ভারতবর্ষের ইতিহাস বিশ্লেষণে বিরাট ভুল আছে।

ভারতবর্ষের ইতিহাস বিশ্লেষণে বিরাট ভুল আছে। ১৯৪৭ সালে বিভাজিত ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়। মুসলমানদের জন্য পরাধীনতা ছিল মাত্র দুশো বছরের, পক্ষান্তরে হিন্দুর জন্য পরাধীনতা ছিল হাজার বছরের। ইসলাম ধর্মাবলম্বী বিদেশি জেনারেলরা ভারতবর্ষ দখল করার পূর্বে, হিন্দুরা ভারতবর্ষের অঞ্চল ভেদে ৫০০ থেকে ৭০০ বছর, অহিন্দু বৌদ্ধ ও জৈন শাসক কর্তৃক শাসিত হয়েছে। বিধর্মীর শাসন, হিন্দুদের জন্য মোটেও সুখকর ছিল না -  বিশেষ করে বিদেশ থেকে এসে ভারতভূমি দখল করা ইসলাম ধর্মাবলম্বী জেনারেলদের শাসন। 
 
স্বাধীন ভারতে, হাজার বছরের পরাধীন হিন্দু জাতির জন্য রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হিন্দু বিদ্বেষী নাস্তিক জওহরলাল নেহেরু ও তাঁর ধর্মান্তরিত কন‍্যার বংশধারার দীর্ঘ পরিবারতান্ত্রিক সেক‍্যুলার শাসন - হিন্দু জাতির প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করে,হিন্দু জাতির মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙে দিয়েছে। হিন্দু জাতি বর্ণভেদ-এ বিভক্ত। স্বাধীন ভারতের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য ছিল, আইন করে মানবতার শত্রু এই 'বর্ণভেদ প্রথা' - নিষিদ্ধ করা। তা না করে, সেক‍্যুলার শাসকরা বর্ণভিত্তিক সংরক্ষণ ব‍্যবস্থা চালু করে,হিন্দু জাতিকে স্থায়ী ভাবে বিভক্ত করে ফেলেছে। সংরক্ষণ দেওয়া উচিত ছিল, অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে।

শত্রুপক্ষের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে,সেক‍্যুলার প্রচার মাধ্যম দিন রাত দুটি শব্দ-কে আক্রমণ করে যাচ্ছে। শব্দ দুটি হচ্ছে, 'মনুবাদ' ও 'ব্রাহ্মণ‍্যবাদ'। 'আদিপিতা মনু' ও 'ব্রাহ্মণ' শব্দ দুটিকে কেন টার্গেট করা হলো ? শত্রুপক্ষ জানে, আদিপিতা ব্রাহ্মণ মনুর বংশধর হিসেবে, প্রত‍্যেক সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু - উচ্চতম বর্ণ ব্রাহ্মণে উন্নীত হয়ে, জাতিভেদ প্রথা বিলুপ্ত করে ফেলতে পারে। মহাভারতের শান্তিপর্বে 'ভৃগু-ভরদ্বাজ সমাচার' - অংশে আছে, 'অতীতে মানবজাতির সবাই ব্রাহ্মণ ছিল। পরবর্তী সময়ে পেশার ভিত্তিতে মানবজাতি বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত হয়েছে। বর্ণ পরিবর্তনযোগ্য।'
স্মরণ করা যেতে পারে,'কুলপদবী' ঈশ্বর প্রদত্ত কোন উপাধি নয়। পেশাগত পদমর্যাদা থেকে 'পদবী' এসেছে। পছন্দ অনুযায়ী কুলপদবী গ্রহণ-বর্জন করা যায়।
শত্রুপক্ষ হিন্দু জাতির যাবতীয় সর্বনাশের দায় তথাকথিত মনুবাদী ব্রাহ্মণদের উপর চাপিয়ে দিয়ে,'আদিপিতা মনু' ও 'ব্রাহ্মণ' - বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, মানুষের মন এমন ভাবে বিষিয়ে দিয়েছে ― অনেকেই একথা জানে যে আদিপিতা মনুর বংশধর হিসেবে সে জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ - অথচ সে ব্রাহ্মণ সমাজে ফিরে আসার চিন্তা-ভাবনা করছে না। 

প্রতিটি সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুর, উচ্চতম বর্ণ ব্রাহ্মণ-এ উন্নীত হওয়া ব‍্যতীত - হিন্দু জাতির সমমর্যাদায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার, আর কোন শাস্ত্র-সিদ্ধ রাস্তা খোলা নেই।

বাঙালি হিন্দু সমাজে সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী সম্প্রদায় হচ্ছে, 'নমঃশূদ্র'। দ্বাদশ শতক পর্যন্ত নমঃশূদ্ররা ছিল বংশানুক্রমিক ব্রাহ্মণ।  কিন্তু তারা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে, সমাজচ্যুত এবং অস্পৃশ‍্য ঘোষিত হয়। শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর এবং মহাত্মা গুরুচাঁদ ঠাকুরের কৃপায়, নমঃশূদ্র সম্প্রদায় যখন আধুনিক শিক্ষার  সংস্পর্শে এসে জানতে পারে যে, অতীতে তারা উচ্চ শ্রেণির ব্রাহ্মণ ছিল ; তখন তারা উপনয়ন সংস্কারের মাধ্যমে পৈতা ধারণ করে, ব্রাহ্মণ সমাজে ফিরে আসার চেষ্টা করলে, সমস্ত বর্ণহিন্দু একত্রিত হয়ে তাদের প্রতিহত করে। একদল ইতর এক কথাও বলে যে, ওরা 'চাঁড়াল' - হিন্দু নয়। মহাত্মা গুরুচাঁদ ঠাকুর প্রাণপণ সংগ্রাম করে 'চাঁড়াল' - শব্দটি সরকারি নথি থেকে বিলোপ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ঐ সময় যদি নমঃশূদ্ররা ব্রাহ্মণ সমাজে ফিরে আসতে পারতো,তাহলে কোন অবস্থাতেই দেশভাগ হতো না।
আমি নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে অনুরোধ করছি, আপনারা ব্রাহ্মণ সমাজে ফিরে এসে, হারানো অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করুন। আপনাদের বাধা দেওয়ার সাধ‍্য - এখন আর কারো নেই। নমঃশূদ্ররা যদি ব্রাহ্মণ সমাজে ফিরে আসে, তাহলে মধ‍্যবর্ণ সহ অন্যান্য সমস্ত সম্প্রদায়, ব্রাহ্মণ সমাজে ফিরে আসতে উৎসাহিত হবে ; জাতিভেদ প্রথার অভিশাপ থেকে হিন্দু জাতি মুক্ত হবে।

ভারতবর্ষের প্রামানিক ইতিহাস সর্বোচ্চ সাড়ে তিন হাজার বছরের। বিগত সাড়ে তিন হাজার বছরে আর্যাবর্তে ব্রাহ্মণ সম্রাট ছিলেন মাত্র একজন, তিনি 'পুশ‍্যমিত্র শুঙ্গ'(১৮৫-১৪৯ খ্রীষ্টপূর্ব)। এই বংশানুক্রমিক ব্রাহ্মণ জেনারেল তার সংগ্রামমুখর জীবনে, জৈনদের সহায়তায় বৌদ্ধ শাসকদের উচ্ছেদ করে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সুদিন ফিরিয়ে এনেছিলেন। পুশ‍্যমিত্র শুঙ্গের যদি জন্ম না হতো,ভারতভূমি হিন্দু সংখ‍্যাগরিষ্ঠ না হয়ে, থাইল্যান্ড-মিয়ানমারের মতো বৌদ্ধ সংখ‍্যাগরিষ্ঠ থাকতো। দীর্ঘ বৌদ্ধ শাসনে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যথেষ্ট কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল। সনাতন ধর্মশাস্ত্র সমূহ হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন পুশ‍্যমিত্র শুঙ্গ, সনাতন ধর্মের শাস্ত্র সমূহ উদ্ধার ও সংকলিত করতে, বেশকিছু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নিয়োগদান করেন। ঐ নিয়োগকৃত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা, ব‍্যক্তি ও গোষ্ঠীগত সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিতে, 'মনু সংহিতা' সহ বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র বিকৃত করে - জাতিভেদ প্রথা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এই 'শাস্ত্র-সংকলন' - কার্যে পুশ‍্যমিত্র শুঙ্গ সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না ; এবং সম্পৃক্ত থাকার সময়ও তাঁর ছিল না ; তিনি বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করতে সারাটা জীবন মরণপণ যুদ্ধ করেছেন।  এমন কোন ঐতিহাসিক প্রমাণও নেই যে - তিনি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের শাস্ত্রবিকৃত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুতরাং জাতিভেদ প্রথা ধর্মশাস্ত্রে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য পুশ‍্যমিত্র শুঙ্গা-কে অভিযুক্ত করা অন‍্যায়। পুশ‍্যমিত্র শুঙ্গ, সনাতন ধর্মের কল‍্যাণ সাধনের আন্তরিক প্রচেষ্টা স্বরূপ যাদের উপর দায়িত্বভার অর্পণ করেছিলেন  - তাদের ব‍্যর্থতার দায়, পুশ‍্যমিত্র শুঙ্গের ঘাড়ে চাপানোর কোন মানে হয় না। শুধু তা-ই নয়, পুশ‍্যমিত্র শুঙ্গের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ ধর্ম-নির্মূল করার না না কল্পকাহিনী প্রচার করা হয় ; এমনকি ঐ কল্পকাহিনী পাঠ‍্যপুস্তকে পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত। ক্ষমতাহারা যে সব বৌদ্ধ সামন্ত, বিদেশি আক্রমণকারীদের সহায়তা করেছিল ; পুশ‍্যমিত্র শুঙ্গ কঠোর হাতে তাদের দমন করেছিলেন, রাষ্ট্রের স্বার্থে - ব‍্যক্তিস্বার্থে নয়। সাড়ে তিন হাজার বছরের প্রামানিক ইতিহাসে একজন মাত্র ব্রাহ্মণ সম্রাটকে পেয়ে, তার ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা কি উদ্দেশ্যে চালানো হচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়।

প্রতিটি সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুকে উপলব্ধি করতে হবে, তার জন্য ব্রাহ্মণ পরিচয় কোন কলঙ্কিত পরিচয় নয়। ব্রাহ্মণ শব্দের অর্থ যার 'ব্রহ্মাজ্ঞান' আছে। 'ব্রহ্মাজ্ঞান' - হচ্ছে সৃষ্টি সম্পর্কিত যাবতীয় জ্ঞান ; যেমন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-অর্থনীতি-রাজনীতি-চিকিৎসাবিদ‍্যা সহ যাবতীয় বস্তুগত জ্ঞান। ইউরোপ-আমেরিকা-ইসরাইল-জাপান-ফ্রান্স-জার্মানি প্রভৃতি অগ্রসর দেশ সমূহ এই ব্রহ্মাজ্ঞানে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের তরুণ প্রজন্মকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি আধুনিক 'ব্রহ্মাজ্ঞান' -এ আলোকিত হয়ে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করবে ; না কি পূর্বপুরুষের স্থবির চিন্তায় ঘুরপাক খেয়ে - কুয়োর মধ্যে বসে থেকে,জাতির বিলুপ্তি চেয়ে চেয়ে দেখবে।

রচয়িতা
দেবাশীষ মুখার্জী

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted