক ধৰ্ম আশ্রয় করে সেও নিন্দনীয় পথে চলে ধীরেধীরে সম্পূর্ণভাবে আসুরিক ভাবময় হয়ে অন্ধকার থেকে অন্ধকারলোকে গমন করে।স্বধর্ম ত্যাগের মত আত্মবিনাশী আর নেই।জন্মদাতা বাবা ও জন্মদাত্রী মাকে যেমন পরিবর্তন করা যায় না; তেমনি স্বধর্মকে কখনোই পরিত্যাগ করা যায় না।
একমাত্র শঠ বা প্রবঞ্চক প্রবৃত্তির ব্যক্তিই নিজ পূর্বপুরুষদের ধর্ম পরিত্যাগ করে, মানবিকতাহীন আসুরিক ধর্মে জীবন যাপন করে। সারাটি জীবন প্রতারণাতেই তার শেষ হয় । এই পাপাত্মাদের অবস্থা হয় লেজকাটা শিয়ালের মত। এক শিয়াল গৃহস্থের হাঁস-মুরগী চুরি করে খেতে গিয়ে অসতর্কতাবশত গৃহস্থের ফাঁদে পরে তার প্রিয় লেজটি ফাঁদে কাটা পরে। শিয়ালরা স্বভাবতই চতুর স্বভাবের। চতুর শিয়ালটি চিন্তা করে, আমার লেজটি কাটা অবস্থায় দেখলে বনের সকল পশুপাখিই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। সে তখন বনের পশুপাখিদের সাথে প্রতারণা করতে একটি বুদ্ধি বের করে। সে বনে প্রবেশ করে সবাইকে বলে বেড়াতে থাকে, "তোমরা কে কে সশরীরে স্বর্গে গিয়ে স্বর্গের সুখভোগ করতে চাও? যে যে স্বর্গে যেতে চাও আমার সাথে যোগাযোগ কর। কাল রাত্রে ভগবান আমাকে এসে বলে গিয়েছেন, যাদের স্বর্গে যাওয়ার আকাঙ্খা আছে, তারা যেন সর্বপ্রথমে নিজের প্রিয় লেজটি কেটে ফেলে। এটাই হবে স্বর্গে যাওয়ার প্রথম পরীক্ষা। এ লেজকাটা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে, তবেই ভগবান খুশি হয়ে তাদের স্বর্গে নিয়ে যাবে।" চতুর শেয়ালের কথা অধিকাংশ বোকা পশুপাখিরাই বিশ্বাস করে তাদের প্রিয় জন্মগত লেজটিকে বিসর্জন দিল। তবে কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রশ্ন তুললেন। তারা বললেন, "আচ্ছা শিয়াল পণ্ডিত, তোমার কথা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু আমাদের একটি প্রশ্ন, ভগবানকে খুশি করার সাথে লেজকাটার কি সম্পর্ক? লেজ যদি কাটতেই হয়, তবে তিনিই তো আমাদের লেজ কেটে পৃথিবীতে পাঠাতে পারতেন। আমাদের আর কষ্ট করে নিজেদের অঙ্গহানি করতে হত হত না।" শিয়াল পণ্ডিতের কথা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা পশুপাখিদের কথা শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে শিয়াল পণ্ডিত বললেন, "তোমরা অবিশ্বাসী হয়ে যাচ্ছ, তোমরা ভগবানের কথা বিশ্বাস করছ না। নরকের আগুনে যখন তোমাদের পোড়ানো হবে, তখন বুঝতে পারবে কতধানে কত চাল। ভগবান আমার কাছে এসে বলে গিয়েছেন, আমি হলাম তার বার্তাবহ। তাঁর সেই প্রিয় বার্তাবহ আমাকেই কিনা তোমরা অবিশ্বাস করছ ? তোমরা পশুপাখি হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, পশুপাখিই থাকবে; কোনদিন স্বর্গে যেতে পারবে না। যত্তসব মুর্খ কোথাকার!" শেয়াল পণ্ডিতের আত্মবিশ্বাস পূর্ণ কথা শুনে, যাদের বিশ্বাস তার প্রতি দোদুল্যমান ছিল; তারাও তাকে বিশ্বাস করল। এ বিশ্বাসের অভিঘাতে শিয়াল পণ্ডিতকে অবিশ্বাস করা পশুপাখিদের অবিশ্বাসী আখ্যা দেয়া হল।আজন্মকাল বসবাস করা বন থেকে তাদের অপমানিত করে জোরপূর্বক বিতারিত করা হল। ফলশ্রুতিতে লেজ কাটা শিয়াল পণ্ডিত বনের সহজসরল পশুপাখিদের জীবনে আরো জাকিয়ে বসে নির্বিঘ্নে ধর্মব্যবসা করে যেত লাগলো।
লেজকাটা প্রবঞ্চক শিয়ালের মত একমাত্র শঠ প্রবৃত্তির ব্যক্তিই আপন ধর্ম পরিত্যাগ করে, অমানবিক আসুরিক ধর্মের সাথে যুক্ত হয়। এরা জলের আশায় মরুমরীচিকায় ঘুরতে থাকে। কিন্তু জল কোনদিনও পায় না, তৃষ্ণাও কোনদিন মেটে না। শুধুই ভ্রান্ত পথিকের মত এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়। তাই নিজ ধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও পরধর্ম থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই নিজধর্ম সাধনে যদি মৃত্যুও হয়, তবেও সে ধর্ম কল্যাণকর। কিন্তু পক্ষান্তরে পরধর্ম ভয়াবহ। বিষয়টি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদগীতার তৃতীয় অধ্যায়ে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন।
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাত্ স্বনুষ্ঠিতাৎ৷
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ৩.৩৫)
"নিজ ধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত আপাত দৃশ্যমান পরধর্ম থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই নিজধর্ম সাধনে যদি মৃত্যুও হয়, তবেও সে ধর্ম কল্যাণকর ; কিন্তু পক্ষান্তরে পরধর্ম ভয়াবহ। "
অনেক শঠ প্রবঞ্চক আছে, নিজেরা গভীর কূপে পরে গিয়ে, অন্যদের সেই কূপে পরতে প্ররোচিত করে। যখন বুঝতে পারে, এ কূপ থেকে উদ্ধারের আর উপায় নেই ; তখন আসুরিক প্রবৃত্তিবশত অন্যদের সেই কূপে ঝাঁপিয়ে পরার জন্য ডাকতে থাকে। নিজে কূপে পরেছে, তাই চায় অন্যদের যেন তারই মত দশা হয়। একপ্রকার বিকৃত মানসিকতা থেকে মানুষ এ আত্মঘাতী কাজগুলো করে।অন্যদের সুন্দর ভাষায় বোঝায়, কূপের গর্তের ভিতর সে অসম্ভব শান্তিতে আছে; কূপের মধ্য দিয়ে একটি স্বর্গে যাওয়ার পথ আছে ইত্যাদি আকাশকুসুম কথাবার্তা। সেই অবিশ্বাস্য কথাগুলো, অনেকে সরলমনে বিশ্বাসও করে ফেলে। তারাই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে মৃত্যুরূপ কূপে ঝাঁপিয়ে পরে। পরবর্তীতে তাদের আর উদ্ধারের পথ থাকে না। তাদের জীবনে অন্ধকার কালরাত্রী চলে আসে। এ কালরাত্রির অভিঘাতে পর্যায়ক্রমে তারা,অন্ধকার থেকে আরও ঘোর অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................