মুসলমানদের জন্য আবার বিশ্ববিদ্যালয় কেন, ওদের জন্য তো মাদ্রাসা আছে...!

ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি দান করেছিলেন, সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে, আর রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে বলেছিলেন, চাষাভুষাদের জন্য আবার কিসের বিশ্ববিদ্যালয়!

একটা মিথ্যা বারবার বলতে বলতে সত্যের মত প্রতিষ্ঠা পায় সেটা বাংলাদেশে এসে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। উপরের বাক্যগুলো আবার ফেইসবুকে ভাইরাল হচ্ছে। অথচ এই অসত্য তথ্যগুলো নিয়ে আমাদের মত অনেকেই অনেকবার লিখেছেন। দুঃখজনক হচ্ছে তাও কথাগুলো সত্য কিনা জানতে যখন বহু পাঠক আমাকে ইনবক্স করেন তখন প্রশ্ন জাগে আমি যে এই বিষয় নিয়ে একাধিকবার লিখেছি সেগুলোর তাহলে কি হলো? আপনারা যারা পড়েছিলেন তারা কি আমাদের লেখাগুলো যথেষ্ঠ প্রচার করেননি? এই যে বলেন পাশে আছি ভাই, এই পাশে থাকার অর্থটা কি?

মুহাম্মদ কয়টা বিয়ে করেছে, তার শিশু বিয়ে, দাসী ছহবত- কেবল এগুলো জানলেই হবে না। রবীন্দ্রনাথ আর সলিমুল্লাহকে দাঁড় করিয়ে একজনের জমিতে বিশ্ববিদ্যালয় বানানো আর অপরজনকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতাকারী বানিয়ে ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করতে পারলে একজন মুসলিম ব্যাকগ্রাউন্ডের নাস্তিককেও মুসলিম জাতীয়তাবাদী করানো যাবে। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই নাস্তিক ধর্মকর্মহীন ছিলেন কিন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদ ধারণ করেছিলেন এইরকম হিন্দু বিদ্বেষ থেকে। হিন্দুদের বাড়িতে মুসলমান গিয়ে দাঁড়ালে সেই জায়গাটা গঙ্গজলে ধুঁয়ে ফেলার মত কালচার থেকেও ধর্ম অবিশ্বাসী মুসলমান দেশভাগের প্রাককালে মুসলিম জাতীয়তাবাদী হয়েছিল। তাই সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ইতিহাস জানা ও নিজের বুদ্ধি দিয়ে যাচাই না করে নিলে বুদ্ধির মুক্তি ও অসাম্প্রদায়িক মানুষ হওয়া সম্ভব হবে না।

সরদার ফজলুল করিম প্রশ্ন করেছিলেন প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে, স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নাকি নবাব সলিমুল্লাহ অর্থ ও জমিদান করেছিলেন। সে কারণেই তার নামে একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ নাকি করা হয়েছিলো। প্রফেসর রাজ্জাক এই দাবী পুরোটাই নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন আপনারা ঢাকা কালেক্টরেটে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেন জমি দান করার মত জমি আহসান মঞ্জিলের ছিল না।

বর্তমানে মডারেট মুসলমান ও মৌলবাদী মুসলমানদের কাছে সলিমুল্লাহ খান জনপ্রিয়। সলিমুল্লাহর গুরু ছফা, ছফার গুরু রাজ্জাক। ফলে মডারেট সমাজ এই তথ্যদাতাকে অগ্রহণযোগ্য বলার কোন সুযোগ নেই। রাজ্জাক সাহেব বলেছেন, আহসান মঞ্জিলের বৃত্তিতে কিছু মুসলমান ছেলে লেখাপড়া করত। তাদের একজন আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী। কৃতজ্ঞ আবদুল্লাহ সাহেব সলিমুল্লার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করত। সলিমুল্লাহর মৃত্যুর দশ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রদের জন্য একটি ছাত্রাবাস তৈরি করা হলে তার নামকরণ সলিমুল্লাহ মুসলিম হল প্রস্তাব করেন আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী। (সূত্র: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ: অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর আলাপচারিতা, সরদার ফজলুল করিম, পৃষ্ঠা ২০-২১)

এই হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নবাব সলিমুল্লাহর সম্পর্ক! আহসান মঞ্জিলের আসলে কোন জমি ছিল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করার মত। ঢাকার নবাবদের জমির উত্স ছিল ওয়াকফ করা জমি। এসব জমি আসত মুসলমানদের কাছ থেকে। অনেক মুসলমান তাদের জমি ঢাকার নবাবদের ওয়াকফ করে দিতো। এসব জমিই মূলত নবাব পরিবার ভোগ করতো। ঢাকার নবাব ঋণে জর্জরিত ছিল। ফলে ১৯০৫ সালে ইংরেজদের কাছে এক লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়ে বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনে যোগ দেয়। ইংরেজদের দালাল হিসেবে ঢাকার নবাবকে আমাদের ইতিহাস কোনদিন দায়ী করেনি কারণ এখানকার ইতিহাস আগাগোড়া মুসলিম জাতীয়তাবাদ থেকে লেখা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে সরকারের খাস জমিতে ও কিছু হিন্দু জমিদারের দান করা জমিতে। ঢাকায় শিক্ষা বিস্তারে ঢাকার হিন্দু জমিদারদের ভূমিকা আমাদের ইতিহাস হাইড করে ফেলে দেশভাগের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে। শতবর্ষী সমস্ত কলেজ স্কুলগুলোর প্রতিষ্ঠাতা হিন্দু জমিদার, উকিল, সরকারী চাকুরে ব্যক্তিবর্গ। বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর দানে তার পিতার নামে ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জগন্নাথ কলেজ’ যা বর্তমানে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজের ছাত্রদের নিয়ে। এর স্বীকৃতি স্বরূপ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশে কলেজ দুটির নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ছাত্রাবাসের নাম করা হয় যথাক্রমে ‘জগন্নাখ হল’ ‘ঢাকা হল’। ফলে দেখা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকভাবে সলিমুল্লাহকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমিদাতা দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথকে খলনায়ক করে যে ইতিহাস চর্চা এখানে হচ্ছে তার কোন অস্তিত্বই নেই।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতার কোন ইতিহাস নেই। একটি প্রমাণ, দলিল আজ পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারেনি। কোলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে যে সভা হয়েছিলো সেখানে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন না। তখন তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। তাছাড়া ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হোক এটা মুসলমান নেতারাই চাচ্ছিলেন না। কারণ এখানে বিশ্ববিদ্যালয় হলে তার সুফল মুসলমানদের হবে না। ছাত্র তো সব হিন্দু। মুসলমানরা তখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে পারত না। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সরকারের শিক্ষা বাজেটের অনেক অংশ সেখানে চলে যাবে। ফলে স্কুলের ফান্ডে টান পড়বে। এমন কি আলীগড় পর্যন্ত ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হোক চায়নি। প্রফেসর রাজ্জাক সাহেব জানিয়েছেন, দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল শিক্ষকদের অভাবে। শিক্ষকদের ৯৯ জন ছিলেন হিন্দু। তারা চলে যাওয়ায় শিক্ষকের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঠেকাতে বিলেত থেকে শিক্ষক আমদানি করে আনতে হয়েছিল। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষক হওয়ার মত তেমন শিক্ষিত শ্রেণীই গড়ে উঠেনি তখন পর্যন্ত! তাহলে চিন্তা করুন ১৯২১ সালে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে কাদের লাভ হওয়ার কথা? এটা কমনসেন্সের বিষয়।

রবীন্দ্রনাথ তার নোবেল পুরস্কার থেকে পাওয়া টাকার পুরোটা্ পূর্ববঙ্গে বিলিয়ে দেন। কৃষি ব্যাংক খুলে সমস্ত টাকা খুইয়ে দেন কৃষকদের ঋণ দিয়ে। এই ঋষিতুল্য মানুষটিকে নিয়ে বাংলাদেশে সলিমুল্লাহদের হাতে যেভাবে আক্রান্ত হোন তার স্বপক্ষে একটি যৌক্তিক কারণ কোথাও নেই। স্রেফ সাম্প্রদায়িক কারণে এই মহান কবি এখানে লাঞ্ছিত হোন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন এই রকম লেইম তথ্য শেয়ার করে তখন আমারই বলতে ইচ্ছে করে, মুসলমানদের জন্য আবার বিশ্ববিদ্যালয় কেন, ওদের জন্য তো মাদ্রাসা আছে...!

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted