তেল অধ্যাপক মাকানাশু বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করতে এসেছেন।

জাপানের অধ্যাপক নিগাতা মাকানাশু একটা বিশেষ ধরণের তেল আবিস্কার করেছেন। তেলটা সারা শরীরে মাখলে সমুদ্রে ডলফিনের মত সাঁতার কাটা যাবে। ডুব সাঁতার দিতে কোন অক্সিজেনের দরকার হবে না। একশো মিলি তেল মেখে একশো মাইল পর্যন্ত সাঁতার কাটা যাবে।

এই তেল অধ্যাপক মাকানাশু বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করতে এসেছেন। জাপানে তিনি এই তেল বেচতে পারেননি। সমুদ্রে ডলফিনের মত সাঁতার কেন কাটতে হবে সেটা জাপানীরা বুঝতে পারেনি। কিন্তু নিগাতা মাকানাশুর তেল আবিস্কারের খবর পেয়ে বাংলাদেশী আমদানিকারকরা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছে। মাকানাশু বাংলাদেশে এসে তাজ্জব। এত এত ডিস্ট্রিবিটর উপস্থিত! এরা সবাই তার তেলের ডিলার নিতে চায়। সাংবাদিক সম্মেলনে তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, জনাব মাকানাশু, আপনার তেল সত্যি সমুদ্রে ডলফিনের মত সাঁতার কাটতে সাহায্য করে?

জ্বি। এটা একটা ডুবো জাহাজের মত একজন মানুষকে সাঁতার কাটতে সাহায্য করবে। তবে এই তেল কিনতে এদেশে এত মানুষের আগ্রহ দেখে আমি বিস্মিত! তারা সমুদ্রে সাঁতার কাটতে এতো ভালোবাসে?

জ্বি না স্যার, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। এই তেল মেখে সবাই বঙ্গপোসাগার, আরব সাগর, আটলান্টিক, ভূমধ্যসাগার পাড়ি দিয়ে ধনী দেশগুলিতে উঠে পড়বে। নেভীদের হাত থেকে বাঁচতে আপনার তেল বিশেষ কাজে দিবে।

আচ্ছা! তাহলে তো আমার তেল এখানে ভালো বাজার করবে।

তাই তো মনে হচ্ছে।

মাকানাশু ফাইভ স্টার হোটেলে আছেন। তার সমস্ত খরচ বহন করছেন রইসউদ্দিন বেপারী। ঝানু ব্যবসায়ী। কুকুরের মত গন্ধ শোকার অসম্ভব ক্ষমতা আছে তার। নতুন ব্যবসার গন্ধ খোঁজেন রইসউদ্দিন। জাপানের এই অধ্যাপকের তেলের খবর পাবার পর তিনি যোগাযোগ করেন। মোটামুটি কথা ফাইনাল। মাকানাশু তার ফর্মূলার সত্ত্ব বিক্রি করবেন না। তিনি রইসউদ্দিনের সঙ্গে মিলে ব্যবসাটা করবেন। সর্ষের তেলের মধ্যে মাকানাশুর ফর্মূলাটা মেশানো হবে। সাভারে বিশাল কারখানা করা হয়েছে। বড় বড় তেলের ট্যাংকের মত সিলভারের জারে সর্ষের তেল ভরা। অধ্যাপক মাকানাশু কেবল নিজে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঐ বিশাল জারে তার ফর্মূলা মেশাবেন।

বোতলের লেবেল ছাপা হয়েছে বাংলা ইংরেজি দুই ভাষাতে। ‘ব্যবহার’ অংশ লেখা হয়েছে: ভালো করে শরীর পরিস্কার করে দুই হাতের তালুতে তেল নিয়ে সারা শরীরে মালিশ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন শরীরের কোন অংশ বাকী না থাকে। ‘সতর্কতা’ অংশে লাল কালিতে লেখা হয়েছে: তেল মেখে কোনভাবে শরীরে কোন পোশাক পরিধন করা যাবে না। আন্ডারওয়্যার বা বিকিনি কোন কিছু শরীরের জড়ানো যাবে না। তাহলে তেলের কার্যকারীতা বিঘ্ন ঘটবে।

কোম্পানি বাজারে তেল ছাড়ার আগে প্রথম সমস্যা দেখা গেলো এর লাইসেন্স নিয়ে। সরকারের মাননিয়ন্ত্রণ সংস্থা কোম্পানিকে চিঠি দিয়ে জানায় সাধারণ তেল বিক্রির লাইসেন্স দিয়ে ‘ডলফিন তেল’ বিক্রি করতে তারা দিবে না। ফলে নির্ধারিত সময়ে মাকানাশুর তেল বাজারে এলো না। এদিকে লক্ষ লক্ষ ক্রেতা রোজ নির্দিষ্ট দোকানে তেল কেনার জন্য ভীড় করছে। কোন কোন দোকানে রাত থেকে লাইন দিয়ে ক্রেতারা অপেক্ষা করছে। এই সুযোগে কিছু অসাধু লোক লাইনের জায়গা বিক্রি করছে। তারা আপনার হয়ে ইট নিয়ে রাতজেগে বসে থাকবে। মারামারি করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। কয়েক দফা বিভিন্ন জায়গায় লাইনের জায়গা নিয়ে মারামারি হয়েছে। পুলিশ কাঁদানো গ্যাস ছেড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য হয়।

রইসউদ্দিন সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে চেনেন। সরাসরি তাকে গিয়ে ধরলেন। টু পার্সেন্ট কমিশনে তাকে অংশিদার করার অফার করলেন। সত্তর বছরের মন্ত্রী কানে কানে রইসউদ্দিনকে বললেন মাকানাশুকে বলে এমন একটা তেল বানাতে যাতে সত্তর বছরের লিঙ্গ ২১ বছরের তরুণের মত হয়ে যায়। যেন একবার তেল লাগালে আর কিছু না লাগে। রইসউদ্দিন বললেন, মাকানাশু একজন জাদুকর! তার অসাধ্য কিছু নেই। এরকম তেল বানানো তার কাছে কিছুই না। ফলে মন্ত্রী নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন এরকম তেল তিনি পেয়ে গেছেন...।

লাইসেন্স পাওয়ার পর দ্বিতীয় সমস্যা দেখা দিলো পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকে। তারা আন্দোলন শুরু করে দিলো। পৃথিবীর কোন দেশে এই তেল বিক্রি করার অনুমতি দেয়া হয়নি। তাহলে এইদেশে কেন এই তেল আসল? জাপানে কেন এই তেল সরকার অনুমতি দিলো না? এই তেল মেখে সমুদ্রে নামলে সমুদ্রে জীববৈচিত্র নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া অধ্যাপক নিগাতা মাকানাশু এদেশে আসার আগে তিনি তেলআবিব হয়ে দিল্লি ঘুরে এসেছেন। সুতরাং গভীর একটা ষড়যন্ত্র যে এখানে আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ জন্যই লেনিন বলেছিলেন...

লেনিন কি বলেছিলেন সেটি আর জনতা শুনতে পেলো না। কারণ সরকারের পুলিশ তখন মাইক খুলে নিয়েছে। মৃদু লাঠিচার্য করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়েছে। আন্দোলনকারীদের নেতা বিশিষ্ট পরিবেশবাদী ও মার্কসবাদী অধ্যাপক শ ক ম ফ ত দ হারুন স্যারকে পুলিশ আটক করে তাদের গাড়িতে করে শাহবাগ পর্যন্ত ঘুরিয়ে আবার ছেড়ে দেয়। আন্দোলন সেখানেই মুলতাবী হয়ে যায়। নিন্দুকরা বলে আন্দোলনকারীদের অনেকেই পরে এই তেল কিনে শরীরে মেখে আটলান্টিক পারি দিয়ে আমেরিকায় গিয়ে উঠেছিল।

লাইসেন্স পাওয়ার পর তৃতীয় যে সমস্যা দেখা দিলো, এই সমস্যা দেখে স্বয়ং মাকানাশু মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। বোতলের লেবেল কেমন করে যেন ফেইসবুকে শেয়ার হয়ে যায়। সেটা পড়ে আলেম সমাজ এই তেল শরীয়ত সম্মত নয় বলে হারাম ঘোষণা করে এবং যে কোন মূল্যে এই তেল প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়। লেবেলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে তেল মাখার কথাতেই তাদের আপত্তি। আলেমরা বলছে ছতর না ঢেকে সাঁতার জায়েজ নেই। অথচ এই তেল উলঙ্গ হয়ে মেখে উলঙ্গ হয়েই সাঁতার কাটতে হবে। মাকানাশু ভাবলেন এই সমস্যা থেকে মনে হয় না মুক্তি মিলবে। কারণ সত্যি সত্যি তার তেল কোন পোশাক শরীরে থাকলে কার্যকর হবে না। রইসউদ্দিন চোখ টিপে হেসে বললেন, মাকানাশু স্যার, চিন্তা করবেন না। আপনারা তেল বানাতে পারেন সত্যি, কিন্তু আমার তেল পাবলিককে কি করে খাওয়াতে হয় সেটা ভালো করে জানি...।

রইসউদ্দিন দ্রুত কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে রাখলেন ‘মক্কা-মদিনা ডলফিন তেল কোং’। তারপর দশজন আলেমকে মোটা অংকের বেতন দিয়ে একটা শরীয়া বোর্ড গঠন করে দিলেন। এই বোর্ড তেলকে হালাল বলে ঘোষণা দিলো। এমনকি আল আজহার থেকে একটা সার্টিফিকেটও এসে গেলো। পরে দেখা গেলো লোকাল আলেমরাই কোম্পানির তেল অনলাইনে বিক্রি করা শুরু করে দিয়েছে।

পুরোদমে তেল বিক্রি শুরু। তেল মেখে সমুদ্রে পরীক্ষামূলক কয়েকজন সাঁতার কেটে এসে মিডিয়াতে এদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করল। অসাধারণ! মনে হচ্ছিল আমার মাছ হয়ে গেছি! অনেক নিচে চলে গেছি ডুব সাঁতারে। কোন অক্সিজেনের সমস্যা হয়নি। এমন কি তেল মাখার পর কোন ভয়ও থাকে না মনে। মনে হয় সমুদ্রেই আমাদের বাসস্থান...

এরমধ্যে চকবাজার ও জিঞ্জিরাতে নকল ডলফিন তেলের ফ্যাক্টরির সন্ধান পাওয়া গেলো। এসব তেল হুবহু ‘মক্কা-মদিনা ডলফিন তেল’ এর লেবেল নকল করে নরমাল সর্ষের তেল ভরে বিক্রি করছিল। এসব নকল তেল মেখে নদীতে লাভ দিয়ে দুইজন নিখোঁজ। সমুদ্রে গিয়ে দশজনের মত আর ফিরে আসেনি। এইসব নকল তেল প্রস্তুতকারককে ধরতে অভিযান চলছে। মক্কা-মদিনা ডলফিন তেল কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপনে বারবার বলতে লাগলো তাদের নির্ধারিত ডিলার ও দোকান ছাড়া কেউ তেল কিনবেন না।

এরমধ্যে একদিন ব্রেকিং নিউজ দেখা গেলো অধ্যাপক নিগাতা মাকানাশুকে পাওয়া যাচ্ছে না। হোটেল থেকে তার গাড়ি ফ্যাক্টরি অভিমুখে যাবার কোন এক সময় তিনি গাড়িসহ নিখোঁজ হোন। অধ্যাপক নিগাতা মাকানাশু নিখোঁজ নাকি নিজেই কোথাও চলে গেছেন? একজন মন্ত্রী এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, নিগাতা মাকানাশু নামের কেউ ছিলই না। পুরোটাই মিডিয়ার সৃষ্টি। মন্ত্রীর কথা বলার ২৪ ঘন্টার পর অবশ্য নিগাতা মাকানাশুকে একটা ব্রিজের নিচে মরা নদীর বালুচরে পাওয়া গেলো। নিগাতা মাকানাশু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। মুখে কিছু বলেন না। কে তাকে ধরে নিয়ে গেছে, কোথায় ছিলেন সেসব প্রশ্নে কেবলই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে চুপ করে থাকেন।

জাপানী দুতাবাসের সহায়তায় তার পরদিন অধ্যাপক নিগাতা মাকানাশু জাপানের বিমান ধরেন। রইসউদ্দিন বেপারীকে পরবর্তীকালে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দেন, নিগাতা মাকানাশু তার কাছে ফর্মূলার সত্ত্ব বিক্রি করে চলে গেছেন। তাই তেল বের করতে তার কোন সমস্যা হচ্ছে না। নিগাতা মাকানাশুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার পরিবার জানায়, নিগাতা মাকানাশু সেই থেকে আর কথা বলেন না। তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে তিনি তার আবিস্কারের সত্ত্ব বিক্রি করে এসেছিলেন কিনা তা আর কোনদিন জানা যাবে না।

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted