প্রাচীন সনাতনী কোনো শাস্ত্রে তাই “হিন্দু” বলে কোনো শব্দ নেই।

“হিন্দুত্ব”------- মৃনালানন্দ হিন্দু 

 (এক)

হিন্দু, হিন্দুত্ব কথাটা প্রাচীন। বর্তমানে সকলের মুখে মুখে। হিন্দু ,এই শব্দটাই আসলে হাল আমলের। 

সনাতনী, বৈদিক সভ্যতার শুরু প্রায় দশ হাজার বছর আগে। শুরু হয়েছে এমন একটা সময়ে যখন এই পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বা অঞ্চলে, কোনো সুচারু, সুসাংষ্কৃতিক, পরিশীলিত , মানবিক কোনো সভ্যতা গড়ে ঊঠেছিলো কি না তা জানা নেই। বৈদিক সভ্যতা তাই শুধু মানুষের কথা বলে। প্রাচীন সনাতনী কোনো শাস্ত্রে তাই “হিন্দু” বলে কোনো শব্দ নেই। 

যতোটা প্রমান পাওয়া গেছে, তাতে পন্ডিতেরা এই প্রতিপাদ্যে এসে পৌছেছেন যে,  দশ হাজার বছর আগে, সিন্ধু এবং সরস্বতী নদীর অববাহিকা অঞ্চলে ধীরে ধীরে এক “সাংষ্কৃতিক” জীবন শৈলীর উদ্ভব হতে থাকে। এক দার্শনিক ভাবনা চিন্তা , মনন , চিন্তন শুরু হয়। গুহাবাসী মানুষ তখন মাটিতে ফসল ফলাতে শুরু করেছে, একত্রে বসবাস করতে শুরু করেছে। শহর গ্রাম তৈরী করতে শুরু করেছে।

যারা এদের মধ্যে জ্ঞান তপষ্বী ছিলেন ,তারা কোলাহল মুক্ত জায়গায় নিজেদের আস্তানা তৈরী করে, উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে ধ্যান নেত্রে খুজতে শুরু করলেন সৃষ্টি রহস্য , আর খুজে ফিরলেন এর সৃষ্টি কর্তাকে। তাদের সাধনা লন্ধ জ্ঞান বিতরন করলেন তাদের সঙ্গে থাকা শিষ্য দের। মাঝে মধ্যে এই তপষ্বীরা এবং তাদের শিষ্য রা বেরিয়ে পড়তেন গ্রাম গ্রামান্তরে, করতেন প্রব্রজ্যা (ভিক্ষা অন্নে খুন্নিবৃত্তি) । গৃহবাসীদের শিক্ষা দিতেন। বোঝাতেন কি ভাবে প্রাত্যহিক জীবন যাত্রা নির্বাহ করতে হয়, মানুষে মানুষে কি সম্পর্ক, মানুষ এবং অন্য প্রানী এমনকি সৃষ্টির প্রতিটি উদ্ভিদ বা বস্তুর সংগে কি সম্পর্ক হবে, সৃষ্টি কর্তার স্বরুপ এবং তার সংগে কি সম্পর্ক তৈরী হবে। 

ক্রমে, বিশেষ করে এক প্রাকৃতিক দুর্য্যোগে (ভয়ংকর ভুমিকম্পে) সরস্বতী নদীর উৎস বন্ধ হয়ে যায়। যমুনা নদী, যা ছিলো সরস্বতী নদীর একটি শাখা, সেটি সরস্বতী থেকে আলাদা হয়ে যায়, এবং সরস্বতী শুকিয়ে গিয়ে অন্তঃ সলিলা হয়ে যান। কিন্তু বালির নীচে আজো তার জলধারা বয়ে চলেছে কুল কুল করে। 

এই প্রাকৃতিক প্রলয়ে সিন্ধু- সরস্বতী সভ্যতা পুর্ব দিকে গাঙ্গেয়- যমুনা অববাহিকায় ছড়িয়ে পড়ে। জ্ঞান তপষ্বীরা তাদের জ্ঞান বিতরনে ছড়িয়ে পড়েন ভারতের দক্ষিনে, পুর্বে, উত্তরে, উত্তর পশ্চিমে। আজকের আফগানিস্তান (হরি নদী, কাবুল নদী, আমু দরিয়া নদী র অববাহিকা), ইরান, ইরাক, ককেশাস পর্বতের আশপাশ অঞ্চল (ভোলগা নদীর অববাহিকা), পামীরের উত্তরে উপজাতি অধ্যুষিত মধ্য এশিয়ার নানা অঞ্চলে বৈদিক সভ্যতার বিস্তার ঘটে। আজকের ‘ইন্দোচায়না= মায়ানমার+ থাইল্যান্ড (শ্যাম দেশ), লাওস, কম্বোডিয়া (কম্বোজ) এবং ভিয়েতনাম ( চম্পা রাজ্য) বৈদিক ভাবধারার চারন ভুমি হয়। 

এই বিস্তীর্ন অঞ্চলে সনাতনী বৈদিক দর্শনের মুল কথা প্রচার করতে তাদের সঙ্গে ছিলো গৈরিক বসন, গৈরাক্ষ মালা আর হাতে কমন্ডলু। কোনো তরোয়াল দিয়ে মাথা কেটার কোনো প্রয়োজন পড়েনি। 
হিন্দু নামটা আসে ইরান ভিত্তিক যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো তাদের কাছে থেকে। পারসী ভাষায় কোনো ‘স’ শব্দ নেই আছে ‘হ’। তাই সিন্ধুর পাশে বা তার পুবে যারা বাস করে তাদের ওরা “সিন্ধু সভ্যতা’ না বলে বলতো “হিন্দু সভ্যতা”। ইরান বা পারস্য তখনো বৈদিক সভ্যতার অঙ্গ ছিলো। 

কিন্তু আরবের মরুভুমি থেকে উদ্ভুত এক “শান্তির ধর্ম” ছুটে এলো আরবী ঘোড়ার সওয়ার হয়ে, হাতে উন্মুক্ত তরবারি। অতি অদ্ভুত তাদের চিন্তা ভাবনা। তারা যা বিশ্বাস করে, যে ভাবে চলে সেই ভাবে বিশ্বাস এবং চলা ফেরা না করলে তারা বললো “তুমি অবিশ্বাসী কাফের, তোমাকে পাঠাই জাহান্নামে”। 

 হলোও ঠিক তাই। আরব থেকে বেরিয়ে তারা একে একে সারা পারস্য সাম্রাজ্য, তারপরই আফগানিস্থান, উত্তরাপথ দিয়ে চলে গেলো মধ্য এশিয়ার নানা অঞ্চলে। সাধারন ‘শান্তিপ্রিয়’ বৈদিক মানুষের রক্তে মা ধরিত্রী করলেন রক্তস্নান। যারা বাঁচলো, তারা বেঁচে গেলো “শান্তির দুতের” গোলাম হয়ে। 

 ‘শান্তির দুতের’ এই গোলাম গুলোই এবার আঘাত হানলো একেবারে ‘বৈদিক সভ্যাতার সুতিকাগারে”। হরি নদী, কাবুল নদী, আমুদরিয়ার জল রক্তে লাল করে তারা এলো সিন্ধু, গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা, তুঙ্গভদ্রা, কাবেরী র পুন্য জল মানুষের রক্ত, বৈদিক পৌত্তলিক, কাফের দের রক্তে লাল করতে। সেই রক্তের হোলি খেলা চললো ৮০০ বছর ধরে। 

সুসভ্য, শান্তি প্রিয় হিন্দুরা, এই রকম “শান্তির ধর্মের’ সঙ্গে পরিচিত ছিলো না। তারা তাদের সব প্রার্থনার শেষে উচ্চারন করতো “ওউম শান্তি , শান্তি শান্তি হি”। এবার শুনলো, অস্ত্রের ঝনঝনানি, দেখলো সকলের চোখের সামনে উন্মুক্ত স্থানে তাদের মা ,বোন, মেয়েদের নিয়ে কাড়া কাড়ি, তাই দেখে অট্টহাস্য, কুৎসিত সব ভাষা যা কোনো মানুষে পারে না। লুট করা মালের সঙ্গে মহিলারাও হলো ‘গনিমতের মাল’। তাদের নিয়ে ভাগাভাগি হলো। পাঁচ ভাগের এক ভাগ পাঠানো হলো সেই সুদুর বাগদাদ,ব্যাবিলন , ইস্তানবুলে, শান্তির ধর্মের মহানায়ক যেখানে বিলাসী প্রাসাদে বসে আরাম আয়েষ করেন। 

সম্পুর্ন বিপরীত মেরুতে অবস্থান কারী এক ‘বর্বরীয় জীবন যাত্রা’য় অভ্যস্থ হতে থাকলো সুসভ্য “আর্য্য” রা। সমাজ সংসার ধীরে ধীরে গেলো অস্তাচলে। যারা ‘শান্তির দুত’ দের দলে যোগ দিলো তারা পুরো পুরি ওই বিজাতীয় জীবন ধারা গ্রহন করে, সভ্যতা ভব্যতা বিহীন হয়ে গেলো। উপাসনাস্থলে পুর্বজদের গাল দেওয়া, ঘৃনা করা তাদের নিত্য কর্ম হয়ে দাড়ালো। 

যারা সেই “হিন্দু নামধারী’ হয়ে রইলো, তারা ‘জিজিয়া কর দিলো’, হিন্দু জীবন দর্শনের সব ভুলে এক জগা খিচুড়ি মানসিকতার মানুষ হয়ে দাড়ালো। এরা নিজেদের ‘হিন্দু’ বলে কিন্তু জানে না হিন্দু হতে গেলে কি করতে হয়, কি ভাবতে হয়, কি ভাবে চলতে হয়, কি ভাবে সময় কাটাতে হয়। 

মনে রাখবেন যারা খারাপ তারা খারাপই হয়, সেই খারাপ হবার একটা পদ্ধতি আছে, সোজা নীচে নেমে যাওয়া, যা অতি সহজ। 

 কিন্তু যারা ‘ছিলো ভালো কিন্তু হলো খারাপ’ তারা বিমুঢ়—কি তারা করে, কি ভাবে, কি ভাবে চলে তার মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। মুঢ়= ভ্রান্ত, বিমুঢ়= বিশেষ রুপে ভ্রান্ত । আর ভ্রান্ত কথার মানে হলো, যাদের চিন্তা ভাবনার কোনো নির্দিষ্ট ধারা নেই। আর এদের পথ দেখানো আরো  কঠিন। অনেকে চেষ্টা করে বিফল হয়েছেন। তবু হাল ছাড়তে নেই।।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted