কোন ইউরোপীয়ানকে যদি আমরা ইউরোপীয়ান বলি তিনি কি ক্ষুব্ধ হবেন? পাগল নাকি! এটা তার মহাদেশীয় পরিচয়। যেমন কাউকে এশিয়ান বললেও সে রাগ করবে না। তাহলে আমাদের কাউকে ‘ভারতীয় উপমহাদেশীয়’ বললে এত সমস্যা কেন? মহাদেশীয় পরিচয় নৃতাত্বিক, এর কোন পরিবর্তন হয় না। কিন্তু মানচিত্রধারী পরিচয় রাজনৈতিক, পরিবর্তনশীল। এই দেশের পিতামহ ছিল ‘ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয়’, বাপ ছিল ‘পাকিস্তানী’, পুত্র হয়েছে ‘বাংলাদেশী’। তার পুত্রের পরিচয় কি হবে কেউ জানে না। কিন্তু তিনজনই আসলে ‘ভারতীয় উপমহাদেশের’ মানুষ। এই অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি ভাষা খাদ্য লোকাচারে রয়েছে নৈকট্য। চেহারা দেখলে আলাদা করা কঠিন। “ভারত” নামে এখন যে দেশটি আছে তার আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা দিবস আছে। কিন্তু “ভারতীয় সংস্কৃতি” বললে আসলে এই উপমহাদেশীয় সকল জাতিগোষ্ঠিকে বুঝায়। কিন্তু ‘ভারত’ নামটি কোথাও যুক্ত থাকলেই আমাদের বিছুটি পাতা লাগার মত চুলকানি শুরু হয়!
বাংলাদেশী সংস্কৃতি বা পাকিস্তানী সংস্কৃতি বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। পাকিস্তানের মানচিত্র কাঁচি দিয়ে কেটেছিলেন একজন ইংরেজ আমলা। তাতেই কোন জাতির সৃষ্টি হয়ে যায়নি। কোন নতুন সংস্কৃতির জন্ম এভাবে কেউ দিতে পারে না। একইভাবে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্ম কোন জাতির জন্ম হয়নি। কোন সংস্কৃতির জন্ম হয়নি। বাংলাদেশ মানেই বাঙালি নয়। আরো জাতি সংস্কৃতি আছে। এদের পরিচয় কি হবে? ফলে রাজনৈতিক পরিচয়ে সংস্কৃতি বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয় পাল্টে যায় না। এগুলো জাতি বিচারে স্ব স্ব জাতির সংস্কৃতি। বৃহত পরিচয়ে এগুলো ভারতীয় সংস্কৃতি। সিন্ধু নদের পারে যে সভ্যতা করে উঠেছিল আমরা তার অংশ। আমাদেরকেই বহিরাগতরা এসে ডেকেছিল ‘হিন্দু’। সিন্ধু তাদের মুখ দিয়ে আসতো না। ফলে ‘হিন্দু’ এখন একটি ধর্ম সম্প্রদায় হলেও প্রকৃত তথ্য হচ্ছে হিন্দু সমস্ত বাংলাদেশী পাকিস্তানী ইন্ডিয়ান নেপালী শ্রীলংকা... সকলেরই পরিচয় “হিন্দু”।
আমাদের সংস্কৃতিতে “হিন্দুয়ানী” থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা তো আরবের মানুষ নই। আরব দেশ থেকে ইসলাম ধর্ম এই দেশে এসেছিল। ইসলাম আরবের আবহাওয়া, লোকাচার, খাদ্যাভাস তৈরি করে দেয়নি। বরং আবহাওয়া লোকাচার খাদ্যাভাসকে বেস করে ইসলাম গড়ে উঠেছে। আপনি বাংলাদেশের পাট চাষীকে বলতে পারেন না যে হাঁটুর উপর কাপড় তোলা যাবে না- এটা হারাম। এই দেশের জল হাওয়ার কৃষি প্রধান দেশের ধর্মে কখনোই বলতো না কাপড় হাঁটুর উপর উঠতে পারবে না। কারণ কৃষক মাঠে জল-কাঁদায় নেমে কাজ করে। কিংবা জেলেদের বলতে পারে না তাদের ‘ছতর ঢেকে রাখতে হবে’। এদেশে যারা ইসলাম আমদানি করেছিলো তারা নিজ নিজ সংস্কৃতিকেও আসলে প্রচার করেছিল। ইরানী মুসলমানরা আসলে একইসঙ্গে ইরানী সঙস্কৃতিকে ইসলামী সংস্কৃতি নাম দিয়ে প্রচার করেছিল। আরবীয়রা আরবি সংস্কৃতিকে। এটা ছিল আমাদের সিন্ধু সভ্যতার জন্য একটি মারাত্মক সাংস্কৃতিক উপনিবেশ। নিজ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ধর্ম বিশ্বাসের অংশ হিসেবে। অথচ আপনি মুসলমান হোন কোন সমস্যা নেই, কিন্তু আপনাকে “হিন্দু মুসলমান” হতে হবে। কারণ আপনি “আরবি মুসলমান” নন। রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাহ্ম ধর্মের মানুষ হয়েও বলেছেন আমরা, এদেশের সকল ধর্ম সম্প্রদায়কে আগে ‘হিন্দু’ হতে হবে।। যেমন ‘হিন্দু মুসলমান’ ‘হিন্দু হিন্দু’ ‘হিন্দু খ্রিস্টান’ ‘হিন্দু বৌদ্ধ’। হিন্দু হচ্ছে সংস্কৃতি। যার ভৌগলিক বৃহত পরিচয় ভারতীয় উপমহাদেশ। কিন্তু পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল চরম সাম্প্রদায়িক জাতি চেতনা থেকে। ‘ভারত’ ‘ইন্ডিয়ান’ এই পরিচয়গুলোকে তাই শিক্ষিত জ্ঞানী লোকজনও অন্ধ ধর্মীয় পরিচয়ে বুদ্ধিভিত্তিক জালিয়াতি করে অস্বীকার করে গেছেন। তাই আজকের প্রজন্মকে বুঝানোই দায়- এই ‘হিন্দু’-‘ভারতীয়’ পরিচয় কোন রাজনৈতিক পরিচয় নয়। এগুলো সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়। বর্তমান ‘হিন্দু ধর্মের’ সঙ্গে এটাকে আলাদা করে দেখতেই হবে।
©সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................