পবিত্র বেদ এ বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও ধর্ম

"এসো বেদের পথে- ১ম পর্ব-

পবিত্র বেদ এ বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও ধর্মঃ- বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্র সংখ্যা ১৬০টি।

( এই পোস্টে উল্লেখিত মন্ত্রের অনুবাদ আর্য সমাজের বিভিন্ন বিদ্বান মন্ডলী কর্তৃক অনুবাদকৃত।।)

সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ এর মাধ্যমে ঈশ্বর বিজ্ঞান,ধর্ম ও মানবতার বার্তা প্রেরণ করেছেন। 

কারন যখন ধর্ম বিজ্ঞান বিহীন হবে তখন  মানুষের মাঝে অন্ধবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে, আবার যখন বিজ্ঞান ধর্মহীন হবে তখন পাশবিকতা বৃদ্ধি হয়ে মানুষ বিনাশের দিকে অগ্রসর হবে। 

তাই ঈশ্বর যজুর্বেদের-৪০/১৪ মন্ত্রের এর মাধ্যমে এই বার্তাই প্রেরন করেছেন।
বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ য়স্তদ্বেদোভয় সহ।
অবিদ্যয়া মৃত্যুং তির্ত্বা বিদ্যয়াৎ মৃতমশ্নুতে। 
অর্থ- যে মনুষ বিদ্যা ও অবিদ্যার স্বরূপ এক সংগে জ্ঞাত হয়, সে অবিদ্যা দ্বারা মৃত্যু উত্তীর্ণ করে, বিদ্যা দ্বারা অমৃতত্ব প্রাপ্ত হন।


বেদ অর্থ জ্ঞান, বেদে জ্ঞান যেমন আছে বিজ্ঞানও আছে। সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ এর বিখ্যাত নাসাদিয়া সুক্ত ও হিরণ্যগর্ভ সুক্তের মাধ্যমে জানতে পারি সৃষ্টির নিগুঢ় তত্ত্ব, কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল এ পৃথিবী ও বিশ্ব ব্রাহ্মান্ড। এছাড়া পদার্থ বিদ্যা, বনষ্পতি শাস্ত্র, জীব বিজ্ঞান, শিল্প বিজ্ঞান, গণিত বিদ্যা, ভাষা বিজ্ঞান, রসায়ণ শাস্ত্র, বিদ্যুৎ সম্পর্কীয়, ভূগর্ভ বিদ্যা, জ্যোতিষ শাস্ত্র সহ সৃষ্টির উৎপত্তি সম্পর্কে জ্ঞান ঈশ্বর  মানুষের কল্যানে পবিত্র বেদ এর মাধ্যমে  প্রেরণ করেছেন।

পবিত্র বেদ এর কিছু বিজ্ঞান ভিত্তিক বেদ মন্ত্র,  উল্লেখ করা হলো:-
১]
ন মৃত্যুরাসীদমৃতং ন তর্হি ন রাত্র্যা অহ্ন আসীৎ প্রকেতঃ। আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তস্মাদ্ধন্যন্নঃ পরঃ কিং চনাস।। ঋগ্বেদ-১০/১২৯/২

ভাবার্থ-  অর্থাৎ সৃষ্টির রচনার পূর্বে কোন জীবন,মৃত্যু, দিন, রাত্রি, চন্দ্র, সূর্য এমন কি সৃষ্টি, বিসৃষ্টিও কিছু জানার যোগ্য ছিল না শুধূ অবিচল স্থিতি ছিল। সেই সময় শক্তি (Energy) অবশ্যই ছিল। শক্তি দুই প্রকার সুপ্ত শক্তি(Protentiol Energy)  ও গতিসঞ্জাত শক্তি(Kinetic energy) এ শক্তি গুলি তখন ক্রিয়াশীল ছিল না। 
২]
যদক্রন্দঃ প্রথমং জায়মান উদ্যন্ৎসমুদ্রাদুত বা পুরীষাত্।  শয়েনস্য পক্ষা হরিণস্য বাহু উপস্তুত্যং মহি জাতং তে অর্বন্।। 
(ঋগ্বেদ- ১/১৬৩/১)।।

পদার্থঃ-- (যত) যে কারণ ( অক্রন্দঃ) শব্দ করে ( প্রথমম্) আদিতে ( জায়মানঃ) উৎপন্ন হয় ( উদ্যন্) উদিত হয়ে যায়  ( সমুদ্রাত্) অন্তিরক্ষে ( উত) ও ( বা) পক্ষান্তরে ( পুরীষাত্) পূর্ণকারণে ( শয়েনস্য পক্ষা) অতি তীব্র গতিযুক্ত পঙ্গ সমান ( হরিণস্য বাহু) শুভ্র হিরণের ন্যায় শ্বেত জ্যোতি[ যাহাকে কসমিক রে বলা হয়] এমন বাহু[  যাহাকে পরমাত্মার দুই পক্ষ রূপ লাগাম বলা হয়েছে] ( উপস্তুত্যম্) সমীপে প্রশংসা করিবার যোগ্য ( মহি, জাতম্) মহ তত্ব জাত হইল ( তে) তখন (অর্বন) বিজ্ঞান রূপ পরমাত্মা।।

ভাবার্থঃ সৃষ্টির প্রথম অবস্থায় তীব্র বেগযুক্ত পংখ তথা হিরণের ন্যায় শ্বেত জ্যোতি[ যাহা পরমাত্মার তেজ বলা হয়] তাহা অন্তরিক্ষ নামক বিশাল সমুদ্রে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।[ বিজ্ঞানের ভাষায় যাহাকে cosmic ray এর স্ফূরণ বলা হয়] তখন ঘোর শব্দ ওম্ উচ্চািরত হচ্ছিল। এই তেজ হতে মহতত্ব জাত হইল।  মহতত্ব মানে বুদ্ধিতত্ব।। এই মহতত্ব হতে পরমানু সমুহের মধ্যে সত্ব তম রজ গুনের ধারা প্রবাহিত হয়ে সাম্য অবস্থা ভঙ্গ করল এবং তীব্র আকর্ষ বিকর্ষণ আরম্ভ হল। অর্থাৎ ইলেক্সট্রন, প্রোটণ, নিউটন এই তিনের কার্য পরমানুকে অতিষ্ঠ করে তুলল।  এভাবে হে "অর্বন" ( জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মা) পূর্ব সৃষ্টিতে তিন পদার্থের কার্য দাতা আপনিই স্তুতি পাবার যোগ্য ছিলেন।।
৩]
যমেন দত্তং ত্রিত্ত এনমাষুনগিন্দ্র এণং প্রথমো অধাতিষ্ঠৎ। 
গন্ধর্বো অস্য রশনামগূভ্ণাৎ সূরাদশ্বং বসবো নিরতষ্ট।। ঋগবেদ  (১/১৬৩/২)

 ভাবার্থঃ- পরমাত্মা কতৃক প্রদত্ত শক্তিকে ত্রিগুনাত্ম শক্তি অধিষ্ঠিত হল। প্রথম ইন্দ্র অর্থাৎ বিদ্যুৎ জ্যোতি এই শক্তিকে অধিষ্ঠিত করেছিল। অর্থাৎ পরমাত্মা সেই ত্রিগুনাত্মক প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে গেল।  সাম্যঅবস্থায় পরমাণু সেই পরমাত্মার সামান্য লাগামরূপ জ্যোতিকে গ্রহন করেছিল অর্থাৎ cosmic ray এর একটা অংশ মূল প্রকৃতির উপর ঝাটকে পড়ে এবং তাহা পরমাত্মার লাগাম স্বরূপ সৃষ্টিকার্য আরম্ভ করে দেয়।।

এই কথার অভিপ্রায় এই যে, পরমাত্মার তেজ পরামাণুর উপর অধিষ্ঠিত হয়ে গেল এবং তাহাকে লাগাম মানিয়া পরমাণু তাহা গ্রহন করিল। যে ভাবে ঘোড়ার মুখে লাগাম পড়ানো হয় এবং এই লাগামই ঘোড়াকে মার্গ দর্শন করায় ঠিক তদ্রুপ পরামাণুদের ক্ষেত্রে ও তেমন ঘটল। সেই পরমানুতে সত্ব, রজ, তম গুণ নিজেদের বদলাতে লাগিল। এই সত্ব নাম ইলেক্সট্রন, রজ নাম প্রোটণ, এবং তম নাম নিউটন পরমাণুর অভ্যান্তরীন শক্তি থেকে বহির্মূখ হয়ে সৃষ্টি কার্য আরম্ভ করল।।
৪]
অসি যমো অস্যাদিত্যো অর্বন্নসি ত্রিতো গূহ্যেন ব্রতেন। অসি সোমেন সময়া বিপূক্ত আহূস্তে ত্রীণি দিবি বন্ধনানি। 
ঋগবেদ  (১/১৬৩/৩)

ভাবার্থঃ- হে নিয়ন্ত্রনকারী পরমাত্মা! তুমি আদিত্য অর্থাৎ চমকদার প্রকাশমান্, তুমি " অর্বন" অর্থাৎ তেজ ভাগনেবালা ভীতর থেকে গুপ্তরূপে গঠিত ছিলে যাহা প্রথমে সাম্য অবস্থায় ছিলে, তখন পরমাণু সমীপ সমীপ ছিল কিন্তু পৃথক ছিলেন। কিন্তু অর্বন নামক পরমাত্মার তেজ দ্বারা তাহার সাম্য অবস্থা ভঙ্গ হল তাহা দ্বারা তিন দিব্য গুণ, ইলেক্সট্রন, প্রোটন, নিউটন, অর্থাৎ সত্ব, রজ, তম গুণ মুক্ত হয়ে গেল। এবং পরমাণুর কার্য হতে অহংকারাদি সৃষ্টি হল।।
৫]
পুমাং এনং তনুতউৎ কৃণত্তি পুমান্  বি তত্নে অধি নাকে অস্মিন্। 
ইমে ময়ুখা উপ সেদুরুঃ সদঃ সামানি চক্রুস্তসরাণ্যেতবে।। ঋগ্বেদ ১০/১৩০/২

ভাবার্থ- এখানে বলা হয়েছে যে, শক্তি( Energy) তরঙ্গরপে প্রকট হয় এবং প্রকৃতিতে নির্মাণ কার্য শুরু হয়ে যায়। তরঙ্গ তির্যক গতিতে চলে। সেই সব তরঙ্গ প্রকৃতির সাম্যাবস্হায় পরমাণু সহ সঙ্ঘৃষ্ট হয় এবং তার সাম্যাবস্হা ভঙ্গ করে দেয়।।
৬]
য়ুঞ্জন্তিং ব্রধ্নমরুষং চরন্তং পরিতস্হূষঃ।
রোচন্তে রোচন্তে দিবি।।
ঋগ্বেদ- মন্ডল-১/সুক্ত-৬/মন্ত্র-১।।

ভাবার্থঃ-চতুর্দিকে ব্যাপক, স্থির(পরমাণু) যখন ব্যাপক শক্তি( প্রাণ) সহযুক্ত হয়। প্রকাশমান অন্তরিক্ষে প্রকাশিত হতে হতে থাকে। অভিপ্রায় এই যে, সর্বত্র বিদ্যমান সাম্যবস্থায় পরমাণু যখন পরমাত্মার শক্তি (প্রাণ) সহ সংযুক্ত হয়ে যায় তখন তারা জাগ্রত হয়ে যায়। এই জাগ্রতাবস্থা ইন্দ্রের শক্তির বাহিরে উঁকি মারার ফলে উৎপন্ন হয়।
৭]
সপ্ত য়ুঞ্জন্তি রথমেক চক্রমেকো অশ্বো বসতি সপ্তনামা। 
ত্রিপাভি চক্রমজরমনর্বং য়ত্রেমা বিশ্বা ভুবনাধি তস্হূঃ।। 
ঋগ্বেদ- ১/১৬৪/২

ভাবার্থঃ- কার্য জগতের পালক এক অতি তেজোময় ব্যক্তিত্ব তার সাত পুত্রকে আমরা দেখি। এখানে পুত্রের অভিপ্রায় প্রাণ। সেই সাত প্রাণ এক চক্রের সহিত সংযুক্ত। সে চক্র ভগ্ন বা শিথিল হয় না। চক্র অশ্ব দ্বারা চালিত। চক্রের তিন নাভি অর্থাৎ আশ্রয় স্হল। অশ্ব বলতে পরমাত্মা, তিন আশ্রয় প্রকৃতি, আত্মা, পরমাত্মা বুঝায়। জগতে এক অশ্বই সমস্ত ভুবন পরিচালনা করছে। সাতচল্লিশ প্রাণ তাঁর সাতটি সামর্থ। এই সামর্থগুলিকে বিজ্ঞানের ভাষায় এই প্রকারে বলা যেতে পারে-(এক) পরমাণু মধ্যে ইলেক্ট্রোনের ঘুর্ণন শক্তি (Inter atomic energy), (দুই) রাসায়নিক শক্তি   (Chemical energy),  (তিন) অনুদের  মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখার শক্তি(lnter molecular dynamics), অথবা সংগঠন শক্তি, এর দ্বারা শক্ত,তরল ও বায়ব্য ( Solids Liquids, Gasses)  অবস্থা  উৎপন্ন হয়। ( চার) ভূ-আকর্ষণ  (Gravity), (পাঁচ) চুম্বকীয় শক্তি (Magnetism) ( ছয়) আকাশ ও শব্দ(  Light and sound) (সাত) বায়ু।
৮]
ত্রীণি ত আহুর্দিবি বন্ধনানি তীন্যপ্সু ত্রীন্যন্ত সমদ্রে।
উতেব মেরুণশ্ছনৎ স্যর্বন্যত্রা ত আহুঃ পরমং জনিত্রম্।।
ঋগ্বেদ- ১/১৬৩/৪

ভাবার্থঃ- দ্যুলোকে এই তিন প্রকার বন্ধনই আপঃ হয়ে যায়। হে অর্নব! আমার ছন্দ বরুন বলে। এই তিনটি পদার্থ মিলিত হয়ে সম্পূর্ণ জগৎ নির্মান করে। 

বর্তমান বিজ্ঞানে তিনটি অ্যাটমিক্ পাটিকেলস্  জগতের সৃষ্টি করে। এই তিন বন্ধনকেই অ্যাটমিক্ পাটিকেলস্ বলা হয়। বেদে এই তিন বন্ধনের নাম মিত্র, বরুন ও অর্যমা। মিত্র ঋণ(-) বিদ্যুতের আবেশ, একে 'ইলেক্ট্রন' বলা হয়। বরুণ ধন(+) বিদ্যুতের আবেশ, একে   'প্রোটন' বলা হয়। আবেশরহিত অর্যমা কে বর্তমান বিজ্ঞানে নিউট্রন বলা হয়।
৯]
তিস্রো মাতৃস্ত্রীন্ পিতৃন্ বিভ্রদেক ঊর্ধ্বস্তস্হৌ নেমব গ্লাপয়ন্তি। 
মন্ত্রয়ন্তে দিয়ো অমুষ্য পৃষ্ঠে বিশ্ববিদং বাচমবিশ্বমিন্বাম্।। ঋগ্বেদ-১/১৬৪/১০।

ভাবার্থ :- মাতা পৃথিবী, পিতা সূর্য। প্রাণীর শরীরে তিন অংশ মাতার (পৃথিবী) থেকে আসে এবং তিন অংশ পিতা(সূর্য) থেকে আসে। মাতার দিক থেকে আসে মাটি, জল, বায়ু( তিনই পঞ্চভৌতিক) এবং সূর্যের দিক থেকে আসে অগ্নি ও আকাশ (এই দুটিও পঞ্চভৌতিক) পিতা অর্থাত্ সূর্য থেকে তৃতীয় যে অংশটি আসে সেটা হলো প্রাণ। অগ্নিও প্রাণে পার্থক্য  আছে। অগ্নি যা পিতার অংশ থেকে আসে প্রাণীর শরীর নির্মাণ হেতু উপলব্ধ, তা রাসায়নিক শক্তি  এবং অন্তকরণ ও দশ ইন্দ্রিয় কার্য  শক্তি। প্রাণ চেতনার প্রতীক। এই ভাবে প্রাণীর শরীর ছয়টি অংশ মাতার(পৃথিবী) দিক থেকে তিনটি এবং  পিতার (সূর্যের) দিক থেকে তিনটি আসে তখন  এর মধ্যে নিবাস করার জন্য জীবাত্মার আগমন হয়।
১০]
অহস্তা যদপদী বর্ধত ক্ষাঃ শচীভির্বেদ্যানাম্। শূষ্ণং পরি প্রদাক্ষিণিদদ্বিশ্বায়বে নি শিশ্নথঃ।।
ঋগ্বেদ- মন্ডল-১০/সুক্ত-২৩/মন্ত্র-১৪

ভাবার্থ :- পৃথিবী যদিও  হস্তপদহীন তথাপি ইহা চলিতেছে, অবশ্য জ্ঞাতব্য পরমাণুর শক্তির দ্বারা সূর্যের চারিদিকে ইহা প্রদক্ষিণ করিতেছে। হে পরমাত্মন! সমগ্র মানবের মধ্যে  আস্তিক্য বোধ জানাইবার জন্যেই তুমি এরূপ রচনা করিয়াছ।
১১]
সবিতা যন্ত্রৈঃ পৃথিবীমরম্
ণাদক্ষম্ভনে সবিতা দ্যামদৃংহৎ। 
অশ্বমিবাধূক্ষদ্ধুধুনিমন্তরিক্ষ মতুর্তে বৃদ্ধং সবিতা সমুদ্রম্।।
ঋগবেদ ১০/১৪৯/১

অনুবাদ- "সূর্য তার পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহসমূহকে তার আকর্ষনশক্তির সাহায্যে বেধে রেখেছে। এটার চারপাশে সেগুলো ঘূর্নায়মান ঠিক যেমন প্রশিক্ষক এর চারপাশে প্রশিক্ষনরত অশ্ব বলগা দিয়ে ঘোরে।"
১২]
আয়ং গৌঃ পৃশ্নিরক্রমীদসদম্মাতরং পুরু। পিতরং চ প্রয়ন্ত্স্বঃ। ।।
যজুর্বেদ-৩/৬

অনুবাদঃ এই প্রত্যক্ষ পৃথিবী জল ও অগ্নির নিমিত্ত দ্বারা উৎপন্ন অন্তরিক্ষ বা  নিজ কক্ষ অর্থাৎ যোনিরূাপ জল সহিত
আকর্ষণরূপী গুণগুলি দ্বারা সকলের রক্ষাকারী সূর্যের চতুর্দিকে প্রতিমুহূর্তে ভ্রমণ করে, ইহার ফলে দিন রাত শুক্ল  ও কৃষ্ণ পক্ষ, ঋতু ও অয়ানাদি ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়।
১৩]
অন্তশ্চরতি রোচনাস্য প্রাণাদপানতী।
ব্যখ্যন্ মহিষো দিবম্।।
যজুর্বেদ-৩য় অধ্যায়, মন্ত্র-৭।।

অনুবাদঃ এই অগ্নী  ব্রহ্মাণ্ড ও শরীরের মধ্যে ঊর্ধ্বগমনশীল বায়ু হইতে নিম্নগমনশীল বায়ুকে উৎপন্নকারী দীপ্তি অর্থাৎ প্রকাশরূপী বিদ্যুৎ ব্রহ্মাণ্ড ও শরীরের মধ্যে বিচরণ করে সে স্বগুন হইতে মহান অগ্নী  সূর্যলোকে প্রকট করে।
১৪]
য়ো য়জ্ঞ বিশ্বতস্তম্তভিস্তত একশতং দেবকমেভিরায়তঃ।
ইমে ত্রয়ন্তি পিতরো আয়য়ু প্র বয়াপ বয়েত্যাসতে ততে।। 
ঋগ্ববেদ- ১০/১৩০/১

এই মন্ত্রে 'তন্তু' বলতে পঞ্চ মহাভূত, এর নিম্নোপর করনের ফলে জগতের বিবিধ পদার্থ তৈরী হয়েছে। এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া একটা বিরাট যজ্ঞ, ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্রে সৃষ্টিকে ব্রহ্মদিন মানা হয়েছে। ব্রহ্মদিনকে (৪,৩২,০০,০০,০০০ সৌর বর্ষ), ১২,০০,০০,০০০ দেববর্ষে বিভাজিত করা হয় এবং এর এক শত বর্ষ পর্যন্ত হিরণ্যগর্ভের কার্য হতে থাকে। এই হিরণ্যগর্ভ বা নীহারিকা থেকে গ্রহ-উপগ্রহের উৎপত্তি।
১৫]
য়া গৌর্বর্তনিং পয়েতি নিষ্কৃতং পয়ো দুহানা ব্রতনীরবারতঃ। 
সা প্রব্রুবাণা বরুণায় দাশুষে দেবেভ্যো দাশদ্ধ বিষা বিবস্বতে।।
ঋগ্ববেদ- ১০/৬৫/৬

 ভাবার্থঃ- এই মন্ত্রের অভিপ্রায় আকর্ষণ বিদ্যা বিষয় বর্ণনা করা। হে পরমেশ্বর! আপনার প্রজা উৎপন্ন বা সৃষ্ট বস্তু সকল যা সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় ধর্মযুক্ত অর্থাৎ যার উৎপত্তি বা জন্ম, স্থিতি বা অবস্থান ও নাশ বা কারণে (লয় রূপে) রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া- তিন অবস্থা বিদ্যমান। আপনার সৃষ্টিতে যা কিছু বায়ু প্রধান, তৎসমুদয়ই আপনার আকর্ষণাদি নিয়ম অর্থাৎ পারস্পরিক আকর্ষণ ও সূর্যাদি লোকেরও আকর্ষণ বলেই স্থির রয়েছে। যেহেতু আপনি সমস্ত সৃষ্ট পদার্থকে স্ব নিয়মাধীনে রেখেছেন, তজ্জন্যই ভুবন অর্থাৎ সমগ্র লোক নিজ-নিজ কক্ষে পরিভ্রমণ করে ও নিজ-নিজ স্থানে স্থিত আছে।
১৬]
য়দা তে হর্য্যতা হরী বাবৃধাতে দিবেদিবে।
আদিত্তে বিশ্বা ভুবনানি য়েমিরে।।
ঋগ্ববেদ- ৮/১২/২৮
 
ভাবার্থ :- এ মন্ত্রেও আকর্ষণ বিষয়ে বলা হয়েছে। হে পরমেশ্বর ! আপনি সূর্যাদি লোককেও নিজ সামর্থ দ্বারা রচনা করেছেন। এই সূর্য আপনার প্রকাশ বলেই প্রকাশিত। এই সূর্যাদি লোক সহ অপর সমস্ত লোককে আকর্ষণ হেতু সমগ্ৰ ব্ৰহ্মাণ্ড (সৌরজগৎ) ধৃত হয়ে রয়েছে।
১৭]
আ কৃষ্ণেন রজসা বর্ত্তমানো নিবেশয়ন্নমৃতং মর্ত্যং চ। হিরণ্যয়েন সবিতা রথেনা দেবো য়াতি ভূবনানি পশ্যন্।।
যজুর্বেদ- ৩৩/৪৩

ভাবার্থ :- এই মন্ত্রেও আকর্ষণ বিদ্যা কথিত হয়েছে। যথা- সবিতা অর্থাৎ পরমাত্মা বায়ু ও যে সূর্যলোক আছে, সে সমস্ত লোক বা গ্রহ নক্ষত্রাদি সহ আকর্ষণ-ধারণ গুণ দ্বারা বর্তমান অর্থাৎ সকল লোক সহ সূর্যাদির পরস্পরের আকর্ষণ শক্তি বিদ্যমান আছে যাকে ইংরাজীতে Laws of Gravitation বলা হয়।

অর্থ্যাৎ, সবিতা (ঈশ্বরের একটি গুনবাচক নাম) পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহসমূহ কে আকর্ষণশক্তির মাধ্যমে তাদের কক্ষপথে বেঁধে রেখেছে, নিরাধার আকাশলোকে ইহারা অশ্বের ন্যায় পরিভ্রমন করে।

পবিত্র বেদের বিভিন্ন মন্ত্রে সুর্য কেও একইভাবে গতিশীল বলা আছে।
১৮]
হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ততাগ্রে ভূতস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ । স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাং কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।। যজুর্বেদ-১৩/৪

ভাবার্থ :- হে মনুষ্যগণ ! তোমাদের উচিত যে, এই প্রসিদ্ধ সৃষ্টি রচনা করিবার প্রথমে পরমেশ্বরই বিদ্যমান ছিলেন, জীব গাঢ় নিদ্রা সুষুপ্তিতে লীন এবং জগতের কারণ অত্যন্ত সুক্ষ্মাবস্থায় আকাশের সমান একরস স্থির ছিল, যিনি সকল জগতের রচনা করিয়া ধারণ করিয়াছেন এবং অনন্ত সময়ে প্রলয় করেন সেই পরমাত্মা উপাসনার যোগ্য স্বীকার করা উচিত।

এই মন্ত্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক অভিপ্রায় এই যে সৃষ্টি আদিতে হিরণ্যগর্ভরূপ ছিল, যা বিগব্যাংগ থিউরীতে ডিম্ব বলে স্বীকার করা হয়েছে।
১৯]
কঃ স্বিদেকাকী চরতি কऽউ স্বিজ্জায়তে পুনঃ।
কিং স্বিদ্ধিমস্য ভেষজং কিম্বাবপনং মহৎ। যজুর্বেদ-২৩/৯

২০]
সূর্যং একাকী চরতি চন্দ্রমা জায়তে পুনঃ। 
অগ্নির্হিমস্য ভেষজং ভূমিবপনং মহৎ ॥
যজুর্বেদ-২৩/১০

ভাবার্থ- এই দুইটি মন্ত্রের অভিপ্রায় প্রথমটি প্রশ্ন পরেরটিতে উত্তরের বলা হয়েছে সূর্য কারও পরিক্রমা করে না অথচ নিজের অক্ষে ভ্রমনরত। চন্দ্র, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ভ্রমন করে এবং সূর্যের আলোকে আলোকিত হয়, ইহা সকলের জানা উচিত।

 বিজ্ঞানের প্রসারের আদিতে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতৈক্য ছিল এই বিষয়ে, অথচ সৃষ্টির আদিতেই ঋষিগণ ধ্যানস্থ হয়ে জেনেছেন।
২১]
তরণি বিশ্বদর্শতো জ্যোতিষ্কৃদসি সূর্য।
বিশ্বমা ভাসি রোচম্ ।।
ঋগ্বেদ-১/৫০/৪
 ভাবার্থ:- হে সূর্য, তুমি এমন দ্রুত চলো, যা মনুষ্যের জ্ঞানের বাইরে, সবাইকে দেখিয়ে চলতে থাকো। তুমি আলো উৎপন্ন করো, সেই আলোর সাথে ব্রহ্মাণ্ডকেও আলোকিত কর।
২২]
উরুং হি রাজা বরুণশ্চকার সূর্যায় পন্থামান্বেতবা উ ।
অপদে পাদা প্রতিধাততেকরু তাপবক্তা হৃদয়াবিধশ্চিৎ।
ঋগ্বেদ-১/২৪/৮
অর্থাৎ - রাজা বরুণ সূর্যের পথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তার পদস্থাপনের জন্য যেখানে কোন পদচিহ্ন নেই। কোন মৌখিক আদেশ ব্যতিরেকে এ নির্দিষ্ট করা হয়েছে কেননা এ তার (সূর্যের) হৃদয়ে প্রোথিত আছে । বেদ বলছে সূর্য আকাশে বা নিখিল বিশ্বে ভ্রমণ করে, নক্ষত্রমণ্ডলগত ধূলার সাহায্যে। এই ধূলাকে বেদে 'আপঃ' বলা হয়েছে। আপঃ শব্দের অর্থ জল, এবং বরুণ জলের দেবতা। সুতরাং সে নক্ষত্রমণ্ডলগত আকাশেরও রাজা। তিনিই সূর্যের মার্গ প্রশস্ত করে দেন। .
২৩]
কৃষ্ণং নিয়ানং হরয়ঃ সুপর্ণা অপো বসানা দিবমুৎ পতন্তি। ত আববৃত্রন্ ৎসদনাদৃতস্যাদিদ্ ঘৃতেন পৃথিবী ব্যুদ্যতে।।
ঋগ্বেদ ১/১৬৪/৪৭
ভাবার্থ :- সূর্যের তীব্র কিরণ জলের উপর পতিত হয় এবং জলকে হরণ করে নিয়ে যায়। সেই জল বাদল রূপে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে। সেই স্থান আচ্ছাদিত করে যেখানে সে থাকে। অভিপ্রায় এইযে, যে স্থানের উপর বাদল থাকে সেখানে সূর্যের কিরণ পড়ে না। তারপর এর অনন্ত 'ঋত' বশতঃ বাদল থেকে জল হয় এবং ভূমি আর্দ্র করে দেয়। 'ঋতস্য' বলার অর্থ এই যে, প্রকৃতির অটল নিয়ম (Eternal Law) হেতু বাদল পুনরায় জলরূপ পরিগ্রহ করে এবং পৃথিবীর উপর বর্ষণ করে ভূমিকে আর্দ্র করে।
২৪]
কো অস্মিন্নাপো ব্যঃ দধাদ্বিষূবৃতঃ পুরুবৃতঃ সিন্ধুসৃত্যায জাতাঃ।
তীব্রতা অরুণা লোহিনিস্তাম্রধুম্রা উর্ধ্বা অবাচীঃ পুরুষে তিরশ্চীঃ।। অথর্ব্বেদ ১০/২/১১

অনুবাদঃ- কোন সেই পরমাত্মা যিনি এই মানবদেহে জলের ন্যায় তরল (রক্ত) কে সৃষ্টি করেছেন যা দেহের সকল খানে ঘূর্ণায়মান, দেহকে পুষ্টিদানকারী, লৌহধাতু যুক্ত, কখনো উজ্জ্বল লাল বর্ণের, কখনো কালচে লাল বর্ণের, দেহে সমুদ্রের ন্যায় সিন্ধুতে ( শিরা ও ধমনী) তীব্র গতিতে উপরে নিচে সকল দিকে প্রবাহমান।
২৫]
সুহবমগ্নে কৃত্তিকা রোহিনী চাস্ত ভদ্রং মৃগশিরঃ শমার্দ্রা। পুনর্বসু সুনৃতা চারু পুষ্যো ভানুরাশ্লেষা অয়নং মঘা মে। পুণ্যং পূর্বাফল্গুন্যৌ চাত্র হস্তশ্চিত্রা শিবা স্বাতি সুখো মে অস্ত। রাধে বিশাখে সুহবানুরাধা জ্যেষ্ঠা সুন ক্ষত্ররিষ্টমূলম্। অন্নং পূর্বা রাসতাং মে অষাঢ়া উর্জং দেব্যুত্তরা আবহস্ত। অভিজিম্মে রাসতাং পুণ্যমের, শ্রবণঃ শ্রবিষ্ঠাঃ কুর্বতাং সুপুষ্টিম্। আ মে মহচ্ছতভিষগ্ বরীয় আ মে দ্বয়া প্রোষ্ঠপদা সুশর্ম। আ রেবতী চাশ্বয়ুজৌ ভগং ম আ মে রয়িং ভরণ্য আবহস্ত।।
 অথর্ব্বেদ ১৯/৭/২/৩৮। 

ভাবার্থঃ এখানে জ্যোতিষকে শ্রেষ্ঠ বেদাঙ্গ বলা হয়েছে। এর দ্বারা নক্ষত্র ও সূর্যাদির গতির জ্ঞান হয়। এই মন্ত্রে ২৮ টি নক্ষত্রের নাম দেওয়া হয়েছে। যাদের বরাবর চন্দ্র পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে এবং যে নক্ষত্রের পাশে যে মাসে অবস্থান করে চন্দ্র সেই নক্ষত্রের নাম অনুসারে বাংলা মাসের নাম করা হয়েছে।
এখানে একটি বিষয় খুবই লক্ষ্যনীয় সৃষ্টির আদিতে বিজ্ঞানের কোন দুরবীক্ষন যন্ত্র ছিল না অথচ ঋষিগণ সামাধীতে ধ্যানস্থ হয়ে ঐ সকল নক্ষত্র দর্শনলাভ করেছেন, চন্দ্র পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে এবং কোন কোন মাসে কোন কোন নক্ষত্রের পাশে অবস্থান করে কত দিনে এক বার প্রদক্ষিণ করে তাও জেনে মাসের নাম গুলি অনুমান করেছিলেন। লক্ষ লক্ষ বছর পর বিজ্ঞান তা প্রমাণ করেছেন বেদ এর উল্লিখিত মন্ত্রটি।
২৬]
দ্বাদশ প্রধয়শ্চক্রমেকং ত্রীণি নভ্যানি ক উ তচ্চিকেত।
তস্মিনৎসাকং ত্রিশতা শঙ্কবোऽপিতাঃ ষষ্টির্ন চলাচলাসঃ।।
ঋগবেদ-১/১৬৪/৪৮

ভাবার্থঃ- এই মন্ত্রে দ্বাদশ মাসে  ৩৬০ দিনের চান্দ্র মাসের বর্ণনা পাওয়া যায়।
যা বিজ্ঞানের প্রসারের লক্ষ লক্ষ বছর আগে সৃষ্টির আদিতে ঋষিগণ ধ্যানস্থ হয়ে জেনেছেন। যা অপৌরষীয় এবং বেদ এ আছে। লক্ষ লক্ষ বছর পর বিজ্ঞানীরা প্রমান করেছেন বেদ এর উল্লিখিত চন্দ্র মাস এর গননা সঠিক।
২৭]
অহস্তা যদপদী বর্ধত ক্ষা শচীভিৰ্বেদ্যানাম্ । শুষ্ণং পরিপ্রদাক্ষিণি বিশ্বায়বে নিশিথঃ।
ঋগ্বেদ ১০/২২/১৪।

বঙ্গানুবাদ - পৃথিবী যদিও হস্তপদহীন তথাপি ইহা চলিতেছে, অবশ্য জ্ঞাতব্য পরমাণুর শক্তি দ্বারা সূর্যের চারিদিকে ইহা প্রদক্ষিণ করিতেছে, হে পরমাত্মন। সমগ্র মানবের মধ্যে আস্তিক্য বোধ জাগাইবার জন্যই তুমি এরূপ রচনা করিয়াছ।
২৮]
সবিতা যন্ত্রেহ পৃথিবী মরামদক্ষম্ভলে সবিতাদ্যমধত। 
অশ্বমিবাদুক্ষদ ধুমিন অন্তরীক্ষ মতুরতেবাধয় সবিতা সমুদ্রম॥" ঋগ্বেদ- ১০/১৪৯/১

অনুবাদ -সূর্য রজ্জুবৎ আকর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। নিরাধার আকাশে দ্যুলোকের অন্যান্য গ্রহকেও ইহা সুদৃঢ় রাখিয়াছে। অচ্ছেদ্য আকর্ষণ রজ্জুতে আবদ্ধ, গর্জনশীল গ্রহসমূহ নিরাধার আকাশে অশ্বের ন্যায় পরিভ্রমণ করিতেছে।

দেখুন, আকাশ যে 'নিরাধার' এবং 'রজ্জুবৎ আকর্ষণ' অর্থাৎ মহাকর্ষ শক্তির দ্বারাই যে সেই নিরাধার আকাশে সূর্য ও গ্রহসমূহ নিজ অক্ষরেখায় সুদৃঢ় রয়েছে এখানে সেকথা বলা হয়েছে।  সৃষ্টির আদিতে ঈশ্বরকৃত প্রেরিতে বেদে আকাশকে 'নিরাধার অর্থাৎ পৃথিবীকে ও গ্রহসমূহকে শূন্যে ভাসমান বলে ঘোষণা করেছেন।
২৯]
'আকৃষ্ণেন রজসা বর্তমানো নিবেশয়ন্নমৃতং মৰ্তঞ্চ। 
হিরণ্ময়েন সবিতা রথেনা দেবো যাতি ভুবনানি পশ্যন্ ॥' 
ঋগ্বেদ,১/৩৫/২

অনুবাদ – সূর্য আকর্ষণযুক্ত পৃথিব্যাদি লোক-লোকান্তরকে সঙ্গে রাখিয়া নশ্বর-অবিনশ্বর উভয় পদার্থকে নিজ নিজ কার্যে নিযুক্ত রাখিয়া এবং মাধ্যাকর্ষণ রূপে রথে চড়িয়া যেন সারা লোকান্তর দেখিতে দেখিতে গমন করিতেছে।

অর্থাৎ পৃথিবী যেমন চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে, তদ্রুপ সূর্যও যে তার গ্রহ-উপগ্রহসমূহকে সঙ্গে নিয়ে নিজের কক্ষপথে গমন করছে।
৩০]
হিরস্যপানি সবিতা বিকারসভির উভে দ্যবা পৃথিবী অন্তর ইযতে। 
অপমিবাম বাধাতে য়েতিসূর্যম অভি কষ্নেন রাজস ধ্যম য়োতি॥
ঋগবেদ ১/৩৫/৯

অনুবাদঃ সূর্য নিজপথে ঘোরে এবং তা পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহসমূহকে আকর্ষনশক্তি দ্বারা এমন উপায়ে চালিত করে যাতে তাদের একে অপরের সাথে সংঘর্ষ না হয়।
৩১]
ॐ বৃহস্পতিঃ প্রথমম্ জায়মানো মহো জ্যোতিষঃ পরমে বয়োমন্। সপ্তাস্যষতুবিজাতো রবেণ বি সপ্তরশ্মিরধমতমামসি
ঋগ্বেদ-৪/৫০/৪

পদার্থঃ- (বৃহস্পতি) বৃহস্পতি  (মহঃ) বড় (জ্যোতিষঃ) প্রকাশমান সূর্য থেকে (পরমে) দূরবর্তী স্থানে  (প্রথমম্)প্রথমে (জায়মানঃ) সৃষ্টি হয় (বয়োমন্) ব্যাপক (সপ্তাস্যঃ) স্বীকৃত সাতটির মধ্যে (তুবিজাতঃ)অনেকের মধ্যে পরিচিত (রবেণ)গতির মাধ্যমে শব্দ উৎপন্ন ও (সপ্তরশ্মি)সাত রশ্মির দ্বারা (তমাম্সি) অন্ধকার (বি,অধমত্) দূর করে।

ভাবার্থঃ-প্রকাশমান সূর্য থেকে  দূরবর্তী স্থানে প্রথম উৎপন্ন হয় বৃহস্পতি।সুপরিচিত অন্যান্য স্বীকৃত সাতজনের মধ্যে,এটি অস্তিত্ব  লাভ করে প্রচন্ড গতি ও গতির কারণে উৎপন্ন উচ্চ শব্দ সহ এবং তার সপ্ত রশ্মির তেজ দ্বারা মহাকাশের অন্ধকার দূর করার মাধ্যমে।

শতপথ ব্রাহ্মণে গল্প বলার মতো করে উল্লেখ করা হচ্ছে 

"……. যখন বৃহস্পতি মহাশূন্যে স্থাপিত হলো  তখন পৃথিবী ভয় পেয়েছিল এবং বলেছিল 'এখন যেহেতু এটি পবিত্র এবং বড়, এটি কি আমাকে ছিন্ন করবে?একইভাবে বৃহস্পতি ও ভয় পেয়েছিল এবং বলেছিল 'পৃথিবী কি আমাকে আঘাত করবে?' কিন্তু উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন হলো…."
(শতপথ ব্রাহ্মণ ৫/২/১/১৮)
৩২]
নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ। কিমাবরীবঃ কুহু কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীহনং গভীরম্ ॥ 
ঋগ্বেদ-১০/১২৯/১

ভাবার্থ- যা নেই তাও ছিল না, যা আছে তাও ছিল না। পৃথিবী ছিল না, অতি দূরবিস্তৃত আকাশও ছিল না। আবরণ করে এমন কি ছিল? কোথায় কার স্থান ছিল? দুর্গম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিল?
মুলত এই প্রশ্নের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে জিজ্ঞাসা বা জানার জন্য অবতাড়না করে ছিলেন? যা উত্তর ধীরে ধীরে বেদ এর  বিভিন্ন মন্ত্রের মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন।

প্রথমে হিরন্যগর্ভ সৃষ্টিহল।সেখানে ছিল উত্তপ্ত গলিত তরল। এটি ছিল মহাশুন্যে ভাসমান। বছরের পরবছর এই অবস্থায় অতিক্রান্ত হয়।
(শতপথ ব্রাহ্মণ, ১১/১/৬/১)
৩৩]
আপো হ যদ্ধৃ হতীবিশ্বমায়ন্ গর্ভং দধানা জনয়ম্ভীরগ্নিম্ । ততো দেবানাং সমবর্ত তাসুরেকঃ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।।
ঋগ্বেদ-১০/১২১/৭

ভাবার্থঃ- হিরন্যগর্ভে ছিল উত্তপ্ত তরল যাতে ছিল সৃষ্টির সমস্ত বীজ। তিনিই ছিলেন একমাত্র অধিশ্বর। 
৩৪]
ব্রহ্মণস্পতিরেতা সং কর্মার ইবাধম‍ৎ।
দেবানাং পূর্ব্যে যুগেঽসতঃ সদজারত।।
ঋগবেদ-১০/৭২/২

ভাবার্থঃ- যেখানে বিস্ফোরন ঘটল গলিত পদার্থ থেকে, বিন্দু থেকে যেন সব প্রসারিত হতে শুরু হল।
৩৫]
দেবাঁ উপ প্রৈৎসপ্তভিঃ পুরা মার্তাণ্ডমাস্যৎ।।
সপ্তভিঃ পুত্রৈরদিতিরূপ প্রৈৎপূর্বং যুগম।
প্রজায়ৈ মৃতবে ত্বৎপুনর্মার্তাণ্ডমাভরৎ।।
ঋগ্বেদ-১০/৭২/৮-৯

ভাবার্থঃ- সৃষ্ট ক্ষেত্রে সাতধাপে সংকোচন-প্রসারণ সম্পন্ন হল।তারপর সৃষ্টি হল ভারসাম্যের।

অর্থাৎ এই সাতটি সামর্থ্যকে বিজ্ঞানের ভাষায় এই প্রকারে বলা যেতে পারে-(এক) পরমাণু মধ্যে ইলেক্ট্রোনের ঘুর্ণন শক্তি (Inter atomic energy), (দুই) রাসায়নিক শক্তি   (Chemical energy),  (তিন) অনুদের  মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখার শক্তি (lnter molecular dynamics), অথবা সংগঠন শক্তি, এর দ্বারা শক্ত,তরল ও বায়ব্য ( Solids Liquids, Gasses)  অবস্থা  উৎপন্ন হয়। ( চার) ভূ-আকর্ষণ  (Gravity), (পাঁচ) চুম্বকীয় শক্তি (Magnetism) ( ছয়) আকাশ ও শব্দ(  Light and sound) (সাত) বায়ু। এদের সংকোচন-প্রসারন এর ফলে ভারসাম্য সৃষ্ট হলো।
৩৬]
দেবানাং যুগে প্রথমঽসতঃ সদজায়ত।
তদাশা অন্বজায়ন্ত তদুত্তানপদস্পরি।
ঋগবেদ-১০/৭২/৩

ভাবার্থঃ সেই বিস্ফোরিত অংশসমূহ থেকে বিভিন্ন গ্রহ,নক্ষত্র তৈরী হল।
৩৭]
ভূর্জজ্ঞ উত্তানপদো ভুব আশা অজান্ত।
অদিতের্দক্ষো অজায়ত দক্ষাদ্বদিতিঃ পরি।।
ঋগ্বেদ- ১০/৭২/৪

ভাবার্থঃ- এক জীবনপ্রদ অংশ থেকে পৃথিবী এবং সূর্য সৃষ্টি হল। এতে সকল দিক গুলি দৃষ্ট হলো।
৩৮]
তম আসীত্তমসা গড়্হমগ্রেঽ প্রকেতং সলিলং সর্বমা ইদম্ । তুচ্ছ্যনাভ্বপিহিতং যদাসীত্ত- পসস্তন্মহিনাজায়তৈকম্।।
ঋগ্বেদ-১০/১২৯/৩

ভাবার্থ- এই মন্ত্রের অভিপ্রায় এই- পরমাত্মার লাগামরূপ জ্যোতিকে তথা cosmic ray এর একটা অংশ মূল প্রকৃতির উপর ঝাটকে পড়ে প্রকৃতির নির্মাণ কার্য শুরুর পর অন্ধকারের দ্বারা আবৃত ছিল তখন সব কিছুর চিহ্নবর্জিত এবং জলমগ্ন ছিল। অবিদ্যমান বস্তু দ্বারা সে সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিলেন। ও৩ম্ ধ্বনির প্রভাবে এক বস্তুর জন্ম নিলেন। সেখান থেকে প্রচণ্ড তাপের সৃষ্টি হল।
৩৯]
হিরণ্যগর্ভঃ সববর্ততাগ্রে ভুতস্য জাত পতিরেক আসীৎ।
স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাং কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।।
ঋগবেদ- ১০/১২১/১

ভাবার্থঃ হিরন্যগর্ভই সৃষ্টি হলো অর্থাৎ সর্বপ্রথম জলময় প্রাণের উৎপত্তি হয়। এখানে প্রথম প্রাণকে প্রজাপতি( ব্রহ্মা) বলা হয়েছে।
৪০]
যো হত্বাহিমরণাৎ সপ্ত সিন্ধুন্যো গা উদাজদপধা বলস্য । 
যো অশ্ননোরম্তরগ্নিং জজান সম্বূক্ সমস, সমৎসু স জনাস ইন্দ্ৰঃ ॥ 
ঋগ্বেদ ২/১২/৩

ভাবার্থঃ- হে মানব! ইন্দ্রই (সর্ব ঐর্শ্বর্য্যের অধিকারি পরমাত্মা) পৃথিবী সহ চন্দ্র, সপ্ত গ্রহ ও উপগ্রহসমূহ এবং নক্ষত্রকে সৃষ্ট  করে চলমান রেখেছেন, এমনকি পৃথিবীতে সপ্ত সমুদ্রকে চলমান রেখেছে। তিনিই তা রক্ষা এবং কার্যকর রাখবেন। 
৪১]
যেনেমা বিশ্বা চ্যবণা কৃতানি যো দাসং বর্ণ মধরং গূহোকঃ । শ্বঘ্নীব যো জিগীবাং লক্ষমাদদর্যঃ পুষ্টানি স জনাস ইদ্ৰঃ।
ঋগ্বেদ ২/১২/৪

ভাবার্থঃ- সেই ইন্দ্রই  (সর্ব ঐর্শ্বর্য্যের অধিকারি পরমাত্মা) এই গতিশীল সৃষ্টির সকল চলমান বস্তুর স্রষ্টা। তিনিই জলন্ত অগ্নী পিণ্ড তথা নক্ষত্র, নক্ষত্র থেকে গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি করে প্রত্যেককে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপন করেছেন। যেমন পৃথিবী সৃষ্টি করে সৃষ্ট জীবের রাত্রী কালীন আনন্দের জন্য চন্দ্র সৃষ্টি করে সৃংঙ্খলার সহিত স্থাপন করে চলমান রেখেছেন যেন শিকারীর লক্ষ্য অর্জনের মত।
তাই এইই গতিশীল সৃষ্টির সকল চলমান বস্তুতে ঈশ্বর পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন।
অর্থ্যাৎ পবিত্র বেদ বলেই দিয়েছে যে পৃথিবী, সুর্য, অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র থেকে শুরু করে সমগ্র সৃষ্টি গতিশীল।
৪২]
য়ে তে পন্থা অধো দিবো য়েভির্ব্যশ্বমৈবয়ঃ। 
উত শ্রোষক্ত নো ভুবঃ।।
সামবেদ- ১৭২
 সরলার্থঃ হে লোক-লোকান্তরের ব্যবস্থাপক পরমেশ্বর! তোমার দ্বারা রচিত থে পথ দ্যুলোকের নিচে অর্থাৎ ভূমি, সমুদ্র এবং অন্তরিক্ষে অবস্থিত রয়েছে, যেখানে ঘোড়াবিহীন গতিশীল পৃথিবী, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ ইত্যাদি গ্রহ উপগ্রহ কে তুমি চালনা করেছ। সেই পথ সম্বন্ধে আমাদের ভুলোকবাসী প্রজাও শ্রবন করুক এবং শ্রবন করে জানুক।

৪৩]
সবিতা যন্ত্ৰৈঃ পৃথিবী যরভনাদস্কম্ভনে সবিতা দ্যামদূংহৎ।
অশ্বমিবাধুক্ষুদধা নিমন্তরিক্ষমতূর তে
বদ্ধং সবিতা সমুদ্রম৷৷ 
ঋগবেদঃ-১০/১৪৯/১

ভাবার্থঃ- সূর্য রজ্জবৎ আকর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। নিরাধার আকাশে দ্যুলোকের অন্যান্য গ্রহকেও ইহা
সুদৃঢ় রাখিয়াছে। অচ্ছেদ্য আকর্ষণ রজ্জুতে আবদ্ধ,
গৰ্জ্জনশীল গ্রহ সমূহের নিরাধার আকাশে অশ্বের ন্যায় পরিভ্রমণ করিতেছে।
৪৪]
দ্বাদশারং মহি তজ্জরায় বর্বর্তি চক্রং পরি দ্যামুতস্য।
আ পুত্রা অগ্নে মিথুনাস্য অত্র সপ্ত শতানি বিংশতিশ্চ তস্থুঃ।।
ঋগবেদ: ১/১৬৪/১১

ভাবার্থঃ  সত্য স্বরুপ কালের সম্বৎসর চক্র চারিদিকে পরিভ্রমণ করিতেছে। তাহাতে দ্বাদশটী অর বিশিষ্ট চক্র আছে, তাহা কখনও জীর্ণ হয় না। হে পরমাত্মান্! তোমার রচনা অদ্ভুত। এই চক্রে ৩৬৫ দিন ও ৩৬৫ রাত্রি মোট ৭২০ পুত্রের ন্যায় বেষ্টন করিয়া বাস করে।
৪৫]
অত্রাহ গোরমম্বত নাম ত্বষ্টুরপীচ্যম্। ইত্থা চন্দ্ৰমসো গৃহে।
ঋগবেদ ১/৮৪/১৫

ভাবার্থঃ- সূর্যের চারপাশে পৃথিবী এবং পৃথিবীর চারপাশে চাঁদের অবস্থানের সাপেক্ষে চন্দ্রকলার আকৃতি পরিবর্তন ঘটে। প্রতিবার এতে সময় লাগে প্রায় ২৯.৫৩ দিন এবং এ সময় কালকে চান্দ্রমাস বলে। এই চন্দ্র মাসের অর্ধেক সময় সূর্যের রশ্মির থেকে চন্দ্র আলোকিত থাকে।
৪৬]
আয়ং গৌঃ পৃশ্নিরক্রমীদসদন্মাতরং পুরঃ।
পিতরং চ প্রয়ন্ত্স্বঃ।।
ঋগবেদ-১০/১৮৯/১

ভাবার্থঃ পৃথিবী তার মাতা জলকে নিয়ে অন্তরিক্ষে চলমান রয়েছে, এবং তার পিতা সুর্যের চারদিকে ঘূরছে।
৪৭]
ইহ ব্রবীতু য ঈমঙ্গ বেদাস্য বামস্য নিহিতং পদং বেঃ।
শীর্ষ্ণ ক্ষীরং দুহ্রতে গাবো
 অস্যবব্রিং বসানা উদকং পদাপুঃ।। 
ঋগ্বেদ ১/১৬৪/৭

ভাবার্থঃ- হে মিত্র, যিনি  সর্ব জ্ঞানী পরমাত্মা তিনিই বলতে পারেন এই রহস্য । পবিত্র সূর্যের আলোক যখন গাছের উপর পড়ে আর গাছ যখন তার পা দিয়ে (মূল) মাটি থেকে জল গ্রহন করে এবং এর মাধ্যমেই আমাদের উপর খাদ্য ও জীবন বর্ষিত হয়।
৪৮]
অয়ম্ ভেনশ্চোদ্যতপৃশ্নিগর্ভা জ্যোতির্জরায়ু রজসো বিমানে।ইমমপাম্ সংগমে সূর্যস্য শিশুম্ ন বিপ্না মতিভী রিহন্তি।
ঋগ্বেদ-১০/১২৩/১

ভাবার্থঃ-সূর্যের সন্তানরূপ ভেন অন্তরীক্ষে অন্যান্য উড্ডয়নরত বস্তুর মতো অবস্থান করছে।এই ভেন সূর্য রশ্মি ও তরল

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted