টাঙ্গাইল শাড়ি
ভারত 'টাঙ্গাইল-শাড়ি'র জি আই নিয়েছে, এতে যা দেখছি বাংলাদেশী লোকজন যারপরনাই বিরক্ত। হওয়াটা স্বাভাবিক, যদি না ইতিহাসের খবর রেখে থাকেন কেউ।
আমার নিজের পড়ার বিষয় ইতিহাস ছিল না কোনকালে, মানে ক্লাস টেনের পরে। কিন্তু প্রথাগত পড়াশোনার পাঠ চুকে যাওয়ার পর দেখলাম, ইতিহাসটাই সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয়। কারণ ইতিহাসে দুনিয়ার সবরকম আর্থ-সামাজিক সমস্যার কারণ লুকিয়ে আছে। ওইজন্য আমি কোন সমস্যা পেলেই মাথা না চুলকে ইতিহাস খুঁজি।
টাঙ্গাইলের সমস্যার সমাধান করার আগে একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করি।
বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেব, হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের কসুর ঘরানার এক মহারথী, তিনি দেশভাগের পরে বাই ডিফল্ট গেছিলেন পাকিস্তানের দিকে, মানে পশ্চিমের দিকে। বছরখানেক বাদে তাঁকে পাকিস্তান রেডিও গান গাওয়ার সময় গানে "কৃষ্ণের নাম নেওয়া যাবে না" বলায় তিনি "রইল ঝোলা, চলল ভোলা" করে এপারে চলে আসেন। বলে এসেছিলেন, "তবে কি বন্দিশে আল্লা তেরি করুণা অপার গাইব তোমাদের জ্বালায়? কক্ষনো না, গুরু যা শিখিয়েছেন, তাইই গাইব।"
হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের শতকরা আশি ভাগ হিন্দু দেবদেবীর বন্দনা, তায় আবার লিখেছেনও গাদাগুচ্ছ ইসলামিক নামধারী লোক। তাঁদের বাদ দিলে হিন্দুস্তানি মিউজিক কানাখোঁড়া তো দূর, থাকতই না। আজকাল লোকজন চারপাতা পড়ে বিশাল সেকু-ধার্মিক মুসলমান হয়। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাক্ষাৎ সরস্বতীর বরপুত্র, তিনি মেয়ের নাম রেখেছিলেন অন্নপূর্ণা! আরেকজন ইসলামিক নামধারী মানুষ, যিনি বাবা বিশ্বনাথকে সানাই শোনাতেন, তাঁর কথা আর বলব কী! তিনি তো ভারতরত্ন আমাদের। খাঁচাটা দিয়ে আত্মা বিচার করলে হবে? যাকগে। মরুকগে। মোটকথা দেবকীনন্দনকে যশোদানন্দন বলা ভারতবর্ষ এনাদের সাদরে গ্রহণ করেছে, নাম দেখে খেদিয়ে দেয় নি।
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শহর বহুকাল থেকেই শাড়ির জন্য বিখ্যাত। আজ বলে না। ঢাকাই মসলিনের নাম থাকলেও টাঙ্গাইলেও মসলিন বোনা হত বলে কথিত। এখানে বয়নকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের পদবী ছিল মূলত বসাক, এনারা নাথ যুগী সম্প্রদায়ের লোক। যার এক শাখার প্রধান ইউপির যোগী আদিত্যনাথ, সেই যোগী নাথ এনারা।
দেশভাগের পর এবং ১৯৬১ তে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে টাঙ্গাইলের হিন্দু তাঁতিরা দলে দলে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসেন এপারে, মূলত নদীয়া জেলার ফুলিয়া-শান্তিপুর অঞ্চলে। যেমন সব উদ্বাস্তুর গল্প, ফুলিয়া-শান্তিপুরেই শরণার্থী কলোনিতে নতুন করে তাঁরা ঘর বানান, সেই সঙ্গে তাঁদের সেই নতুন ঘরে আবার করে তাঁত বসে, তাঁরা আবার সাবেকি পেশায় ফিরে যান।
এখানের অজস্র উদ্বাস্তু পরিবারের মধ্যে একজনের গল্প বলি। বীরেন কুমার বসাক। না না, 'পদ্মশ্রী বীরেন কুমার বসাক'। ভারত সরকার এনাকে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করেছে সম্প্রতি। ইনি সর্বস্ব হারিয়ে ১৯৬২ সালে টাঙ্গাইল থেকে পরিবারের সঙ্গে ভারতে আসেন। নিজের সাক্ষাৎকারে বহুবার বলেছেন, তাঁদের আদি বাড়ি টাঙ্গাইলে, বাজিতপুরের হাটে তাঁদের বোনা শাড়ির কদর ছিল বিশাল, এ কথাও তাঁর এখনো মনে আছে। কারণ এপারে আসার সময় তাঁর বয়স ছিল বারো বছর।
বিশাল স্ট্রাগল করেছেন এপারে এসে। যারা আজ হাউকাউ করছেন ওপারে বসে, তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলি, ঘরদোর জ্বালিয়ে দিলে তাঁত ঘাড়ে করে বয়ে এপারে আনা যায় না, তাই তাঁরা সম্বল করে এনেছিলেন মাথায় রাখা টাঙ্গাইলের তাঁতের প্যাটার্ন আর বুননের এক্সপার্টাইজ। সেইখান থেকে শুরু করেন বীরেন বসাকের পরিবার। বাজিতপুরের হাটে যাঁদের বোনা শাড়ি কিনতে দিল্লি-মুম্বই থেকে ব্যবসায়ী আসত, তাঁরা দুই ভাই মাথায় করে বাবার হাতে বোনা শাড়ির গাঁটরি নিয়ে বিক্রি করেছে লোকের দুয়ারে দুয়ারে। তারপর নিজেরা দুই ভাই বড় হয়ে শুরু করেছেন শাড়ির ব্যবসা। সেই ব্যবসায় আজ পাঁচ হাজার তাঁতি তাঁত বোনেন। তাঁদের "টাঙ্গাইল" শাড়ি বিদেশে যায়। ভারত সরকার তাঁকে দিয়েছে দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান।
এমন অনেক টাঙ্গাইলের তাঁতি আছেন ফুলিয়া-শান্তিপুরে। ঘরে ঘরে। বাংলাদেশ যাদের তাঁত জ্বালিয়ে দিয়ে একবস্ত্রে তাড়িয়ে দিয়েছে, কারণ তাদের ধর্ম আলাদা। ও দেশে তাদের থাকার অধিকার নেই বলে। আজ যখন তারা তাদের নিজেদের যোগ্যতায় এ দেশে এসে সেই প্যাটার্ন, সেই শাড়ি বুনে আন্তর্জাতিক সিলমোহর আদায় করে নিচ্ছ, তাতেও বাংলাদেশের সমস্যা! অসাধারণ ব্যাপার তো! গুনী মানুষকে তাড়ানোর আগে ভাবা উচিত ছিল না কি, যে তারা যাওয়ার আগে সঙ্গে করে তাদের গুণটুকুও নিয়ে যাবে দেশ থেকে?
ও হ্যাঁ, বীরেন কুমার বসাক একটা ভালো কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, "আজকাল টাঙ্গাইলের চেয়ে বেশি টাঙ্গাইল শাড়ি ফুলিয়া শান্তিপুরে বানানো হয়। আমার মনে হয়, আমরা এই শাড়িকে টাঙ্গাইল শাড়ি না বলে তার নাম পালটে দেওয়া উচিত।" এইটা ভালো কথা বলেছিলেন। যে দেশ, যে জেলা, যে শহর বসাকদের খেদিয়ে দিয়েছিল, তাদের নামে বসাকদের শাড়ির নাম না রাখলেও হয় হয়ত। অথবা, নামটা থাক। মনে করাতে যে এতে আদতে কার অধিকার ছিল, কারা সেই অধিকার স্বেচ্ছায় হারিয়েছে, কারণ তারা এই মানুষগুলোকে চায় নি। শুধু নামটা চেয়েছে।
মানুষ বাদ দিয়ে তাদের সংস্কৃতি ধরে রাখা যায় না, এই ঘটনায় এই সামান্য জ্ঞানটুকু যদি মানুষজনের হয়, তাও লাভ। সেইটুকু মনে করানোর জন্যই টাঙ্গাইল নামে জি আই থাক এপারে। তাতে হাউকাউ না করে বরং কিছু শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশীরা। টাঙ্গাইলে বীরেন কুমার বসাকদের ঘরদোর জ্বালিয়ে তাড়িয়ে দিলে তারা এপারে শান্তিপুর-ফুলিয়াতে এসেই টাঙ্গাইল শাড়ি বুনবে। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে "আমিই অরিজিনাল" বলে বিশেষ লাভ হবে না।
(Debasree Mitra)
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................