নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস অথবা আরো এক স্বাধীনচেতা দুর্ভাগার কাহিনী।

নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস অথবা আরো এক স্বাধীনচেতা দুর্ভাগার কাহিনী
অজস্র মানুষ তাদের প্রশ্ন করার বা মুক্ত চিন্তার কারণে যুগে যুগে অত্যাচারিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
এর আগেও অনেক গুলো মানুষের বিষয়ে লেখার চেষ্টা করেছি,প্রশ্ন করেছি অজস্র মানুষের কাছে তাতে একটাই উপলব্ধি হয়েছে যে অর্ধশিক্ষিত এবং সজ্ঞানে ঘুমিয়ে থাকা লোকেদের জাগানো বড় কঠিন কর্ম।এর পরেও মোষ তাড়ানোর অভ্যাস আবার খুঁচিয়েছে এর উপরে লেখার জন্য।বছরের অন্তে স্বদর্থক লেখার দিকে যাওয়ার বদলে বাধ্য করছে নৈরাশ্যের কথা বলতে।হ্যা, আমি আজকে বলতে এসেছি আরো এক দুর্ভাগা জুনায়েদ হাফিজের বিষয়ে। প্রায়শঃ অনেক স্বঘোষিত আলোকপ্রাপ্ত মানুষ তির্যক উক্তি করেন,আমি কেন ইসলামের মৌলবাদের উপরে বলে থাকি।কেন,পাকিস্তান কে লক্ষ্যে স্থির করি।তাদের জন্য একটাই কথা ,যেদিন দেখবো একই পাশবিকতা অন্য ধর্মের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে সেইদিন রেয়াৎ করবো না এক ফোঁটা।

সেইদিন কলম ধরবো,যেদিন আপনাদের দেখবো ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে সরব হতে সেই দিন আমাকে পাবেন পাল্লার দুই দিক সমান করার ব্যালেন্স করার কাজে।তার আগে নিজের ভাবমূর্তি নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র ভাবিত না।ক্যান্সারের চিকিৎসা আমার কাছে প্রথম লড়াইয়ের লক্ষ্য, চর্মরোগ বা টিবি রোগের মতো ব্যাধি না।
সম্প্রতি পাকিস্তানের মুলতানের একটি জেলা এবং সেশন কোর্ট জুনায়েদ হাফিজ কে ধর্মানুভূতি তে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে।হ্যা,সোজা কথায় ব্ল্যাসফেমি বলে একটি মধ্যযুগীয় আইনের মাধ্যমে এই রায় দেওয়া হয়েছে।এই দিকের অনেক আলোকপ্রাপ্ত বলেই থাকে,এতে আমাদের কি? আমাদের অনেক কিছু।এই আমাদের কি গোছের কথার কারণে আজ মেরুকরণ হয়েছে।উটপাখির মতো মুখ বালিতে গুঁজে ‘সর্বে সুখিনা ভবন্তু’ করে নিজেদের এবং অবশিষ্ট কিছু ক্ষয়িষ্ণু ধর্মহীন বা প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ লোকের এই দশা করেছেন আপনারা।আজকে তাই এই বোতলের ভুত বাইরে এসে তান্ডব করছে।আপনাদের কাছে যদি নিরপেক্ষতা সত্যিই থাকতো তবে গুদামে আগুন লাগলে আলু পোড়া খাওয়ার প্রবণতা দেখতাম না। যাই হোক,মূল বিষয়ে ফিরে যাই।

এই দুর্ভাগা মানুষটি নির্যাতন আর গ্রেফতারের আগে মুলতানের বাহাউদ্দিন জাকারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অস্থায়ী প্রভাষক ছিলেন।এই মানুষটিকে কিন্তু আজকে থেকে নির্যাতিত হতে হচ্ছে না।সেই ২০১৩র মার্চ মাসে গ্রেফতার করা হয় আর এই শুনানি শুরু হয় ২০১৪ থেকে।অর্থাৎ এই মানুষটি প্রায় ছয় বছরের মতো জেলে বন্দি।তাকে কি জন্য গ্রেফতার করা হয়? এই মানুষটি নাকি ফেসবুকে কিছু ধর্মের অবমানকর কথা লিখেছিলেন।এই বিচারের বিচারক কাশিফ কায়ুম তাকে মৃত্যুদন্ড এবং পাকিস্তানি অর্থে পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছে পাকিস্তানি আইনের ধারা ২৯৫ সি অনুসারে অনাদায়ে আরো ছয় মাস সশ্রম কারাদন্ড ও ধার্য করেছে এই বিচারক। এ ছাড়াও একই আইনের ২৯৫-বি এবং এ ধারায় যাবতজীবন সশ্রম কারাদন্ড এবং এক লক্ষ টাকার অর্থদন্ড ও ধার্য করেছে।এই ধারা ইত্যাদি বলার কারন? কারন একটাই,আপনাদের বোঝানো যে আইন গুলো কি ভাবে করা হয়েছে যাতে মুক্তচিন্তার কোনো অবকাশ যেন না থাকে।অর্থাৎ ওই যে অনেক আলোকপ্রাপ্ত লোকের লাহোর সাহিত্য চর্চা বা ওই দিকের আলোকপ্রাপ্ত মানুষের জন্য আহা উহু শোনেন তাদের ওই দিকে কোনো মত প্রকাশের অধিকার কি আছে তা একটু ভাবুন।

ও,বলতে ভুলে গিয়েছি,এই রায়ের মধ্যে এটি ও বলা হয়েছে যে সব গুলো রায় এক সাথে বলবৎ হবে। পরিষ্কার বলা হচ্ছে, আইনের হিসাবে এই মানুষটির কোনো শাস্তির কম বেশি করার অধিকার নেই।ইসলাম তাকে সেই অধিকার দেয় না।হ্যা, ঠিক শুনেছেন,ইসলাম কে উদ্ধৃতি করে এই কথা বলেছে।কারোর সন্দেহ হলে বলবেন,উপযুক্ত প্রমান মানে তথ্যসূত্র দিয়ে দেবো যদিও তা নিচে দিয়েছি তবে অনেকেই আবার 'তেমন ভালো করে দেখেন না ' তাই অধিকন্তু ন দোষায়’।
এই দুর্ভাগা মানুষটির হয়ে যে উকিল প্রথম মামলা লড়তে গিয়েছিলেন সেই রাশিদ রহমান কে তার অফিসে ঢুকে মে মাসের ২০১৪ তে গুলি করে খুন করা হয়।একই সাথে গুরুতর আহত হয় তার দুই সহকারী আইনজীবী কর্মচারী। এই রাশিদকে পাচটি গুলি করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে কিছু শান্তির সেনা।যার জন্আ তার এই লড়াই সেই মানুষটিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মুলতানের জেলের দু নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে।এই মামলার পরিচালনা করার সময়ে অন্ততঃ সাতজন বিচারকের বদলি হয়েছে।এই মামলার স্বাক্ষী হিসেবে ১৫ জন স্বাক্ষীর বয়ান নথিভুক্ত করা হয়েছে এবং এই বিচার নিরাপত্তার কারণে স্থানান্তর হয়েছে আজকের মুলতান কেন্দ্রীয় জেলের ভিতরেই! 

এই মানুষটি মানে জুনায়েদ উচ্চ শিক্ষিত এবং দ্বিপাক্ষিক ছাত্র বিনিময়ের ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিন বছর কাটিয়েছেন ।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার ব্যবহারের ল্যাপটপ থেকে ধর্ম বিরোধী লেখা বা তথ্য পাওয়া গিয়েছে।এই মানুষটির বাবা এবং মা পূর্বতন প্রধান বিচারক আসিফ সায়িদ খোসার কাছে আবেদন রেখেছিল তাদের সন্তানের শারীরিক আর মানসিক স্বাস্থহানির ভয়ের থেকে রক্ষা করতে তবে কিছুই হয় নি।দুর্ভাগা এই মানুষটি আজ প্রায় সাত বছর ধরে একটি কালকুঠুরিতে একা পড়ে আছেন এক পার্থিব নরকে।হাফিজের বাবা মা তাদের লিখিত বয়ানে দাবি করেছেন যে এই অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা এবং তাঁরা তাদের ছেলের জন্য উকিল ও পাচ্ছেন না এই অদ্ভুত দেশে।জুনায়েদ হাফিজের পূর্বতন প্রয়াত উকিল রাশিদ রহমানের হত্যার পরে অন্য উকিল এই মামলার জন্য তার হয়ে লড়তে ভয় পাচ্ছেন আর প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো এই মানুষটির হত্যাকারী কেউই কিন্তু ধরা পড়ে নি।ফলে একটা সার্বিক ভয়ের বাতাবরণ সফল ভাবেই ছড়িয়ে দেওয়া গিয়েছে।প্রশ্ন উঠেছে, কোন বিচারকের সাহস হবে এই মামলায় নিরপেক্ষ কোনো রায় দিতে? তার নিজের প্রাণ ও তো মূল্যবান।আশা তবু ছেড়ে যায় না, তার বাবা মা আবেদন করেছেন উচ্চতর আদালতে।তবু সেই পুরোনো একটি সিনেমার দুর্ভাগা এক মানুষের চরিত্রের ছবি বিশ্বাসের কথা মনে আসে , নির্দোষ একটি লোক দীর্ঘ কাল জেলে পঁচে মুক্তি পেলেও ওই মুক্তির কি অর্থ থাকে ?
কে এই জুনায়েদ ? 

জুনায়েদ মূলতঃ ছিলেন চিকিৎসক হতে যাওয়া এক জন ছাত্র যে কিং এডওয়ার্ড মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের পরে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রির জন্য নিজের পড়ার বিভাগ পরিবর্তন করেন।এই সাহিত্যের বিভাগে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।বাহাউদ্দিন জাকারিয়া কলেজের বিগত ৩৮ বছরের সর্বোচ্চ নম্বরের রেকর্ড ভঙ্গ করে বিএ অনার্স এ ৩.৯৯ জিপিএ পেয়েছিলেন। তিনি কঠিন একটি পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ন পাঁচজন নির্বাচিত পাকিস্তানি ছাত্রের একজন ছিলেন যিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ এর জন্য নির্বাচিত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাস্টার্স পড়ার যোগ্যতা অর্জন করেন।এরপরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্যাকসন স্টেট্ ইউনিভার্সিটির অধীনে আমেরিকান সাহিত্য,ফটোগ্রাফি এবং নাটকের উপরে অধ্যয়ন শুরু করেন।

পড়ার শেষে দেশে ফিরে এই বাহাউদ্দিন জাকারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপনা শুরু করেন।সেই সময়ের(এখনো)এক রক্ষণশীল বাতাবরণের মধ্যেও ধর্ম নিরপেক্ষ আর স্বাধীন মতের মানসিকতার জুনায়েদ ছিলেন অতীব ব্যতিক্রমী।তিনি প্রায়শই মহিলা অধিকার রক্ষার কাজ করা মানুষদের এই কলেজে আমন্ত্রণ করতেন নানান সমাবেশ বা বিশেষ অনুষ্ঠানে তাদের বক্তব্য রাখার জন্য।এই সময়ে এই বিভাগের প্রধান ছিলেন এক মুক্তমনা মহিলা শিরিন যুবাইর।এমনি এক সময়ে ওই সময়ের এক অভিনেত্রী কোয়াইসরা শাহরাজ,যিনি একটি পুরস্কার জয়ী পাকিস্তানি দূরদর্শনের নাটক ' দিল হি তো হ্যায় ' তে অভিনয় করেছিলেন, তাকে এই কলেজে বক্তব্য দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রীতিমত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অনুমোদন নিয়েই তাঁকে ডাকা হয়।এই সমাবেশে কিছু ছাত্র অভিযোগ করে হাফিজ আর এই শাহরাজ ধর্মানুভুতিতে আঘাতের কাজ করেছে।পরবর্তীতে এই জুনায়েদ কে শাহরাজ এর একটি উপন্যাসের মূল বিষয়ের সমর্থনের জন্য দায়ী করা হয়।এই অভিযোগের পরে শাহরাজ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন আর জুনায়েদ জেলে যান।

আসুন ,একটু তলিয়ে দেখা যাক, বিচারের ঘটনাগুলো।একজন স্বাক্ষীর কথাই ধরুন,সে আদালতে এই উপরের নাটকের ভিত্তিতে ওই অভিযোগে অটল থাকে।জুনায়েদ এর উকিল মানে আজকের প্রয়াতঃ রেহমান তাঁকে বইটি মানে নাটকের ওই বইটি সামনে ধরিয়ে বলে যে কোন জায়গায় ওই ধর্ম অবমাননার কথা গুলো লেখা আছে দেখাতে।স্বাক্ষী স্বীকার করে সে ইংরেজি জানে না তাই ঠিক কি লেখা আছে সে জানে না! একই সাথে মুলতান পুলিশ এই মামলা বা অভিযোগের জন্য কোনো ছাপা অংশ বা ওই তথাকথিত অবমাননার কিছু সম্পৃক্ত ছাপা /প্রামাণ্য কোনো কিছুই হাজির করে নি।উল্টে যা হাজির করেছিল তা জাল এবং বানানো বলে বলা হয়। 

জুনায়েদ কে লাহোরে আটক করে মুলতানে নিয়ে আসা হয়।এরপরে তাকে শাহিওয়াল জেলে স্থানান্তর করা হয়।তার কম্পিউটার বাজেয়াপ্ত করা হয় আর তাকে জোর করে তার কম্পিউটার বা নিজের একাউন্টের গোপন চাবি মানে পাসওয়ার্ড ও নিয়ে নেয় মুলতান পুলিশ।এর জন্য কোনো কোর্ট মানে আইনি নির্দেশের তোয়াক্কা করে নি স্থানীয় পুলিশ।সোজা কথায় বেআইনি ভাবে মুলতান পুলিশ নিজেরাই সাব্যস্ত করেছে ধর্ম অবমাননা করার এই মূল বিষয় কে।
পাকিস্তানে ধর্মানুভূতির আইন 

এটি সুকুমার রায়ের ভাষায় 'শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে ' গোছের বিষয়। এতে আপনার বিরুদ্ধে নবী বা ইসলামের অপমান করেছেন এই ধরনের একটা অভিযোগ এনেই আপনার জীবন নরক করে দেওয়া যায়।গণ রোষ বা শান্তি নষ্টের কারন হিসেবে আপনি প্রথমেই চোদ্দ শিকের ভিতরে যাবেন।কপাল খারাপ থাকলে আপনি প্রকাশ্যেই প্রহারে খুন হবেন যেমন হয়েছে দুর্ভাগা মশাল খান।একটু কম কপাল খারাপ হলে এই জুনায়েদের হালে যাবেন আর যদি কপাল ভালো হয়? তবে অনেক বছর জেল যাত্রার পরে আসিয়া বিবির মতো দেশ ত্যাগ করতে পারবেন।
এখনো মনে পড়ে ২০১৭ তে , আব্দুল ওয়ালী খান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই মশাল খানের মৃত্যুর ঘটনা।ইয়ে,ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আবার সীমান্ত গান্ধীর নামেই করা।সুশীল বলুন আমিন!ও,এই প্রসঙ্গে আবার কেউ কেউ বলবেন, হ্যা , 

নিন্দনীয় তবে ইয়ে মানে ওটা ঠিক আমাদের দেশের না।তাদের যদি বলেন কোনো বঙ্গসন্তানের ক্ষেত্রে মানে যদি আজকে বিদেশ তবে আদতে বাঙালি কোনো মানুষের ক্ষেত্রে কি বক্তব্য? বলবে,আরে এ আমাদের দেশের তো না!কি মজার না? অভিজিৎ থেকে রাজীব হায়দর বা নিলয় হয়ে যায় বিদেশী। অথচ এই লোকগুলো আবার অতীব আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে সময়ে সময়ে।তাদের সব ঠিক! যাই হোক আবার বেলাইনে যাচ্ছি।বিষয়ে আসি।
এই বায়বীয় দেশটিতে এক প্রয়াত শয়তান জিয়া উল হকের সময়ের এই কালা কানুনের প্রবর্তনের পরে মানে ১৯৮৭ থেকে আজ পর্যন্ত অন্তত ১৫০০ মানুষ সরকারি হিসাবে নির্যাতিত হয়েছে এবং হচ্ছে এই ধর্ম অবমাননা মানে ব্ল্যাসফেমি আইনের কারণে। সরকারি ভাবে কাউকে মেরে না ফেললেও উন্মুক্ত নির্বোধ অশিক্ষিত জনতার হাতে কতল হয়েছে শত শত। আর হ্যা , জুনায়েদ এর উপরেও একাধিক বার খুন করার জন্য অন্য কয়েদি চেষ্টা করেছে কিন্তু।তথ্যসূত্র ? একটা দিয়ে দিলাম এইখানে , বাকি গুলো নিচে আলাদা করে দিয়েছি। মিলিয়ে নিন https://www.dawn.com/news/1524075
এক প্রৌঢ়র বেদনার কথা শুনুন 

মধ্য ষাটের জুনায়েদ হাফিজের বাবা ,ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষটি কে নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে ২০০ কিলোমিটার গাড়িতে যেতে হয় ছেলের মামলার জন্য রাজানপুর মানে তার নিবাস থেকে এই মুলতান আদালতে।তিনি এই কাজ করে চলেছেন এই আশায় যে একদিন, হ্যা একদিন হয়তো তার ছেলে বিচার পাবে।বাহাউদ্দিন জাকারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিভা ,মুক্ত চিন্তক এই জুনায়েদ হাফিজ যে তার বড় সন্তান।দৈনন্দিন জেল রক্ষী বা অন্য কর্মচারীদের হাতে অপমানিত বা দুর্ব্যবহারের শিকার এই মানুষটি লড়ে যাচ্ছেন তার ছেলের মুক্তির জন্য।তার কথা অনুযায়ী তিনি তার ছেলের থেকে জানতে পেরেছেন যে আইনি অনুমতি থাকলেও তাকে তার উকিলের সাথে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয় না।

নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের এই একান্ত স্বাক্ষাৎকারের কোনো অবকাশ দেওয়া হয় না।মামলার শুরুর সময়ে তাদের প্রথম উকিল যার নাম মুদাসসির, তাকে লাঞ্চিত করে শ দুয়েক উকিল।এই পর্যায়ে সে সরে গেলে পরিত্রাতা হয়ে আসেন সেই রাশিদ রহমান।এই মানুষটির পরিনাম তো উপরেই বললাম।লোকটি কে সরিয়ে দেওয়ার কারণ সহজবোধ্য, যা পড়ে দেখলাম তাতে এই বুঝেছি , লোকটি দক্ষতার সাথে জুনায়েদের পক্ষে অনেক প্রমান যোগাড় করে ফেলেছিল।অদম্য সাহসী এই রাশিদ আগেও এক পাকিস্তানি সংসদ শেরি রহমানের উপরে একই ধরণের ধর্মানুভূতির মামলায় লড়ার কারণে নিগৃহীত হয়েছিল তবু দমে যায় নি।হাস্যকর এই অদ্ভুত দেশে এই রাশিদ কে প্রকাশ্য আদালতে তার বিপক্ষের উকিল ভরা আদালত আর সহকর্মী অসংখ্য উকিলের সামনে হুমকি দিয়েছিল যে এর পরের শুনানিতে সে আর আসার ক্ষমতায় থাকবে না যদি না সে এই মামলায় জুনায়েদের পক্ষ ত্যাগ করে।তথ্যসূত্র:https://www.dawn.com/news/1258426

এই হুমকির পরেও সরকারি নানান মহলে অভিযোগ করলেও রশিদের নিরাপত্তার উপরে কোনো ব্যবস্থা বা এই হুমকির জন্য কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা কোনো পক্ষই নেয় নি কিন্তু।অতঃপর মে মাসের সাত তারিখে রাশিদ কে তার অফিসে ঢুকে পরপর পাচটি গুলি করে খুন করার পরে হাফিজের মুক্তির আশা শেষ হয়ে যায় তার এবং তার পরিবারের সবার কাছে।এরপরেও অসমসাহসী এক উকিল লাহোর থেকে মুলতানে গিয়ে তার হয়ে মামলা লড়ছেন নিজের প্রাণের ঝুঁকি সত্বেও।জুনায়েদ এবং এই উকিল অর্থ আর সময় ব্যয় করে নিত্য দুশো কিমি পথ পেরিয়ে যায় এই মামলা বা তার সাথে দেখা করতে।জুনায়েদের জন্য তার বাবা পৌঁছে দেয় তার নানান বই যা তার একমাত্র সঙ্গী ওই নির্জন জেলের কক্ষে।এই পরবর্তী উকিল তার নিজের নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নিতে বলার পরে বিচারক কর্নপাত করে নি।আশা করি কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন দেশটির অবস্থা কি।
দুর্ভাগা এই জুনায়েদ চেয়েছিলেন সোজা পথে থাকতে।তার সাথে বিদেশে যাওয়ার আগে এই বাহাউদ্দিন জাকারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে করা চুক্তি তিনি ভাঙতে চান নি তাই দেশে ফিরে এসেছিলেন।তিনি চেয়েছিলেন তার এমফিল শেষ হোক নিজের দেশেই।এই লোকটি বোঝে নি যে তার পরিণতি এই হতে পারে। 

এই বিষয়ে এক আইনি বিশেষজ্ঞ রিমা ওমর বলেন যে প্রামাণ্য কোনো বস্তু এখনো পেশ করা হয় নি তবে ওই যে ধর্মানুভূতির আইনের ২৯৫-সি এমন একটি প্যাচ যাতে অভুযুক্তের জন্য মৃত্যু দন্ডই হলো ফরমান।জুনায়েদের বাবার ভাষ্যে দেখতে পারি এই মানুষটির মা এই গ্রেফতারের পরে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আর যোগ দেন নি আর বাড়ির বাইরেও যান নি স্রেফ নিজের সন্তান কে জেলে দেখতে যাওয়া ছাড়া। রাত কাটে নির্ঘুম ভাবে এক সার্বিক যন্ত্রণার মধ্যে।

এই আজব দেশে ২০১৩ তে এই জুনায়েদের উপরে মামলা হলেও এই ২০১৯ এর শেষে এসে আবেদন জমা হয়েছে ওই প্রামান্য বস্তু মানে জুনায়েদের কম্পিউটার বা ফোন যা বাজেয়াপ্ত হয়েছে তার উপরে নিরপেক্ষ ময়নাতদন্ত মানে ফরেনসিক বিভাগের কাজ করার।এতদিন স্রেফ দিনের পর দিন ঘুরিয়ে গিয়েছে বিদ্যুৎ নেই বা সময়ে জমা হয় নি ইত্যাদি অথবা নিরাপত্তার অজুহাতে।কোনো বিশ্লেষণ ও হয় নি।আশা করি এর বেশি বলতে হবে না।তথ্যসূত্র? হ্যা তাও দিচ্ছি, এই নিন , এই সূত্র ধরে একটু নিজেই দেখে নিন : https://www.dawn.com/news/1504700/prosecution-seeks-forensic-audit-of-laptop-of-blasphemy-accused-junaid-hafeez

মুলতানের নির্ভিক সন্তান রাশিদ রেহমান একা লড়েছিলেন বন্ধক শ্রমিকদের মুক্তির আর ভূমি সংস্কারের জন্য আইনি লড়াই।তার কাছে কোনো বিচারের প্রত্যাশী ফিরে যায় নি অর্থের অভাবে।বিনাপয়সায় মামলা বা অধিকারের জন্য লড়াই করার এক একক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান হয়ে যাওয়া লোকটি তার বৃত্তে লড়াই করেছেন অসম এক শক্তির বিরুদ্ধে। আফসোস!এই লোকগুলো এই দিকের আলোকিত মানুষদের কোনো বিবৃতির বা আলোচনার বিষয় হয় না। কেন? এই 'কেন ' র উত্তর নেই তাই আজ নিধার্মিক বা ধর্মহীন মানুষদের এই দুর্দশা।

আজ হাফিজ কেন জেলে বা মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত? আসুন মূল জায়গা সমন্ধে একটু জানি।দুটো ফেসবুক গ্রুপ বা ফোরাম এর অন্যতম প্রধান হিসাবে তার উপরে এই অভিযোগ।এই দুটোর নাম ১.তথাকথিত পাকিস্থানি লিবারেল বা So-Called Liberals of Pakistan এবং মোল্লা মুনাফেক।যদিও এই গুলোতে কোনো বিরুদ্ধ মত এলেও তার শুরু কার হাতে তার প্রমানের কোনো জায়গা নেই তবু নির্দিস্ট করে এই অভিযোগ করা হয়েছে জুনায়েদ হাফিজের উপরে।এই প্রসঙ্গে দেখতে পাচ্ছি, এই গ্রুপ বা ওই লেখা গুলো রয়েই গিয়েছে বা একই ধরণের লেখা চালু আছে জুনায়েদ হাফিজ জেলে থাকার পরেও।সুতরাং এর সূত্রপাত বা অবস্থানের উপরে হাফিজের কোনো হাত থাকার কোনো প্রমান কিন্তু থাকে না।

কেন জুনায়েদ হাফিজ আলোচ্য? এর কারন এই মানুষটি আর পাঁচজন এই ব্ল্যাসফেমি মানে ধর্মানুভূতির মামলার শিকার বলে না। মানুষটি একজন পন্ডিত এবং একজন মুক্তমনা আর পন্ডিত ব্যক্তি বলে।এই মানুষরা আলো নিয়ে আসে সমাজে তাদের চিন্তার আর মতের প্রচার করে।মেডিক্যাল বোর্ড এর স্বর্ণ পদক প্রাপ্ত মানুষটি নিজের খুশিতে বিষয় পরিবর্তন করেছিলেন।এর আগে ওই দেশের ডেরা গাজী খানের মাধ্যমিক বোর্ডে প্রথম স্থান প্রাপ্ত করেছিলেন।নারীবাদী এবং পুরুষ শাসিত সমাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার এই মানুষটি একজন আজন্ম শিক্ষক।প্রাসঙ্গিক নানান লেখায় দেখছি, মানুষটি তার এই স্বাধীনচেতা মনের জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয় বা নিজের বিভাগের অনেক সহকর্মীর কাছে বিরাগভাজন হয়েছিলেন।দফতরের প্রধানের সমর্থন থাকার কারনে সরাসরি কিছু না বলতে পারলেও পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আর দুর্গতির মূল কারন ওটাই বলছে বেশ কিছু প্রতিবেদন।

ব্যক্তিগত ভাবে একটু অন্য আঙ্গিকে কাজ করতেন এই জুনায়েদ।তিনি পাকিস্তানের এই পুরুষতন্ত্র বা তার সূচনা এমন কি স্থানীয় চলচ্চিত্রতে এর প্রভাব এবং স্ত্রী স্বাধীনতার উপরে চার খানা গবেষণা মূলক লেখা লিখেছিলেন।এ ছাড়া আঞ্চলিক লেখা গুলোকে ইংরেজিতে অনুবাদ ও করা শুরু করেছিলেন।এছাড়া ব্যক্তি জুনায়েদ কবি ও ছিলেন।সব মিলিয়ে মানুষটি একটি অন্য মুখ, ওই অঞ্চলের মানবাধিকারের উপরে কাজ করা আফিয়া জিয়ার ভাষায় এই মানুষটি অনেক ব্যক্তি স্বার্থে ঘা দিয়ে ফেলেছিলেন।ওই সময়ে ইংরেজি বিভাগে নিয়োগের সময়ে তার স্বচ্ছতা অনেকের অসুবিধের কারণ হয়েছিল বলে তার মতামত।এর ফলেই লোকটিকে এই আইনের প্যাঁচে এই অবস্থায় ফেলা হয়েছে। 

তার কাছের মানুষের ভাষ্যতে দেখছি,এই মানুষটি কিন্তু নাস্তিক বা নিধার্মিক ছিলেন না।খালি সোজা পথে চলতেন এইটাই।কথা হচ্ছে, যদি নাও হতেন তবে কি এই আইন তার উপরে এই শাস্তি ন্যায্য হতো কি? আলোকিত লোকেরা কি বলেন?

পুনশ্চ: আমাদের দেশের বেশ কিছু মুক্তমনা এবং ধর্মের বিরুদ্ধে বলা মানুষ খুন হয়েছেন।আগামীতে হয়তো আরো এই ধরনের কুকীর্তি এইদিকেও দেখতে পারি।এর বিরুদ্ধে এক জোট হওয়ার জন্য যা দরকার তা হলো আগে আয়নায় নিজেদের মুখ দেখা।অশেষ রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিফলতার কথা বলতে গিয়ে একটা ছোট্ট গল্প বলেন তার একটি প্রবন্ধে,তাতে এক আন্দোলনের হিন্দু সহকর্মী তার মুসলমান সহকর্মীকে বলছেন “ভাই একটু দাওয়া থেকে নেমে দাড়া,আমি জল খেয়ে নিই” আজকে এই অবস্থা একই আছে,আপনি যতদিন গোমাংসে আছেন অথচ বরাহ এড়িয়ে যাবেন আবার ধর্মের নিন্দা কে এক পক্ষে রেখে আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার ভন্ডামি করবেন ততদিন ওই আরো এক বেয়াড়া লোকের সুরে বেজেই যাবে “এই জাত জুয়াড়ির ভাগ্যে আছে আরো অশেষ দুঃখ সওয়া”
ধন্যবাদ!

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted