চরমপন্থী বিপ্লবীরা কীভাবে গান্ধীজিকে মূল্যায়ণ করে গেছেন, তা নিয়ে লিখবো বলেছিলাম। আজ প্রথম পর্ব।
আজকের পর্বে বীণা দাস (ভৌমিক) এর স্মৃতিকথা। স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করার প্রচেষ্টায় জেল খাটা, পরবর্তীকালে আবার ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করা বীণা দাস নোয়াখালি দাঙ্গার সময় আক্রান্ত হিন্দুদের রক্ষা করতে গান্ধীজির সঙ্গে কাজ করেছিলেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে উনি নিজের আত্মজীবনীতে কী বলে গেছেন, নিজেই পড়ে দেখুন। ঘেন্না নাকি শ্রদ্ধা কোনটা খুঁজে পাচ্ছেন! নাকি বীণা দাসকেও গালাগালি করবেন?!🙂
"নোয়াখালিতে অনেকদিন পরে গান্ধীজিকে আবার কাজে পেলাম। বাংলা দেশের বড় অভিমান ছিল গান্ধীজি বাংলাকে বেশি ভালোবাসেন না। এবার তাদের দুঃখ - অভিমান নিঃশেষে মুছে দিয়ে বাঁহলার চরম দুর্দিনে গান্ধীজি তাদের অত্যন্ত কাছে এসে দাঁড়ালেন , সমস্ত ভাবনা, চিন্তা , সমস্যার বোঝা মাথায় তুলে নিলেন। দুটো দিন প্রায় সারাক্ষণই তাঁর কাছে ছায়ার মতো ঘুরলাম।
নোয়াখালির সেদিনের সেই অবস্থায় কোনো পথ কোনো আলোই দেখতে পাই না। হিন্দুরা সংখ্যায় এত কম, কোনো কোনো গ্রামে মাত্র চার - পাঁচ ঘর হিন্দু রয়েছে, তা ছাড়া বাড়িগুলোও এত দূরে দূরে, এরকম অবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওরকম মনোভাবের মাঝে কী করে থাকবে ওরা? ভরসা দেবার কোনো কিছুই খুঁজে পাই না যে? বাপুজিকে সব কথাই খুলে বললাম। তিনি বললেন, " সবই তো ঠিক, কিন্তু কীই বা করা যায়? তবে কাউকে তো আমরা ফিরে আসতে জোর করছি না; যদি আসে, তাদের কাছে তাদের পাশে আমরাও রয়েছি। আর যদি কিছু নাও পারি, ওদের সঙ্গে মরতে তো পারবো।"
বড়ো যেন করুণ আর অসহায় শোনাচ্ছিল ওর মুখের কথাগুলো।
আমাদের গ্রামে কিছুদিন আগে ইদ্রিস পাঠারী বলে একটি মুসলমানকে মেরে ফেলেছে মুসলমানরাই। দুই দলই লুঠের মাল নিয়ে ঝগড়ার ফলে আর কি! গান্ধীজিকে জানিয়ে রাখলাম ব্যাপারটা, বললেন, " সত্যিই আমাদের ক্যাম্পের ও- ব্যাপারে কোনো যোগ নেই তো! তবে আর কি! নিশ্চিন্ত থাক, যা খুশি বলুক ওরা!" তারপর মৃদুলাকে হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, " ফাঁসি যেতে পারবি তো?"
গান্ধীজির সঙ্গে প্রার্থনা সভার পর সন্ধ্যাবেলা একসঙ্গে বেড়াতে গেলাম। গ্রামের সে পথটা পরিষ্কার করা হয়নি তত! কে যেন আমাদের বললেন, "আপনি আগে আগে গিয়ে পথটা দেখুন, কাঁটা আছে কি না!" তাকিয়ে দেখি আমার পায়ে চটি। ওর চোখ এড়ালো না, পরম স্নেহের সুরে বললেন, "বীণা, তোর পা খালি করলে আমি কি আমার পায়ে কম ব্যথা পাবো রে!"
সেদিন রাস্তায় অনেক গল্প করলাম, বাংলায় আগে কবে কবে গান্ধীজি এসেছেন, বাংলা ভাষা কবে প্রথম শিখতে আরম্ভ করেন, সেই সব পুরনো দিনের গল্প। রবীন্দ্রনাথের কথা উঠলো , বললাম " ভাগ্যিস উনি আজ বেঁচে নেই, বাংলার এই অবস্থা সহ্য করতে পারতেন না তিনি।"
গান্ধীজি সায় দিয়ে বললেন, "ঠিক বলেছিস, রবীন্দ্রনাথের মন অত্যন্ত কোমল ছিল। আমার সেবারের প্রায়োপবেশনের সময় আমার কাছে গিয়েছিলেন, তখন তিনি চোখের জল রাখতে পারেন নি!"
এবার গান্ধীজিকে দেখে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, উনি যেন বড়ই একা, কেউ কোথাও সঙ্গী নেই। ওর মনের সাহচর্য দিতে পারেন এমন মানুষই বা সংসারে কোথায়? যারা পারতেন তারাও তো কেউ আজ নেই, মহাদেব দেশাই, কস্তুরবা , রবীন্দ্রনাথ। গান্ধীজি নোয়াখালীতে তাঁর শিষ্য- প্ৰশিষ্যদের সব দূরে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।কাছে ছিল শুধু নাতনি । .....
সব চাইতে ভালো লাগতো ভোরবেলা গান্ধীজির সঙ্গে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়াটা । সারাপথ গান গাওয়া হত : " যদি তোর ডাক শুনে কেউ যদি না আসে,"" তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে", " একবার তোরা মা বলিয়ে ডাক", এইসব গান্ধীজির প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতগুলি।
ভোরবেলা শিশিরভেজা পথ, কপালে মাথায় পড়েছে প্রভাতসূর্যের প্রথম আলো, গান্ধীজির পাশে পাশে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গাইতে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়া- কেবলই মনে হচ্ছিল, আমাদের এ যাত্রা যেন শেষ না হয়। এই পথ যেয়েই যেন পৌঁছে যেতে পারি মানুষের চরম কল্যাণের শিখরে - যেখানে নেই কোনো রক্তের দাগ, নেই কোনো স্বার্থের হানি, নেই কোনো অন্যায় আর অত্যাচারের উদ্ধত আস্ফালন।"
-শৃঙ্খল ঝঙ্কার - বীণা দাস (ভৌমিক), page 113-116, Radical Impression Publication
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................