কারা মক্কার বাণিজ্য কাফেলায় হামলা চালিয়ে লুট করেছিল? কারা মুক্তিপণ আদায় করত?

এলাকার এক ছোট ভাই তার বন্ধুকে নিয়ে এসেছে আলাপ করতে। বন্ধুটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। টাকনুর উপরে প্যান্ট ওঠানো। মুখে হালকা দাড়ি। এ দাড়ি সখের না দেখলেই বুঝা যায়। বিশেষ কোন ফিলোসফিকে ফলো করে এই দাড়ি বেড়ে উঠছে। যাই হোক, আপনাদের কাছে ধানাই পানাই না করে মূল আলাপে যাই। তার আগে বলে নেই এই দুজনের আগমণের হেতু। এলাকার ছোট ভাইটি জাকির নায়েকের মুরিদ হব হব করছে কিন্তু তার মধ্যে আগে থেকে সাহিত্য দর্শন ইতিহাস পাঠের যে রুচি গড়ে উঠেছিল সেটি তাকে দ্বিধাগ্রস্থ করে রাখছে এখনো। এসব নিয়ে সে আমার কাছে আলাপ করতে আসে মাঝে মাঝে। আমার কাছে জেনে সে আবার তার এই বন্ধুটির কাছে গিয়ে আলাপগুলো যাচাই করে। সেভাবেই ছোট ভাইয়ের বন্ধুটি আমার সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছুক জানিয়ে সাক্ষাত করতে চেয়েছে। আমিও সানন্দে রাজি হয়েছি। সেই কারণেই আজ তাদের আগমন।

ছোট ভাইয়ের বন্ধুটি প্রশ্ন করল, আপনারা কুরআনে সন্ত্রাসবাদী আয়াত আছে বলে দাবী করেন, এক্ষেত্রে আপনারা সুরা তওবার এই আয়াতটি ব্যবহার করেন, ‘অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের হত্যা কর যেখানে তাদের পাও, তাদের বন্দী কর এবং অবরোধ কর। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে থাক’। …আচ্ছা ভাইয়া, আপনি শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছেন নিশ্চয়। সেখানে তিনি পাকিস্তানীদের ভাতে মারার পানিতে মারার কথা বলেছিলেন না? এটা যদি সন্ত্রাসী ভাষণ না হয় তাহলে ‘মুশরিকদের হত্যা কর যেখানে তাদের পাও’ কেন সন্ত্রাসী কথা হবে? দুটোই তো যুদ্ধের আহ্বান!

আমি একটু স্মিথ হেসে বললাম, ছোট ভাই তুমি বঙ্গবন্ধুর অন্ধ ভক্ত এমন কাউকে দেখেছো জীবনে?

-অবশ্যই দেখেছি। আমার পরিচিতদের অনেকেই তেমন আছেন।

-ওকে, তো তাদের কাউকে কি তুমি দেখেছো পাইপ টানতে আর বলতে যে আমাদের মহান নেতা পাইপ খেতো তাই এটা আমাদের জন্য অবশ্যই পালনীয়। কিংবা বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা মুজিব কোট পরেন কারণ তারা মনে করেন এটা পরা খুবই পূণ্যের কাজ? এরকমটা তারা বলেন না করেনও না। কারণ বঙ্গবন্ধু একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তার রাজনৈতিক আদর্শকে সহমত জানিয়ে তার ভক্ত হয়েছিলেন উনারা, অথবা নিছক ব্যক্তিগত ভাল লাগাই তাদের ভক্ত হবার একমাত্র কারণ। কিন্তু একজন নবীর জীবনকে অনুসরণ করা একজন ধার্মীকের জন্য খুবই পূণ্যের কাজ। নবী যেভাবে খেতেন, যেভাবে কথা বলতেন, যে পোশাক পরতেন, যে খাবার খেতেন সবই তার অনুসারীদের জন্য সুন্নত। এমন কি মধ্যযুগে তখনো টুথব্রাশ আবিষ্কার হয়নি বলে একটা বিশেষ গাছের ডাল দিয়ে তিনি দাঁত মাজতেন বলে এই আধুনিক যুগেও তার অন্ধ ভক্তরা ব্রাশ ফেলে গাছের ডাল দিয়ে দাঁত মাজে!...

-ভাইয়া ৭ মার্চের ভাষণটা…

-বলছি শোন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে ভাতে মারার, পানিতে মারার কথাটা পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রতিরোধের কথা বলা হয়েছে। এই জল হাওয়ার বাংলায় এসে পাঞ্জাবী সৈনিকদের জন্য আমরা পরিস্থিতি কঠিন করে তুলব তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি ভাষণে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার কথা বলেছেন। অর্থ্যাৎ প্রতিরোধ গড়ার কথা বলেছেন। এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে বলেছেন। এখানে পুরোটাই প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা বলছেন। কাজেই তোমার প্রথম অভিযোগ ভুল, ৭ মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধু কোন রকম সন্ত্রাসের উশকানি দেন নাই। কিন্তু সুরা তওবায় ওঁত পেতে বসে থাকতে বলেছেন হত্যা করার জন্য, যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই। এখানে কি প্রতিরোধ করতে বলা হয়েছে? না বলা হয়নি।

-এটা তো আরবের মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে একজন সেনা নায়েকের যে আহ্ববান সেটাই কুরআনে বলা হয়েছে। মুশরিক আরবরা মুসলমানদের উপর জুলুম অত্যাচার শুরু করেছিল। সেই জুলুম থেকে বাঁচতে মুসলমানরা যুদ্ধ করে নিজেদের স্বাধীন করেছে। তো যুদ্ধে একজন সেনা নায়ক কি বলেন, বলেন শত্রু পক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ো। তাদের যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করো। সেকথাই কুরআনে সুরা তওবায় আল্লাহ মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলছেন।

-দেখো, ৭ মার্চের ভাষণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান ছিল সত্য। কিন্তু এই ভাষণটি এখন স্রেফ ইতিহাসের অংশ মাত্র। আমরা স্বাধীন হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে এখন আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে। সার্কে বাংলাদেশ পাকিস্তান পরস্পর সহযোগী রাষ্ট্র। তাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি এখন আমাদের জাতিগত সম্পদ, ইতিহাসের অংশ মাত্র। তিনি নবী ছিলেন না। উনার উপর কোন ঐশ্বিগ্রন্থ নাযিল হয়নি। এমন না এই ভাষণটি ঐ ঐশ্বিগ্রন্থে লেখা রয়েছে এবং সেই ভাষণটির ভাষ্য তার অনুসারীদের জন্য জীবন বিধান। কাজেই কুরআনের বাণীর সঙ্গে অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থের বাণীর তুলনা চলে। তা না করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে কুরআনের সুরার সঙ্গে তুলনা করে অত্যন্ত কাঁচা একটা কাজ করেছো। 

-আচ্ছা, ভাষণ বাদ দেন, মুসলমানরা কি আত্মরক্ষার্থেও যুদ্ধ করতে পারবে না?

একটা সিগারেট ধরিয়ে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠিটা স্ট্রেতে রেখে বললাম, আয়াতটা যদি ভাল করে পড়ে থাকো তাহলে খেয়াল করেছো কি, শুরুতে কি বলা হয়েছে- ‘অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে’- এর মানে কি? এর মানে আরব পৌত্তলিকদের ধর্ম বিশ্বাস ছিল ১২ মাসের মধ্যে বিশেষ চারটি মাস হচ্ছে নিষিদ্ধ মাস বা পবিত্র মাস তাদের দেবতাদের কাছে। এই মাসগুলোতে আরবের কোন গোত্রই যুদ্ধ বিগ্রহ রক্তপাতে জড়াতো না। এই সময় সব আরব গোত্র নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করত। মজাটি কি জানো, পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা ইসলামের আল্লাহ কি করে পৌত্তলিক কাফেরদের এইসব ‘পবিত্র মাসের’ বিশ্বাসকে নিজেও পবিত্র বলে গোণ্য করেন? তিনি না ইব্রাহিম নবী মাবুত! তিনি না মুসা ঈসার মাবুত? কই তুমি একজনও ইহুদী খ্রিস্টানকে পাবে যারা বিশেষ আরবি চারটি মাসকে পবিত্র বা নিষিদ্ধ বলে মান্য করে বা সেসময় করত? পাবে না। সুরা তওবাতে দেখবে ৩৬ নম্বার আয়াতে বলা হচ্ছে চারটি পবিত্র মাস আল্লার কাছেও অতি পবিত্র! যাই হোক, এই প্রসঙ্গে চলে গেলে অন্য আলাপ শুরু হয়ে যাবে। তাই প্রসঙ্গে ফিরি। তো বলছিলাম ‘অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে’- তারপর কি বলা হয়েছে ‘মুশরিকদের যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করবে’ –তাই তো? তাহলে এবার তুমিই বলো, এই আক্রমণের উশকানিটা কি আত্মরক্ষার্থে হয়েছিল? যে চারটি মাসে হত্যা রক্তপাত নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগুলো অতিবাহিত হয়ে গেলে মুসলমানদের বলা হচ্ছে মুশরিকদের জন্য গোপনে ওঁত পেতে থাকো আক্রমন করা জন্য। এবং বলা হচ্ছে, এই চারটি মাস মুশরিকরা স্বাধীনভাবে জমিনে ঘুরাঘুরি করুক, তারপরই তাদের ধরে ধরে জবাই করা হবে। তুমি কি এটাকে আত্মরক্ষা বলবে? কিংবা ‘যুদ্ধ’ তাও কি বলতে পারবে? তুমি কখনো শুনেছো যুদ্ধে আঁততায়ীর মত পিছন থেকে আঘাত করা হয়? এটা যুদ্ধের নিয়মের বিরুদ্ধে। তুমি এটাকে যুদ্ধের কাতারেই ফেলতে পারো না! এটা স্রেফ চোরাগুপ্তা হামলা। ইবনে কাথির এই আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে বলেছেন, তোমাদের এই অনুমতি দেয়া হচ্ছে না যে তোমরা কেবল মুশরিকদের সামনে পেলেই হত্যা করবে, বরং তোমাদের অনুমতি দেয়া হচ্ছে তাদেরকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করবে। তাদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করবে…। আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি ইবনে কাথিরের সুরা তওবার তাফসির খুলে মিলিয়ে নিয়ো…।

ছোকরা আমার কথায় মাথা নাড়তে লাগলো অসন্তুষ্ঠিতে। অস্বস্তির সঙ্গে বলল, আহা, মক্কার কাফিররা মুসলমানদের সঙ্গে যে নির্বিচারের অত্যাচার চালিয়েছে তার প্রতিশোধ নিবে না? মুসলমানরা যদি মুখ বুজে থাকত তাহলে তাদের অস্তিত্ব ততদিনে আর অবশিষ্ঠ থাকত না। এটা আপনাকে মাথায় রাখতে হবে।

-আমি মাথায় রেখেছি। এটা যদি আরব জাতির কোন সাধারণ যুদ্ধের ইতিহাস হতো কথা ছিল। কিন্তু আমরা কথা বলছি একটা ঐশ্বিগ্রন্থের বাণী নিয়ে। যে গ্রন্থকে একটি বিশেষ সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যেটা তাদের জন্য ডাইরেক্ট ঈশ্বরের তরফ থেকে এসেছে। এবং এই বইয়ের প্রতিটি বাক্যকে অনুসরণ করাই হচ্ছে তাদের পরকালের জান্নাতের একমাত্র পথ। কাজেই সেই গ্রন্থে একটি তুচ্ছ মারামারি ঝগড়াবিবাদের ঘটনা কেন স্থান পাবে? কেন প্রায় পনের’শ বছর পরও আজকের আধুনিক মানুষকে ‘যেখানে পাও হত্যা করো’ সুর করে আওড়াতে হবে? তুমি কি জানো, মুসলমানদের কিয়ামত পর্যন্ত জিহাদ করতে বলা হয়েছে কাফেরদের বিরুদ্ধে? তার মানে সুরা তওবার ‘মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা করো’ প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি? 

-দেখুন ভাইয়া, আপনারা সুরা তাওবা এই আয়াতটুকু কেটেছেটে সন্ত্রাসী আয়াত বানানোর চেষ্টা করেন অথচ শেষটুকু উল্লেখ করেন না। তওবার ৫ নম্বর আয়াতে ‘যেখানে পাও হত্যা করো’- পরে বলা আছে- ‘কিন্তু যদি তারা তওবা করে, নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’। তার মানে দেখুন, এখানে ক্ষমা করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এটা আপনারা কেন উল্লেখ করেন না?

-প্রথম কথা হচ্ছে, ৭ মার্চের ভাষণের সঙ্গে তুলনা করে তুমিই কিন্তু বুঝাতে চাইছিলে সুরা তওবার কুপাকুপিতে কোন দোষ নাই। এটা নাকি যুদ্ধে শত্রুদের বিরুদ্ধে একজন সেনানায়কের আহ্ববান মাত্র। কিন্তু এখন দোষ চাপাচ্ছো আমাদের উপর। যাই হোক, তুমি যে অংশটুকু এখন বললে ‘যদি তারা তওবা করে, নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও’ এই লাইনগুলি সোজা সরলভাবে নিলেও খেয়াল করে দেখো এখানে কি বলা হচ্ছে, যদি নামাজ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে… তার মানে এখানে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হওয়ার শর্ত দিয়ে তাদের মুক্তি দেবার কথা বলা হচ্ছে। এবার তুমি বলো, এটা কি ধরণের উদারতার নমুনা? এটা কি জোর জবরদস্তি ধর্ম চাপিয়ে দেয়া নয়? এটা কি ধরণের ধর্ম প্রচার? আরেকটা জিনিস দেখো তুমি প্রথম থেকে বলতে চেয়েছো, আরবের কাফেররা মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার শুরু করেছিল বলে তার পাল্টা জবাব মুসলমানরা দেয়া শুরু করেছিল। তাহলে সুরা তওবা ২৯ নম্বর আয়াত বিষয়ে কি বলবে যেখানে বলা হয়েছে ‘তোমরা যুদ্ধ কর আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম, যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিযিয়া প্রদান করে’। এই আহলে কিতাবী বলতে ইহুদী-খ্রিস্টানদের বুঝানো হয়। তা মক্কায় মুসলমানরা কি ইহুদী-খ্রিস্টানের বাধার সম্মুখিন হয়েছিলো? হিযরত করে মদিনায় আসার পর মদিনার ইহুদী-খ্রিস্টানরাই প্রফেটকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। মদিনার প্রথম মসজিদের জায়গা বিনামূল্যে দান করেছিল ইহুদিরাই। এবার আয়াতের ভাষাটা খেয়াল করো, এখানে কি হামলা আক্রমণের সরাসরি আহ্বান জানানে হচ্ছে না শুধুমাত্র ইসলামের ধর্মের সাথে একমত না হওয়ার কারণে। কেবল মাত্র হযরত মুহাম্মদকে নবী বলে স্বীকার না করার কারণে। আরেকটা কথা, বার বার যে বলছ মক্কাতে মুসলমানদের অত্যাচার করা হতো- তা আসলে কতটা সত্য আর অতিরঞ্জিত? ইসলাম ঘোষণার প্রথম তের বছর আরবের পৌত্তলিকরা কি চাইলেই মুহাম্মদকে হত্যা করতে পারত না? তার তো তখন সেনা বাহিনী নেই যে পাহাড়া দিয়ে রাখবে। তাহলে কেন হত্যা করেনি? কারণ মুহাম্মদ হাশিমি বংশের লোক ছিল। তাকে হত্যা করার মনোভাব অনেকেই করত পৌত্তলিক ধর্মকে বিকৃত করার অভিযোগে কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করতে পারত না কারণ তাতে বণু হাশিম বংশ তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। যতই মুহাম্মদ বাপ-দাদার ধর্মকে বিকৃত করুক, তার উপর হামলা হলে রক্তঋণ হাশিমিরা উশুল করে ছাড়ত। এর প্রমাণ পাবে সিরাত ইবনে হিশাম পাঠ করলে। আরেকটা দিক দেখো, মদিনায় জীবন হাতে নিয়ে হিযরত করার যে কথা বলা হয় সেটাকে সত্য ধরে নিলে আমাদের বিশ্বাস করতে হয় মক্কা দখল করার পরই বুঝি প্রফেট মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু আমরা দেখি তিনি তার আগেই হজ করতে মক্কায় তার দলবল নিয়ে হাজির হোন এবং তার নিজস্ব নিয়মে হজ পালন করেন। এমনকি তিনি আবু বকর আর আলীকে পাঠিয়ে হজ মৌসুমে প্রচার করতে বলেন যে, আগামী বছর পর থেকে মুশরিকদের তিনি এই স্থান থেকে চিরতরে বিতাড়িত করবেন। এবার বলো তো, মক্কা ১৩ বছর আরব পৌত্তলিকদের হাতে কয়জন মুসলমান খুন হয়েছিলো? একজনও না! আর যুদ্ধ হাঙ্গামা কারা বাধিয়েছিল? কারা মক্কার বাণিজ্য কাফেলায় হামলা চালিয়ে লুট করেছিল? কারা মুক্তিপণ আদায় করত?

ছোকরার মুখ একদম লাল হয়ে উঠেছে। ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ উত্তেজিত বুঝা যাচ্ছে। সেই উত্তেজনার বশেই এই প্রথমবার সে আমাকে ‘আপনারা নাস্তিকরা’ বলে সম্বধন করে বলল, দেখুন আপনারা নাস্তিকরা প্রায়ই কুরআনের একটি আয়াতকে অন্য একটি আয়াতের সঙ্গে কন্ট্রাডিক্টরি বা সাংঘর্ষিক বলে দাবী করেন। অথচ আপনারা কোনদিন সুরা তওবার ‘তোমরা মুশরিকদের যেখানে পাও সেথানে হত্যা করো’ এটাকে সুরা মায়দার ‘যদি কেউ নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করল সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল’ এটার সাথে কন্ট্রাডিক্টরি বলতে দেখি না। কেন বলেন না? কারণ এ দুটোকে এক করে বলতে গেলেই নাস্তিকরা ধারা পড়ে যাবে- তাই না ভাইয়া?

ছোকরা আমাকে একটু টিজ করল শেষটুকু বলতে গিয়ে। আমি ফের স্মিথ হাসলাম। বললাম, তোমাদের বোকা বানাতে গিয়ে কি ছকটাই না কাটা হয়েছে ভেবে বিস্মিত হই। তোমাদের কোন দোষ নেই। ধড়িবাজ ইসলামি লেকচারাররাই আয়াত কাটছাট করে তোমাদের বোকা বানায় আর নাস্তিকদের আয়াত বিকৃতির জন্য দায়ী করে। যাই হোক, এবার তোমার কথার জবাবে বলি, সুরা মায়দার যে অংশটুকু তুমি বললে সেটা কিন্তু সুরা মায়দার বক্তব্য না। এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন তিনি ইহুদীদের তাওরাতে ঐ কথাগুলো লিখে দিয়েছিলেন। আমি পুরো আয়াত বলি শোন- “এ কারণেই আমি বনী-ইসলাঈলের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে। তাদের কাছে আমার পয়গম্বরগণ প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছেন…”(সূরা মায়েদা: ৩২)। অর্থ্যাৎ দাবী করা হচ্ছে এই কথা ইহুদীদের ঐশ্বিগ্রন্থে আল্লাহ ইহুদীদের উপদেশ দিয়েছিলেন। এ কারণেই বলছেন, আমার পয়গম্বরগণ প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছেন। কুরআন কিন্তু এরকম উক্তি মুসলমানদের পালন করতে নির্দেশ করেননি। করেনি যে সেটা প্রমাণ করার আগে কুরআনের ছোট্ট একটা ভুল ধরিয়ে দেই। কুরআনে আল্লাহ ‘যদি কেউ নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করল সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল’ বলে যেটা তিনি ইহুদীদের লিখে পাঠিয়েছিলেন মুসা নবীর উপর নাযিল হওয়া তাওরাতে দাবী করেছেন সেটি আসলে ইহুদীদের ‘তালমুদ’ নামের একটি ধর্মীয় বইয়ের উক্তি। এই বইটি ইহুদীদের তাওরাত নয়। অথ্যাৎ ইহুদীদের ঐশ্বিগ্রন্থ নয়। অনেকটা আমাদের দেশে মাওলানারা যে রকম ইসলামী বই লেখেন সেরকম একটি বই। সেটাই কুরআনে আল্লাহ’র উক্তি হিসেবে এসেছে। তালমুদের উক্তিটা আমি তোমাকে বলি তুমি সুরা মায়দার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ো- ‘যে একটি আত্মাকে ধংস করে সে যেন পুরো পৃথিবী ধংস করে, আর যে একটি আত্মাকে রক্ষা করে সে যেন পুরো পৃথিবীকে রক্ষা করে (Jerusalem talmud sanhedrin 4:1)। আমাকে এবার তুমি বলো, এতবড় ভুল আল্লাহ কি করে করল? এটা তো তাওরাতে জিহোবার কথা নয়! এবার আসো আসল বিষয়ে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই সুরা মায়দার ৩২ নম্বর আয়তটি চরম শান্তির কথা বলা হয়েছে তাহলে এর ঠিক পরের ৩৩ নম্বর আয়াতটিকে কি বলবে? আমি তোমাকে শোনাচ্ছি সুরা মায়দার ৩৩ নম্বর আয়াতে কি বলা হচ্ছে, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং যমীনে ফাসাদ করে বেড়ায়, তাদের আযাব কেবল এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে কিংবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে। এটি তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্ছনা এবং তাদের জন্য আখিরাতে রয়েছে মহাআযাব। (সূরা মায়েদা: ৩৩)”।

সিগারেটের শেষ অংশটুকু স্ট্রেতে গুজে দিয়ে আমি একটু দম নিলাম। ছোকরার মাথার চুল তখন খাড়া হয়ে গেছে! মুখ তেলতেলে, রক্তিম…। দুর্বলভাবে কিছু বলতে চাইছিল। তাকে থামিয়ে বললাম, আমি শেষ করে এনেছি, তারপর তুমি বলো। …এই যে মায়দার ৩৩ নম্বর আয়াতটা বললাম, ইবনে কাথিরের সুরা মায়দার তাফসিরে গিয়ে দেখবে, ধর্মত্যাগীদের শাস্তি যে তাদের ধরে হত্যা করে ফেলতে হবে সেটা এই আয়াতকে দলিল ধরেই ইসলামী আইন তৈরি করা হয়েছে। নবী নিজে মদিনাতে ধর্মত্যাগীদের পিছন থেকে হাত-পা কেটে ফেলেন এবং চোখে গরম শলকা ভরে দেন! …ভেবে দেখো সারাবিশ্বে জঙ্গিবাদের যারা তাত্ত্বিক নেতা তারা কিন্তু কুরআন-হাদিস থেকেই রেফারেন্স নিয়ে জিহাদের প্রেরণা দিচ্ছেন। এইসব তাত্ত্বিকদের সকলেরই রয়েছে ইসলামের উপর উচ্চ পর্যায়ের পড়ালেখা। তারা কেউ নিজের মনগড়া কিছু বলেন না। কিন্তু যখনই জঙ্গিবাদের কারণে ইসলাম ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠা শুরু করে তখন এক শ্রেণীর ধড়িবাজ ইসলামপন্থি সুরা মায়দার ৩২ নম্বর আয়াত ‘যদি কেউ নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করল সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল’ উদ্ধৃতি করে দেখাতে চান ইসলামে কোন হত্যা রক্তপাতের কথা নেই। তারা কিন্তু পরের ৩৩ নম্বর আয়াতটা এড়িয়ে যান। আর চালাকি করে ৩২ নম্বর আয়াতে ইহুদীদের উদ্দেশ্যে বলা কথাটা মুসলমানদের বলে চালিয়ে দেয়। আর তোমাকে তো বললামই ওটা তালমুদের উক্তি যেটা মোটেই ইহুদীদের জিহোবার কথা নয়!... এবার বলো তুমি কি বলতে চাও…।

ছোকরা তখন উত্তজিত হয়ে উঠেছে। নিজের মাথার চুল খামচে ধরে বলল, আপনি যদি এতই জানেন তাহলে জাকির নায়েকের সাথে বিতর্ক করেন না কেন?

এবার আমি হো হো করে হেসে ফেললাম। ছেলেটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। হাত কচলাতে লাগল। তাকে এভাবে বিব্রত করতে চাইনি। ছোকরা জিততে এসেছিল। একদল প্রতারক ধার্মীক তাদেরকে যেভাবে বুঝিয়েছে তারা সেভাবেই বুঝেছে। তার তো কোন দোষ নেই। তাকে দেখে এখন মায়াই লাগছে…। 

(বই: ইসলামের নয়কাহান, সুষুপ্ত পাঠক, পৃষ্ঠা ১৭-২৬)

©সু ষু প্ত

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted