শ্রীশঙ্করাচার্যের 'দশনামী সন্ন্যাসী'
মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ১৪১ অধ্যায়ে ভগবান শিব দেবী পার্বতীকে মােক্ষধৰ্ম বা সন্ন্যাসধর্মের বিস্তৃত বর্ণনা করেছেন। ভগবান শিব বলেন, ধর্মীয় আচরণ দ্বারা মােক্ষলাভ হয়, সেই ধর্মীয় আচরণকে ধর্মের নিবৃত্তি লক্ষণ বলে। এক রাত্রির অধিক কাল এক গ্রামে বাস না করা, সমুদায় জীবের প্রতি দয়া প্রকাশ ও আশারূপ পাশ হতে মুক্তিলাভ করাই সন্ন্যাসীর একান্ত কর্তব্য। নিবৃত্তির পন্থা অবলম্বনকারী সন্ন্যাসী কমণ্ডলু, উদক, বিলাসী পরিধেয় বস্ত্র, আসন, ত্রিদণ্ড, শয্যা, অগ্নি এবং সন্ন্যাসী হয়েও গৃহের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রাখা কখনও কর্তব্য নয়। সন্ন্যাসী বীতস্পৃহ, স্নেহাদিবন্ধনবিমুক্ত ও সংযতচিত্ত হয়ে সৰ্বদা বৃক্ষমূল, শূন্যগৃহ ও নদীর তীর প্রভৃতি নির্জন স্থানে অবস্থান পূর্বক সর্বদা পরমাত্মতত্ত্ব চিন্তা করবে। সন্ন্যাস ধর্ম অবলম্বন পূর্বক নিরাকার ও স্থাণুস্বরূপ হয়ে আত্মচিন্তা করলে দ্রুতই মােক্ষলাভ হয়। এক গ্রাম বা এক নদীতীরে বহুদিন বসবাস করা সন্ন্যাসীর কদাপি কর্তব্য নয়। মােক্ষার্থী সাধু ব্যক্তিদিগের পক্ষে এই বেদোক্ত ধৰ্ম অত্যন্ত সৎপথস্বরূপ। যে ব্যক্তি এই পথে অগ্রসর হন তিনি কখনই সংসারসাগরে পতিত হন না। মােক্ষপথ অবলম্বনকারী সন্ন্যাসীরা কুটীচক, বহুদক, হংস ও পরমহংস এই চারি শ্রেণীতে বিভক্ত। এদের মধ্যে কুটীচক অপেক্ষা বহূদক, বহূদক অপেক্ষা হংস ও হংস অপেক্ষা পরমহংস শ্রেষ্ঠ। এ নিবৃত্তিধৰ্ম অপেক্ষা সুখ, দুঃখ, জরা ও মৃত্যু নিবারণের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় আর কিছুই নেই।
"হংসঃ পরমহংসশ্চ কুটীচকো বহুদকঃ।
ইতি চতুর্বিধাঃ প্রোক্তাঃ ন্যাসিনস্তু বিবেকিভিঃ।।
বিবেকীরা হংস, পরমহংস, কুটীচক ও বহুদক- বৈরাগ্যের তারতম্য অনুসারে চারপ্রকার সন্ন্যাসের বিধান দিয়েছেন। এ সন্ন্যাসীরা হলেন :'হংস', 'পরমহংস', 'কুটীচক' ও 'বহুদক'। যে তীব্র বৈরাগ্যবান সন্ন্যাসীর শরীর তীর্থযাত্রাদি করতে অসর্মথ। তিনি তখন নিজ কুটিরে বাস করে সাধন ভজন করেন, তাঁকে 'কুটীচক-সন্ন্যাসী' বলে। ঐরূপ বৈরাগ্যবান্ পুরুষ যাঁর তীর্থপর্যটনাদির সামর্থ্য আছে, তাঁকে 'বহুদক-সন্ন্যাসী' বলে। তীব্রতর বৈরাগ্যবান্ পুরুষকে 'হংস-সন্ন্যাসী' বলে। প্রত্যগাত্মজ্ঞান লাভ করতে তিনগুণের পরিণামরূপ ইহলৌকিক ও পরলৌকিক সর্ববিষয়ে যিনি তৃষ্ণারহিত্যরূপ পরবৈরাগ্য লাভ করেছেন তাঁকে 'পরমহংস-সন্ন্যাসী' বলে।এ চতুর্বিধ সন্ন্যাসীদের পক্ষে দশটি সাধারণ ব্রত আবশ্য পালনীয়। যথা- অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ, অক্রোধ,গুরুশুশ্রুষা, শৌচ, নিষিদ্ধ আহার পরিত্যাগ এবং কায়মনোবাক্যদ্বারা প্রমাদবর্জন।
মহাভারতে বর্ণিত এ চারপ্রকার সন্ন্যাসীদের ভিত্তিকে অবলম্বন করে বৈদিক ধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে শ্রীশঙ্করাচার্য দশপ্রকার সন্ন্যাসী সঙ্ঘ গড়ে তোলেন। শ্রীশঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত সরস্বতী, ভারতী, পুরী, বন, অরণ্য, তীর্থ, আশ্রম,গিরি, পর্বত এবং সাগর -এ দশপ্রকার সন্নাসীদের 'দশনামী-সন্ন্যাসী' নামে অবিহিত করা হয়। আলস্য ত্যাগ করে এ দশনামী-সন্ন্যাসীদের সদা সক্রিয় থাকার আদেশ দিয়েছেন শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর মঠানুশাসনে। ধর্মরক্ষার্থে তাঁর সকল সাঙ্গঠনিক রূপরেখা পাওয়া যায় মঠানুশাসনের শ্লোকগুলাতে।
যত বিনষ্টির্মহতী ধর্মস্যাত্র প্রজায়তে।
মান্দ্যং সন্ত্যাজ্যমেবাত্র দাক্ষ্যমেব সমাশ্রয়েৎ।।
ন জাতু মঠমুচ্ছিদ্যাদধিকারিণ্যুপস্থিতে।
বিঘ্নানামপি বাহুল্যাদেষ ধর্ম সনাতনঃ।।
(মঠানুশাসনম্ : ৫, ১১)
"হে আমার সন্ন্যাসীবৃন্দ ( দশনামী), এই সময়ে ধর্মের মহতী হানি হয়েছে, তাই এই সময়ে সন্ন্যাসীদের ধর্মপ্রচারে মন্থরতা অবশ্য পরিত্যাজ্য। ধর্মপ্রচারে সর্বদা দক্ষতার আশ্রয় করবে অর্থাৎ আলস্য ত্যাগ করে ধর্মপ্রচারে সদা তৎপর হবে।
হে সন্ন্যাসীবৃন্দ তোমাদের বলছি, ধর্মপ্রচারে বিঘ্ন যতই অধিক হোক, উপযুক্ত অধিকারী, যথোক্ত গুণসম্পন্ন আচার্য থাকলে, কেউ কখনও আমার মঠ উচ্ছেদ করতে পারবে না। যেহেতু আমাদের ধর্মই সনাতন। অর্থাৎ উপযুক্ত উপদেশকেই সনাতন ধর্মের রক্ষক এবং ধর্মের প্রচারে উপযুক্ত উপদেশকের অভাব হইলে সেই মঠ অকর্মণ্য।"
শ্রীশঙ্করাচার্য চিন্তা করেছেন, এক প্রকারের সন্ন্যাসী দিয়ে সকল শ্রেণির মানবের কাছে বৈদিক ধর্মের প্রচার অসম্ভব। শ্রীশঙ্করাচার্য অধ্যাত্ম পথের পথিক এবং সাধারণ গৃহীদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষা দানের জন্য চার মঠের অন্তর্ভূক্ত একদল সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেন। ফলে ভারতবর্ষে তৈরি হয় শক্তিশালী এক সন্ন্যাসী সম্প্রদায়। ভারতবর্ষের অধিকাংশ ধর্মীয় মত, পথের সংগঠন এ চারমঠ এবং দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত। সন্ন্যাসীর আত্মপরিচয় এই পর্যায়ে স্বামী বিবেকানন্দের বিবরণ থেকে জানা যায় ‘শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ’ শ্রীপাদ শঙ্করাচার্যের শৃঙ্গেরী মঠের অধিভূক্ত একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান।গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতের প্রাণপুরুষ শ্রীগৌরাঙ্গদেব দুজন গুরুর কাছে মন্ত্রদীক্ষা এবং সন্ন্যাস নিয়েছিলেন; তাঁরা হলেন শ্রীঈশ্বরপুরী এবং শ্রীকেশব ভারতী। তাঁরা দুজনেই শৃঙ্গেরী মঠভূক্ত সন্ন্যাসী। এমনকি যে নামে শ্রীগৌরাঙ্গদেব আমাদের মাঝে খ্যাত ‘শ্রীচৈতন্য’; এই ‘চৈতন্য’ নামটি শৃঙ্গেরীমঠভূক্ত ব্রহ্মচারীদের উপাধি। অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যও শ্রীশঙ্করাচার্যের দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের পরম্পরাগত সন্ন্যাসী। বঙ্গের স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজের 'ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ', নিগমানন্দ পরমহংসদেবের 'আসাম বঙ্গীয় সারস্বত মঠ' এর সন্ন্যাসীরাও শ্রীশঙ্করাচার্যের দশনামী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
বিভিন্ন প্রকারের সন্ন্যাসী স্থান-কাল-পাত্র ভেদে শাশ্বত ধর্মের প্রচার করবে। যিনি 'গিরি-সন্ন্যাসী' তিনি পার্বত্য গিরিগুহায় বাস করে গম্ভীর ও স্থিরবুদ্ধি হয়ে সর্বদা গীতার চর্চা করবেন। যিনি 'পর্বত-সন্ন্যাসী' তিনি পর্বতমূলে বসবাস করে দৃঢ়জ্ঞান ধারণ করে নিত্য ও অনিত্য বিষয় অবগত হবেন। তত্ত্ববিষয়ে সাগরের মত যিনি গম্ভীর, জ্ঞানরূপ রত্নকে যিনি ধারণ করেন এবং বৈদিক শাস্ত্রকে যিনি লঙ্ঘন করেন না, তাঁকে 'সাগর-সন্ন্যাসী' বলে।যিনি সর্বদা বেদের স্বরজ্ঞানে রত, স্বরোচ্চারণে দক্ষ, কবিশ্রেষ্ঠ এবং অসার সংসার সাগরের হন্তা তাঁকেই 'সরস্বতী-সন্ন্যাসী' বলে। যিনি সকল ভার পরিত্যাগ করে বিদ্যাভারের দ্বারা পরিপূর্ণ; কোন প্রকার দুঃখভার যাঁকে স্পর্শ করতে পারে না তাঁকে 'ভারতী-সন্ন্যাসী' বলে। অখণ্ড জ্ঞানতত্ত্বে পরিপূর্ণ হয়ে সর্বদা পরব্রহ্মেপদে যিনি অবস্থিত, তাঁকেই 'পুরী-সন্ন্যাসী' বলে। যিনি তৎ, ত্বং এবং অসি এ ত্রিপদরূপ ত্রিবেণীসঙ্গম তীর্থে স্নান করেন, তাঁকে 'তীর্থ-সন্ন্যাসী' বলে।যিনি সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণে সামর্থ্যবান আশারূপ পাশ বিবর্জিত ও সংসারের গতাগতি বিরহিত, তাঁকে 'আশ্রম-সন্ন্যাসী ' বলে। রমণীয় নির্জনস্থানরূপ বনে বাস করে যিনি সমস্ত আশাবন্ধন হইতে নির্ম্মুক্ত হন, তাঁকেই 'বন-সন্ন্যাসী ' বলা হয়। এ সমুদায় বিশ্ব পরিত্যাগ করে আনন্দময় নন্দনবন সদৃশ অরণ্যে যিনি সর্বদা বাস করেন, তাঁকে 'অরণ্য-সন্ন্যাসী' বলে।
১.গিরি:
বাসো গিরিবনে নিত্যং গীতাধ্যয়নতৎপরঃ ।
গম্ভীরাচলবুদ্ধিশ্চ গিরিনামা স উচ্যতে॥(জ্যোতির্মঠান্নায়:৬)
"যিনি পার্বত্য গিরিকাননে বাস করে সর্বদা গীতা অধ্যয়ন করেন; গম্ভীর ও স্থিরবুদ্ধি, তাঁকেই 'গিরি' নামে অবিহিত করা হয়।"
২.পর্বত:
বসন্ পর্বতমূলেষু প্রৌঢ়ং জ্ঞানং বিভর্তি যঃ ।
সারাসারং বিজানাতি পর্বতঃ পরিকীর্ত্যতে ॥(জ্যোতির্মঠান্নায়:৭)
"যিনি পর্বতমূলে বাস করে দৃঢ়জ্ঞান ধারণ করেন, যিনি সার (নিত্য) ও অসার (অনিত্য) বিষয় সম্যক জানেন, তাঁকেই 'পর্বত' বলে অভিহিত করা হয়।"
৩.সাগর:
তত্ত্বসাগরগম্ভীরো জ্ঞানরত্নপরিগ্রহঃ।
মর্যাদাং নৈব লঙ্ঘ্যেত সাগরঃ পরিকীর্ত্যতে ॥ (জ্যোতির্মঠান্নায়: ৮)
"যিনি তত্ত্ববিষয়ে সাগরবৎ গম্ভীর, যিনি জ্ঞানরূপ রত্নের ধারণ করেন এবং বৈদিক শাস্ত্রমর্যাদা লঙ্ঘন করেন না; তাঁকেই 'সাগর' বলে অভিহিত করা হয়।"
৪.সরস্বতী:
স্বরজ্ঞানরতো নিত্যং স্বরবাদী কবীশ্বরঃ।
সংসারসাগরাসারহন্তাসৌ হি সরস্বতী॥
(শৃঙ্গেরীমঠান্নায়:৬)
"যিনি সর্বদা বেদের স্বরজ্ঞানে রত, স্বরোচ্চারণে দক্ষ ও কবিশ্রেষ্ঠ এবং অসার সংসার সাগরের হন্তা; তাঁকেই 'সরস্বতী' বলে।"
৫.ভারতী:
বিদ্যাভরেণ সম্পূর্ণঃ সর্বং ভারং পরিত্যজন্ ।
দুঃখভারং ন জানাতি ভারতী পরিকীর্ত্যতে ॥(শৃঙ্গেরীমঠান্নায়:৭)
"যিনি সকল ভার পরিত্যাগ করে বিদ্যাভারের দ্বারা পরিপূর্ণ; এজন্য দুঃখভারকে জানেন না, তাঁকেই 'ভারতী' বলে।"
৬.পুরী:
জ্ঞানতত্ত্বেন সম্পূর্ণঃ পূর্ণতত্ত্বপদে স্থিতঃ ।
পরব্রহ্মরতো নিত্যং পুরীনামা স উচ্যতে॥(শৃঙ্গেরীমঠান্নায়: ৮)
যিনি জ্ঞানতত্ত্বের দ্বারা পরিপূর্ণ, পূর্ণব্রহ্মপদে অবস্থিত এবং নিত্য পরব্রহ্মে নিমগ্ন ; তাঁকেই 'পুরী' বলে।
৭.তীর্থ:
ত্রিবেণীসঙ্গমে তীর্থে তত্ত্বমস্যাদিলক্ষণে ।
স্নায়াত্তত্ত্বার্থভাবেন তীর্থনাম্না স উচ্যতে ॥(শারদামঠান্নায়: ৬)
"যিনি তত্ত্বমস্যাদিরূপ (তৎ, ত্বং,অসি) ত্রিবেণীসঙ্গমতীর্থে তত্ত্বার্থভাবে স্নান করেন অর্থাৎ তত্ত্বমস্যাদিপ্রতিপাদ্য বস্তু অবগত ; তাঁকেই 'তীর্থ' বলে।"
৮.আশ্রম:
আশ্রমগ্রহণে প্রৌঢ় আশা-পাশ-বিবর্জিতঃ।
যাতায়াতবিনির্মুক্ত এষ আশ্রম উচ্যতে ॥ (শারদামঠান্নায়:৭)
"যিনি সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণে সামর্থ্যযুক্ত, যিনি আশারূপ বন্ধনশূন্য ও সংসারের গতাগতি বিরহিত; তাঁকেই 'আশ্রম' বলে।"
৯. বন:
সুরম্যে নির্জনে স্থানে বনে বাসং করোতি যঃ।
আশাবন্ধবিনির্মুক্তো বননামা স উচ্যতে॥ (গোবর্দ্ধনমঠান্নায়:৬)
"যিনি অতি রমণীয় নির্জনস্থানরূপ বনে বাস করে সমস্ত আশাবন্ধন হইতে নির্মুক্ত ; তাঁকেই 'বন' বলে অভিহিত করা হয়।
১০. অরণ্য:
অরণ্যে সংস্থিতো নিত্যমানন্দে নন্দনে বনে ।
ত্যক্ত্বা সর্বমিদং বিশ্বমরণ্যং পরিকীর্ত্যতে ॥(গোবর্দ্ধনমঠান্নায়:৭)
"সমগ্র বিশ্ব পরিত্যাগ করে যিনি সর্বদা আনন্দময় নন্দনবন সদৃশ অরণ্যে বাস করেন; তিনিই 'অরণ্য' নামে কীর্তিত।"
বৈদিক এবং পৌরাণিক যুগ পরবর্তীতে হিন্দু জাতিকে প্রথম একটি সাংগঠনিক রূপ দেন শ্রীশঙ্করাচার্য। তিনিই প্রথম সনাতন ধর্ম রক্ষায় সঙ্ঘের পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেন। অবশ্য সঙ্ঘের ধারণা প্রাচীনকাল থেকে ছিল, কিন্তু তা ছিল বিচ্ছিন্ন, অপূর্ণাঙ্গ এবং প্রয়োগহীন। তাঁর প্রবর্তিত সঙ্ঘই ধর্ম রক্ষায় একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এ প্রতিষ্ঠানই ‘শঙ্কর মঠ’ নামে আমাদের কাছে পরিচিত। ‘শঙ্কর মঠ’ কোন একক কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে ভারতবর্ষের চারপ্রান্ত থেকে চারটি মঠের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে। এ চারটি মঠ ছিল সনাতন ধর্ম রক্ষায় চারটি দুর্গের ন্যায়। সিন্ধু, সৌবীর, মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমাঞ্চলের জন্য শারদা মঠ; অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ, উৎকল, গৌড়, সুক্ষ্ম, পৌণ্ড্র, ব্রহ্মপুত্র তীরবাসীসহ সমগ্র পূর্বাঞ্চলের জন্য গোবর্দ্ধন মঠ; কুরুক্ষেত্র, কাশ্মীর, কম্বোজসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চলের জন্য জ্যোতি মঠ এবং অন্ধ্র, দ্রাবিড়, কর্ণাট, কেরল প্রভৃতি দক্ষিণাঞ্চলের জন্য শৃঙ্গেরী মঠ। "অহং ব্রহ্মাস্মি", "প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম", "তত্ত্বমসি" এবং "অয়মাত্মা ব্রহ্ম" বেদের এ চারটি মহাবাক্যকে অবলম্বন করে সংস্থাপিত হয় চারটি মঠ। শ্রীশঙ্করাচার্য এ চার মঠের আচার্য হিসেবে নিযুক্ত করেন, সুরেশ্বর, পদ্মপাদ, তোটক এবং হস্তামলক শ্রেষ্ঠ চার শিষ্যকে। এ চার শিষ্য চার মঠের প্রধান হয়ে, চার বেদের পূর্ণাঙ্গ বৈদিক জীবন বিধানের শিক্ষা দিতে থাকেন দিকে দিকে। ফলে সনাতন সমাজ একটি সুদৃঢ় সাংগঠনিক রূপ পায়।
সরস্বতী, ভারতী, পুরী, বন, অরণ্য, তীর্থ, আশ্রম,গিরি, পর্বত এবং সাগর - ধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে এ দশপ্রকারের 'দশনামী-সন্ন্যাসী' প্রবর্তন করেছেন শ্রীশঙ্করাচার্য। ভারতবর্ষের অধিকাংশ সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ই এ দশপ্রকার সন্নাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। পুরী, গিরি এ উপাধিগুলো সন্ন্যাসীর উপাধি, কোন গৃহীমানুষ যাদের স্ত্রীপুত্র সহ সংসার আছে, তারা কখনই এ উপাধি ব্যবহার করতে পারে না। বিবাহিত সাংসারিক মানুষ যখন এ উপাধিগুলো ব্যবহার করবে, তখন বিষয়টি অশাস্ত্রীয় এবং নিন্দনীয়। কিন্তু বর্তমান বহু সাধু নামধারী বিবাহিত দীক্ষাগুরুদের নামের সাথে পুরী, গিরি সহ দশনামি সন্ন্যাসীর এ উপাধিগুলো দেখা যায়। তাদের পরিবারে কেউ হয়ত সন্ন্যাসী হয়েছেন, পরবর্তীতে সেই সন্ন্যাসী ব্যক্তির সন্ন্যাস উপাধি তাঁর পরিবার পরিজন এবং বংশধররা বংশানুক্রমে ব্যবহার শুরু করে মানুষকে দীক্ষা দিতে শুরু করে করেছে। এটা এক ভয়ংকর প্রতারণা। সাধারণ মানুষ বিষয়গুলো সঠিকভাবে না জানায়, তারা এ প্রতারণাটি ধারাবাহিকভাবে করতে পারে।
আমি চাকুরিসূত্রে ২০১০ সালে যখন নারায়ণগঞ্জ বসবাস শুরু করি, তখনই প্রথম বিষয়টি আমার চোখে পরে। দেখতে পাই, অসংখ্য বিবাহিত সাংসারিক ব্যক্তিদের নামের সাথে 'গিরি' পদবি। তারা এ গিরি শব্দটি বংশানুক্রমে নামের সাথে পদবি হিসেবে ব্যবহার করে চলছে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিসূত্রে চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি।তখন চট্টগ্রামে বহু গৃহী মানুষের নামের সাথে সন্ন্যাসীর 'পুরী' শব্দটি দেখতে পাই। বিষয়টি দেখে আমি বিস্মিত হয়ে যাই। ভাবি এটা কি করে সম্ভব! সন্ন্যাসী না হয়েও কি করে এরা দ্বিধাহীনভাবে সন্ন্যাসীর উপাধি ব্যবহার করছে। এরা কি ধর্মশাস্ত্র বা শ্রীশঙ্করাচার্যের মঠানুশাসনে একবারও একটু চোখ বুলিয়ে দেখেনি। সন্ন্যাসীর উপাধি যারা এভাবে যথেচ্ছাচার করে ব্যবহার করছে, এদের কি সামান্যতম চোখের লজ্জা নেই? প্রশ্নটি চট্টগ্রামের অনেকের কাছে করেও, যথাযোগ্য উত্তর পাইনি। যেই ব্যক্তিরা গৃহী হয়ে নিজেদের নিজদের নামের সাথে সন্ন্যাসীর উপাধি ব্যবহার করছে। তাদের কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু এর বিপরীতে সাধারণ মানুষের কি শ্রীশঙ্করাচার্যের মঠানুশাসন সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা নেই? আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে, যদি আমি সেনাবাহিনীর পোশাক পরে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করি, তবে আমি যতই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হই না কেন, আমি যে কোন সময় গ্রেফতার হতে পারি। কারণ আমি মিথ্যা পরিচয় দিতে পারি না। মিথ্যাচার একটি অপরাধ। তাই মিথ্যাচার থেকে বাঁচতে সামান্যতম হলেও সকলের শাস্ত্রজ্ঞান এবং সচেতনতা প্রয়োজন। মনুসংহিতাতেও বিষয়টি বলা হয়েছে:
অলিঙ্গী লিঙ্গিবেষেণ যো বৃত্তিমুপজীবতি ।
স লিঙ্গিনাং হরত্যেনস্তির্যগ্যোনৌ চ জায়তে॥
(মনুসংহিতা:৪.২০০)
"ব্রহ্মচারী বা সন্ন্যাসী না হয়ে যে ব্রহ্মচারী বা সন্ন্যাসী বেশে জীবিকা অর্জন করে, সে ব্রহ্মচারীদের পাপ হরণ করে এবং তারা কুকুরাদি নীচ যোনিতে জন্ম গ্রহণ করে।"
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................