বেদ যাহা, সর্বপ্রাচীন জীবন বিধান বর্তমান।

বেদের চারটি ভাগ ; প্রতিটির আবার চারটি করে অংশ - সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতা অংশে বেদের মন্ত্র সমূহ রয়েছে। ব্রাহ্মণ অংশে সংহিতায় উক্ত যাগযজ্ঞের বিবরণ ও ব‍্যখ‍্যা রয়েছে। আরণ্যকে আছে যজ্ঞ সম্পর্কে রূপক কল্পনা ও প্রতীক উপমার আদেশ। আর উপনিষদে আছে ব্রহ্মাজ্ঞানের কথা।

দর্শন বলতে আমরা যা বুঝি, তা বৈদিক যুগে দেখা যায়নি। সর্বপ্রাচীন সাহিত্য হিসেবে ঋকবেদের বিভিন্ন মন্ত্রে একাধিক দেবতার স্তুতি করা হয়েছে। এই দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও বরুণ প্রমুখ প্রধান।যেমন, অজস্র ঋকের মতোই ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের: – প্রজাপতি সূক্তের (ঋগ্বেদ-১০/১২১) ঋকগুলিতে বলা হয়েছে :
হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ততাগ্রে ভূবস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ।
স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাং কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।।
য আত্মদা বলদা যস্য বিশ্ব উপাসতে প্রশিষং যস্য দেবাঃ।
যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।।

অর্থাৎ,সর্বপ্রথমে কেবল হিরণ্যগর্ভই বিদ্যমান ছিলেন। তিনি জাত মাত্রই সর্বভূতের অদ্বিতীয় অধীশ্বর হলেন। তিনি এ পৃথিবী ও আকাশকে স্বস্থানেস্থাপিত করলেন। কোন্ দেবতাকে হব্যদ্বারা পূজা করবো ? যিনি জীবাত্মা দিয়েছেন, বল দিয়েছেন, যাঁর আজ্ঞা সকল দেবতারা মান্য করে,যাঁর ছায়া অমৃতস্বরূপ, মৃত্যু যাঁর বশ্যতাপন্ন কোন্ দেবতাকে হব্যদ্বারা পূজা করবো ?

ঋগ্বেদের এই দশম মণ্ডলের আত্মা সূক্তেরও (১০/১২৫) :

অহং সুবে পিতরমস্য মূর্ধন্মম যোনিরপস্বন্তঃ সমুদ্রে।
ততো বি তিষ্ঠে ভুবনানু বিশ্বোতামূং দ্যাং বর্ষ্মণোপ স্পৃশামি।।
অহমেব বাত ইব প্র বাম্যারভমাণা ভুবনানি বিশ্বা।
পরো দিবা পর এনা পৃথিব্যৈতাবতী মহিনা সং বভূব’।।

অর্থাৎ,আমি পিতা, আকাশকে প্রসব করেছি। সে আকাশ এ জগতের মস্তকস্বরূপ। সমুদ্রে জলের মধ্যে আমার স্থান। সে স্থান হতে সকল ভূবনে বিস্তারিত হই, আপনার উন্নত দেহদ্বারা এ দ্যুলোককে আমি স্পর্শ করি। আমিই সকল ভুবন নির্মাণ করতে করতে বায়ুর ন্যায় বহমান হই।আমার মহিমা এরূপ বৃহৎ হয়েছে যে দ্যুলোককেও অতিক্রম করেছে,পৃথিবীকেও অতিক্রম করেছে।

একেশ্বরবাদের সাথে সর্বেশ্বরবাদের ধারণার মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য হলো,- একেশ্বরবাদ একজন মাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাসী; কিন্তু তা ঠিক একবাদ নয়। তার পরিকল্পনায় ঈশ্বর ব্যক্তিত্ববিশিষ্ট এবং তিনি তাঁর সৃষ্ট বিশ্ব হতে পৃথক। তিনি সর্বশক্তিমান বটে; কিন্তু তিনি সৃষ্ট বিশ্বকে বাহির থেকে নির্মাণ করেন। সাধারণত তাঁকে বিশ্বের নিমিত্তকারণ এবং নিয়ন্তা বলে কল্পনা করা হয়। ফলে তার মধ্যে একটি দ্বৈতভাব এসে পড়ে। তার পরিকল্পনায় দুটি পৃথক শ্রেণির সত্তা নিয়ে বিশ্ব গঠিত- একদিকে ঈশ্বর এবং অন্যদিকে তাঁর সৃষ্টি।
সর্বেশ্বরবাদ বিশ্বকে ঈশ্বর হতে পৃথক করে না। তা বলে, বিশ্ব ও ঈশ্বর অভিন্ন। ঈশ্বরই বিশ্বের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থেকে তাকে সৃষ্টি করেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন। সুতরাং এখানে ঈশ্বর নৈর্ব্যক্তিক সত্তা হয়ে পড়েন। সর্বেশ্বরবাদই প্রকৃত একবাদের নিদর্শন।

সর্বেশ্বরবাদী প্রাথমিক চিন্তাই ঋগ্বেদের পুরুষ সূক্তে (১০/৯০) আরও স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে এমন এক সর্বব্যাপী বিরাট পুরুষের কল্পনা করা হয়েছে, যাঁর সহস্র মাথা এবং সহস্র চরণ। পৃথিবীকে ব্যাপ্ত করেও তিনি তাকে অতিক্রম করেছেন, এতো বিরাট তিনি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, তাঁর অঙ্গ বা বিভিন্ন অংশ হতে চন্দ্র, সূর্য, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, স্বর্গ, ভূমি, ইন্দ্র, দিক ও ভুবন সবই সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর দেহই খন্ডিত হয়ে বিশ্বের নানা বস্তু ও জীবে পরিণত হয়েছে। তিনিই বিশ্বরূপে রূপান্তরিত হয়েছেন। এই পুরুষসূক্তে বিশ্বজগতের নিয়ন্তা হিসেবে বিরাট-পুরুষের যে কল্পনা তার প্রতিফলন বিভিন্ন উপনিষদেই দেখা যায়। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের প্রসিদ্ধ এই পুরুষসূক্তটি (ঋগ্বেদ-১০/৯০)

সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ।
স ভূমিং বিশ্বতো বৃহাত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্ ।। ১।
পুরুষ এবেদং সর্বং যদ্ভূতং যচ্চ ভব্য।
উতামৃতত্বস্যেশানো যদন্নেনাতিরোহতি।। ২।
এতাবানস্য মহিমাতো জ্যায়াংশ্চ পূরুষঃ।
পাদোহস্য বিশ্বা ভূতানি ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি।। ৩।
ত্রিপাদূর্ধ্ব উদৈৎ পুরুষঃ পাদোহস্যেহাভবৎ পুনঃ।
ততো বিষ্বঙব্যক্রামৎ সাশনানশনে অভি।। ৪।
তস্মাদ্বিরাড়জায়ত বিরাজো অধি পূরুষঃ।
স জাতো অত্যরিচ্যত পশ্চাদ্ভূমিমথো পুরঃ।। ৫।
যৎ পুরুষেণ হবিষা দেবা যজ্ঞমতন্বত।
বসন্তো অস্যাসীদাজ্যং গ্রীষ্ম ইধ্মঃ শরদ্ধবিঃ।। ৬।
তং যজ্ঞং বর্হিষি প্রৌক্ষন্ পুরুষং জাতমগ্রতঃ।
তেন দেবা অযজন্ত সাধ্যা ঋষয়শ্চ যে।। ৭।
তস্মাদ্যজ্ঞাৎ সর্বহুতঃ সম্ভূতং পৃষদাজ্যম্ ।
পশুন্তাংশ্চক্রে বায়ব্যানারাণ্যান্ গ্রাম্যাশ্চ যে।। ৮।
তস্মাদ্যজ্ঞাৎ সর্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।
ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাদ্যজুস্তস্মাদজায়ত।। ৯।
তস্মাদশ্বা অজায়ন্ত যে কে চোভয়াদতঃ।
গাবো হ জজ্ঞিরে তস্মাত্তস্মাজ্জাতা অজাবয়ঃ।। ১০।
যৎপুরুষং ব্যদধুঃ কতিধা ব্যকল্পয়ন্ ।
মুখং কিমস্য কৌ বাহূ কা ঊরূ পাদা উচ্যেতে।। ১১।
ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ।
ঊরূ তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত।। ১২।
চন্দ্রমা মনসো জাতশ্চক্ষোঃ সূর্যো অজায়ত।
মুখাদিন্দ্রশ্চাগ্মিশ্চ প্রাণাদ্বায়ুরজায়ত।। ১৩।
নাভ্যা আসীদন্তরিক্ষং শীর্ষ্ণো দ্যৌঃ সমবর্তত।
পদ্ভ্যাং ভূমির্দিশঃ শ্রোত্রাত্তথা লোকা অকল্পয়ন্ ।। ১৪।
সপ্তাস্যাসন্ পরিধিয়স্ত্রিঃ সপ্ত সমিধঃ কৃতাঃ।
দেবা যদ্যজ্ঞং তন্বানা অবধ্নন্ পুরুষং পশুম্ ।। ১৫।
যজ্ঞেন যজ্ঞমযজন্ত দেবাস্তানি ধর্মাণি প্রথমান্যাসন্ ।
তে হ নাকং মহিমানঃ সচন্ত যত্র পূর্বে সাধ্যাঃ সন্তি দেবাঃ।। ১৬।
অর্থাৎ :। পুরুষের সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু ও সহস্র চরণ। তিনি পৃথিবীকে সর্বত্র ব্যাপ্ত করে দশ অঙ্গুলি পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে অবস্থিত থাকেন। ২। যা হয়েছে অথবা যা হবে সকলই সে পুরুষ। তিনি অমরত্বলাভে অধিকারী হন, কেননা তিনি অন্নদ্বারা অতিরোহণ করেন। ৩। তাঁর এরূপ মহিমা, তিনি কিন্তু এ অপেক্ষাও বৃহত্তর। বিশ্বজীবসমূহ তাঁর একপাদ মাত্র, আকাশে অমর অংশ তাঁর তিন পাদ। ৪। পুরুষ আপনার তিন পাদ (বা অংশ) নিয়ে উপরে উঠলেন। তাঁর চতুর্থ অংশ এ স্থানে রইলো। তিনি তদনন্তর ভোজনকারী ও ভোজনরহিত ( চেতন ও অবচেতন) সকল বস্তুতে ব্যাপ্ত হলেন। ৫। তিনি হতে বিরাট জন্মিলেন এবং বিরাট হতে সে পুরুষ জন্মিলেন। তিনি জন্মগ্রহণপূর্বক পশ্চাদ্ভাগে ও পুরোভাগে পৃথিবীকে অতিক্রম করলেন। ৬। যখন পুরুষকে হব্য রূপে গ্রহণ করে দেবতারা যজ্ঞ আরম্ভ করলেন, তখন বসন্ত ঘৃত হলো, গ্রীষ্ম কাষ্ঠ হলো, শরৎ হব্য হলো। ৭। যিনি সকলের অগ্রে জন্মেছিলেন, সে পুরুষকে যজ্ঞীয় পশুস্বরূপে সে বহ্নিতে পূজা দেওয়া হলো। দেবতারা ও সাধ্যবর্গ এবং ঋষিগণ তা দ্বারা যজ্ঞ করলেন। ৮। সে সর্ব হোমযুক্ত যজ্ঞ হতে দধি ও ঘৃত উৎপন্ন হলো। তিনি সে বায়ব্য পশু নির্মাণ করলেন, তারা বন্য এবং গ্রাম্য। ৯। সে সর্ব হোম-সম্বলিত যজ্ঞ হতে ঋক ও সামসমূহ উৎপন্ন হলো, ছন্দ সকল তথা হতে আবির্ভূত হলো, যজু তা হতে জন্ম গ্রহণ করলো। ১০। ঘোটকগণ এবং অন্যান্য দন্ত পঙক্তিদ্বয়ধারী পশুগণ জন্মিল। তা হতে গাভীগণ ও ছাগ ও মেষগণ জন্মিল। ১১। পুরুষকে খণ্ড খণ্ড করা হলো, কয় খণ্ড করা হয়েছিলো ? এর মুখ কী হলো, দু হস্ত, দু উরু, দু চরণ কী হলো ? ১২। এর মুখ ব্রাহ্মণ স্বরূপ, দু বাহু রাজন্য স্বরূপ, যা উরু ছিলো তা বৈশ্য সরূপ, দু চরণ শূদ্র সরূপ। ১৩। মন হতে চন্দ্র হলেন, চক্ষু হতে সূর্য, মুখ হতে ইন্দ্র ও অগ্নি, প্রাণ হতে বায়ু। ১৪। নাভি হতে আকাশ, মস্তক হতে স্বর্গ, দু চরণ হতে ভূমি, কর্ণ হতে দিক ও ভূবন সকল নির্মাণ করা হলো। ১৫। দেবতারা যজ্ঞ সম্পাদন কালে পুরুষস্বরূপ পশুকে যখন বন্ধন করলেন তখন সাতটি পরিধি অর্থাৎ বেদী নির্মাণ করা হলো এবং তিনসপ্ত সংখ্যক যজ্ঞকাষ্ঠ হলো। ১৬। দেবতারা যজ্ঞ দ্বারা যজ্ঞ করলেন, তাই সর্ব প্রথম ধর্মানুষ্ঠান। যে স্বর্গলোকে প্রধান প্রধান দেবতা ও সাধ্যেরা আছেন, মহিমান্বিত দেবতাবর্গ সে স্বর্গধাম প্রতিষ্ঠা করলেন।

এই পুরুষ সূক্তটির বিশেষ উল্লেখযোগ্যতা হলো, ঋগ্বেদের অন্য কোনো অংশে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চার জাতির উল্লেখ নেই। এই সূক্তটিকে অপেক্ষাকৃত আধুনিক বলে বিদ্বানেরা অভিমত ব্যক্ত করেন, কেননা ঋগ্বেদ রচনাকালে আর্যদের মধ্যে জাতি বিভাগ ছিলো না। এবং বিশ্বজগতের নিয়ন্তাকে বলিস্বরূপ অর্পণ করার যে অনুভব এটিও ঋগ্বেদের সময়ের নয়, এমনকি ঋগ্বেদে আর কোথাও তা পাওয়া যায় না। তাছাড়া ব্যাকরণবিদ পন্ডিতদের সুস্পষ্ট অভিমত হলো, এই পুরুষসূক্তের ভাষা বৈদিক ভাষা নয়, অপেক্ষাকৃত আধুনিক সংস্কৃত। তাই উপনিষদীয় চিন্তাজগত থেকে উদ্ভূত ধারণাই পরবর্তীকালে ঋগ্বেদে অর্বাচীন হিসেবে সংযোজিত হয়েছে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।

তবে ঋগ্বেদের প্রাচীন পর্যায়ে বৈদিক ঋষিরা জড় প্রকৃতির উপাসক হলেও বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার অন্তরালে ‘ঋত’ নামে এক সর্বব্যাপী নিয়ম ও শৃঙ্খলার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। বেদে ‘ঋত’ একটি সর্বব্যাপী নৈতিক নিয়ম যা জীব জগতকে পরিচালিত করে। এই ‘ঋত’ সম্পর্কিত ধারণাটি ঋগ্বেদের প্রথমকালের রচনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে দৃষ্টিগোচর হলেও পরবর্তীকালের অর্বাচীন অংশে তা পাওয়া যায় না।

(ক্রমশ)

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted