মনুসংহিতা কয়জন হিন্দু চোখে দেখেছেন জীবনে?

মনুসংহিতা কয়জন হিন্দু চোখে দেখেছেন জীবনে? এটা মুসলমানদের কুরআনের মত কোন বই নয়, খ্রিস্টানদের বাইবেলের মত কোন বই নয় যে প্রতিটি মুসলমান খ্রিস্টানের বাড়ির মত এক কপি করে থাকবেই। সেই মনুসংহিতাকে নিয়ে ভারতবর্ষে যত লেখা হয়েছে, মনুসংহিতার বাপন্ত তোলা হয়েছে তার সিকি ভাগও কুরআন নিয়ে লেখা হয়নি। এক সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখা বইতে মনুসংহিতা যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে, সে বই আপনি হিন্দুদের মধ্যে বিতড়ন করলেই কেবল হিন্দুরা জানতে পারবে মনুসিংহতায় আসলে কি লেখা আছে!

বাংলাদেশের মুসলমান মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে ‘মোকসেদুল মোমেনীন’ নামে একটা বই দেখেনি এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। এই বইটি থেকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করা মুসলমান ৯০ দশকে দশজনে নয়জন ছিল। এই বইটির কাছে মনুসংহিতা দুধের শিশু মাত্র! কেননা মোকসেদুল মোমেনীন মুসলমান নারীদের অন্ধকার গহ্বরে টেনে নিয়ে যায়। বাংলাদেশে বোরখা হিজাব পরা কট্টর সাম্প্রদায়িক মধ্যবিত্ত মুসলিম নারী তৈরি হওয়ার পেছনে মোকসেদুল মোমেনীন প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস থেকে দেখান মনুসংহিতা হিন্দুদের ঘরে ঘরে পঠিত হত আর তা পড়ে হিন্দুরা মৌলবাদী হয়েছিল? তেমন কোন ইতিহাস নেই। হিন্দু ঘরে একটা পঞ্জিকা পাওয়া যায়। গীতা থাকে। কিন্তু গীতা আসলে কি?

কুরআন বা বাইবেলের মত হিন্দুদের কোন একক ধর্মীয় বই নেই ফলে ইংরেজ আমলে আদালতে হিন্দুরা শপথ নিবে কি করে সেটির সমাধান হিসেবে মহাভারতে কৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে বাক্যালাপগুলো আলাদা সংকলন করে ভগবদ গীতা নামে একটি বই তৈরি করা হয়েছিল। কালক্রমে হিন্দুদের ধারণা হয়েছিল এটি তাদের প্রধান পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন ও বাইবেলের মত। এই যে একক ধর্মীয় গ্রন্থের ধারণা এটি আব্রাহামিক ধর্মের কনসেপ্ট। বৌদ্ধ ধর্মের ত্রিপিটক তথাকথিত কোন আসমানী কিতাব নয়। এটি বুদ্ধের বাণীর সংকলন। ভারতবর্ষের ধর্মগুলোর সঙ্গে আব্রাহামিক ধর্মগুলোর কোন মিল নেই। ফলে তাদের সমালোচনার পথও এক নয়। হিন্দু সমাজে কুসংস্কার, কুপ্রথা, নারী বৈষম্য নিয়ে হাজার হাজার কথা বলা যায়। এগুলো সামাজিক আন্দোলনের অংশ। জাতপাতের সমস্যা মূলত রাজনৈতিক কারণে আজো টিকে আছে। সতীদাহ করলে ভারতে এখন জেল খাটতে হবে। মনুসংহিতায় সতীদাহ কোন অন্যায় নয়। আবার কেউ সেটা করতে না চাইলেও চলবে। মনুসংহিতা দেখিয়েই রামমোহন সতীদাহবাদীদের মুখ বন্ধ করেছিলেন। ভারতে জাতপাত আইন করে নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে। কিন্তু রাজনীতি বড় বালাই!

মুসলিম সমাজে বিয়ে রেজিস্ট্রি একটি বেদাতী কাজ। কুরআন-হাদিসের কোথাও বিয়ে রেজিস্ট্রে করার নিয়ম নেই। বরিশালের লোক ঢাকা এসে বিয়ে করে বাচ্চা ফুটিয়ে বরিশাল ভেগে গেলে তাকে ধরা সম্ভব নয়। কারণ বিয়ের প্রমাণ কি? এজনই বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে হয়। সময়ের বাস্তবতায় আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফের মত মোল্লাও তার মেয়েকে রেজিস্ট্রি ছাড়া বিয়ে দিবে না। এগুলো হচ্ছে সামাজিক ধর্মীয় বিষয়। সময়ের ব্যবধানে বদলে যায়। সেই বদল এক সময় মৌলবাদীরাও মেনে নিতে বাধ্য হয়। ইসলাম নারীদের তালাকের অধিকার দেয়নি। আজকে বাংলাদেশে জন্ম নেয়া কেউ এটা দেখে এতটাই অভ্যস্থ যে তার ধারণা হবে ইসলাম নারীদের তালাক দেয়ার অধিকার দিয়েছে কিন্তু হিন্দু ধর্ম এতটাই পিছিয়ে যে সেখানে নারীরা তালাক দিতে পারে না। কারণ সে দেখেছে হিন্দু বিয়ে রেজিস্ট্রি হয় না, নারীরা তালাক দিতে পারে না। তাদের জানার সুযোগ নেই ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মুসলিম পারসোনাল ল পরিবর্তন করে বিয়ে রেজিস্টি ও নারীদের তালাকের অধিকার আইন পাশ করান। এই আইন পাশ করার পর সমগ্র পাকিস্তানের আলেমরা আইয়ুব বিরোধী হয়ে উঠে। কিন্তু আজকে একজন মোল্লা পাবেন যে নারীদের তালাক দেয়ার আইন বাতিলের দাবী করে?

ধর্মীয় প্রথা সামাজিক বাস্তবতায় বদলে যায়। হিন্দুদের জাতপাত কী ভয়ংকর রকম ছিল সেটি আজ ক্রমশ বিলিন হচ্ছে। ভারতে হিন্দু নারীরা সম্পত্তিতে অধিকার পায়, তালাক দিতে পারে- যা হিন্দু শাস্ত্র বিরোধী। ভারতে জাতপাতের সমস্যা আজো অঞ্চল ভিত্তিক রয়ে গেছে। আবারো বলছি এটি সামাজিক আন্দোলনের অংশ। মুসলমান সমাজও এখন সময়ের বাস্তবতায় বদলে যাচ্ছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে নারী প্রধানমন্ত্রী আজ বিশ বছর। অথচ ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম তা সহি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

এইসব ধর্মীয় গোঁড়ামী অর্থনৈতিক কারণে টিকতে পারে না। দরিদ্র সমাজে ওয়াজের রমরমা অবস্থা থাকলেও সে সমাজের মেয়েরাই গার্মেন্টেসে চাকরি করতে যায়। না গেলে পেট চলবে না। ভাত এমন চিজ খোদার চেয়ে উনিশ বিশ। ফলে গোঁড়ামী ভাতের কাছে মার খাবেই। কিন্তু...

আসল ক্রিমিনাল ‘রাজনৈতিক ইসলাম’! এটা নিয়েই আমি লিখি বেশি। ‘মুসলমান’ কোন জাতি নয়। তবু মুসলমানদের জাতি বানিয়ে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ভারতে তাদের সাম্রাজ্যবাদকে ‘মুসলিম শাসন’ নাম দেয়া হয়েছে। বাগদাদের খলিফাদের নিজেদের খলিফা, তুরস্কের খলিফাদের নিজেদের খলিফা মনে করা- এগুলো কোন ধর্মীয় পারিবারিক গোঁড়ামী নয়। এটা জাতীয়তাবাদ। ভয়ংকর এক ফ্যাসিবাদের নাম ‘রাজনৈতিক ইসলাম’। মানুষের ব্যক্তিগত ধর্ম পালন নিয়ে আমার কখনোই কোন মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু ‘ইসলাম কায়েম’ ভিন্ন জিনিস। ইসলামে ‘নামাজ আদায়’ ও ‘নামাজ কায়েম’ দুটো ভিন্ন বিষয়। আদায় হচ্ছে আপনি আপনার নামাজটা পড়লেন। আর কায়েম হচ্ছে আপনি সমাজে সকলকে নামাজ পড়তে বাধ্য করলেন। সাবালক সব মুসলমান ইসলামী শাসনে নামাজ পড়তে বাধ্য। আবু বককের সময় যাকাত দিতে অস্বীকার করা মুসলমানদের হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছিল। যাকাত তো ইসলামের একটি স্তম্ভ। সেটি না দিলে পরকালে আল্লা শাস্তি দিবেন। তাহলে আবু বকর যাকাত অস্বীকারকারীদের উপর হামলা চালালেন কেন? তিনি কি আপনার চাইকে ইসলাম কম বুঝতেন? কারণ ইসলাম বলেছে ‘ইসলাম কায়েম’ করো। এটা রাজনৈতিকভাবে করতে হয়। আমি সেই কায়েমের বিরুদ্ধে লিখি। আমার লেখা ধরতে পারার কথা এ জন্যই মুসলিম লীগের নাস্তিক-মুক্তমনাদের কম্ম নয়!

মুসলিম শাসনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুখ্যাতি করা মুক্তমনা-নাস্তিকরা মুসলিম জাতিতত্ত্বাকেই বিশ্বাস করেন। এই গর্ব তাদের নিজেদের গর্ব। তাহলে চার্ণক্য, বারাহ মিহির, আর্য ভট্ট কোন শাসনের গর্ব? সেটাকে হিন্দু বিজ্ঞান বা হিন্দু দার্শানিক বলবো? ইবনে সিনা, আলবেরুণদের মুসলমান বিজ্ঞানী দার্শনিক বলতে বামপন্থীদের কত গর্ব, কিন্তু যেই আর্য ভট্টকে হিন্দু বিজ্ঞানী বলুন ওমনি আপনি চাড্ডি! আমি এই ভন্ডামী খুলে দেই। ‘মুসলিম শাসন’ ‘ইসলামের ইতিহাস’ এই রাজনৈতিক ইসলামের বেসাতি আমি বারবার দেখিয়ে দেই। এগুলো সাম্রাজ্যবাদ। খিলাফত একটি ফ্যাসিবাদ। যেখানে অমুসলিমদের ‘জিন্মি’ মনে করা হয়। যেখানে মুসলমানরা বিধর্মীদের চেয়ে সবার উপরে। যেখানে অপমানকর জিজিয়া কর আছে। আছে দাস ব্যবসার স্বীকৃতি। আছে যুদ্ধাপরাধের (গণিমের মাল) স্বীকৃতি। এই রাজনৈতিক ইসলামের সমালোচনা করলেই মুসলিম লীগের সব শাখার মধ্যে ঐক্যজোট গড়ে উঠে আমার বিরুদ্ধে!

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted