আমাদের দেশের সংস্কৃতিকর্মীরা পেশায় সংস্কৃতিকর্মী হলেও চেতনায় একেকটা মসজিদের খতিব। আমাদের চলচ্চিত্রে শিল্পমনা শিল্পী এসেছে হাতেগোনা। সংগীতেও আমরা প্রকৃতপক্ষে শিল্পী পেয়েছি গুটিকয়েক। একইভাবে নৃত্য, কলা, চিত্র, বাদ্য, সাহিত্য; মোটকথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রকৃত শিল্পমনা শিল্পী আমরা খুব বেশি পাইনি। তাই আমাদের সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটেনি কখনো। সাংস্কৃতিতে আমাদের সমৃদ্ধি অর্জন না হওয়ার অন্যতম কারণ আপামর জনসাধারণ তো দূরে থাক, আমাদের শিল্পীরাই স্বয়ং তার শিল্পটাকে ধারণ করেনি।
যে চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সে নিজের কাজটাকে গুনাহের কাজ মনে করে, খারাপ কাজ মনে করে। তাই হজ্জ্ব করে, তওবা করে এসব থেকে একদিন নিজেকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয়। যে গায়ক গান গায় সেও ঘোষণা দেয় তার সন্তানদের সে এই পাপের পথে আনবে না। এরকম নজির আমাদের দেশে ভুরি ভুরি। শাবানারা এখন তাদের অতীত অভিনয়ের অনুশোচনা হিসেবে হিজাব, হাত-মোজা পরে ঘর থেকে বের হয়, মৌসুমি তার সব সিনেমার ভিডিও সবার মোবাইল থেকে ডিলিট করে দেয়ার অনুরোধ জানায়, অনন্ত-বর্ষা স্বপ্ন দেখে তাদের সন্তানরা সিনেমায় না এসে আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাওলানা হয়ে ইসলামের সেবা করবে, কনক চাপা বলেছে ধর্মে গান গাওয়া গুনাহ তাই তার কোনো সন্তানকে সে পাপের পথে আনেনি। ছেটপর্দার অহনা বলেছে সে হজ্জে গিয়ে মক্কায় থেকে সন্তান গর্ভে আনবে। যাতে তার সন্তান বড় হয়ে দ্বীনের একজন খাদেম হয়। এবং আজ ক্লোজআপ ওয়ান খ্যাত সালমা ঘোষণা দিয়েছে তার সন্তানদের নামের পাশে আজহারি থাকবে। তারা সংগীত শিল্পী নয়, সংগীত যে ভয়াবহ গুনাহ ওয়াজ মাহফিল করে সেটাই প্রচার করবে।
আমাদের সাহিত্যিকরাও মনে করে গল্প-উপন্যাসে তাদের লেখা মিথ্যা কাহিনির জন্য তারা পরকালের শাস্তি পাবে। ক্রীড়াঙ্গনের চিত্রও একই। খেলোয়াড়েরা খেলে ঠিকই, কিন্তু তারা বলে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা হারাম। গতকাল দেখলাম মুশফিক, তাসকিন তাদের জার্সিতে এলকোহলের বিজ্ঞাপন কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। যে কোম্পানির স্পন্সরের জন্য তারা খেলতে পারছে, সেই কোম্পানির লোগোটাই তারা ঢেকে দিচ্ছে। এতটা উগ্র, ধর্মান্ধ, এতটা কনজারভেটিভ এবং অপেশাদার যাদের চিন্তাভাবনা, তাদের খেলা তাদের পেট চালানোর মজুরি ছাড়া আর কিছুই দিবে না।
একজন সংস্কৃতিকর্মী যদি তার কাজকে ভালোবাসতে না পারে, সেই কাজ দিয়ে বড়জোর তার পেট চলতে পারে। কিন্তু সেটা জাতির কোনো কাজে আসবে না। আমাদের নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, চিত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী এমনকি খেলোয়াড়রা পর্যন্ত ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় তাদের কাজটি করে ভয়াবহ এক পাপবোধ নিয়ে। এসবের সাথে যুক্ত থেকে তারা ভাবে তারা হারাম একটি পেশার সাথে যুক্ত আছে। তাই অর্থবিত্ত, নাম-যশের জন্য এরা এসব করলেও কাজগুলোর প্রতি এদের কারোরই প্রেম নেই। আমাদের গায়করা যদি সংগীতটাকে ভালোবাসতো তাহলে হেফাজতে ইসলাম যে বার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওস্তাদ আলাউদ্দিনের আখড়া ভেঙে দিলো, দেশের সব সংগীতশিল্পীদের রাস্তায় নেমে সেটার প্রতিবাদ করার কথা ছিল। বাউলশিল্পীদের ওপর মৌলবাদীদের লাগাতার নির্যাতনের প্রতিবাদে ফরিদা পারভীন, মমতাজদের আমরণ অনশনে বসার কথা ছিল। কিন্তু সেরকম কিছু আমরা দেখিনি।
একটা সময় এই দেশটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতাম। ভাবতাম জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে, সৃজনশীলতায় এদেশে একদিন রেনেসাঁস হবে। এখন আমাদের সৃজনশীলতার চর্চা হয় ঠিকই, তবে সেটা ভাড়াটে লোকের দ্বারা হয়। আমাদের নায়কেরা, গায়কেরা কেউ শিল্পী নয়, এরা সবাই মসজিদের খাদেম। তাই এই দেশ নিয়ে এখন আর স্বপ্ন দেখি না, যে দিকে তাকায় শুধু মোল্লা-মৌলভী দেখি।
রহমান বর্ণিল।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................