জীবনের প্রকৃত অর্থ কি?
নানা লোকের কাছে নানা রকমের উত্তর তৈরি আছে। কেউ বলে পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি পাওয়া, কেউ বলে নির্বাণ লাভ করা, কেউ বলে এবাদত করার জন্য, কেউ বলে নরকযন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে স্বর্গ সুখ ভোগ করাই হচ্ছে জীবনের প্রকৃত অর্থ। এমন হরেক রকমের ভয়ার্ত অথচ লোভনীয় জবাব পাওয়ার পরেও কোন উত্তরই অবিসংবাদিত সত্য বলে আমার মনে হয়নি। তাই বিশিষ্ট একজন দার্শনিকের বয়ানে “জীবনের প্রকৃত অর্থ কি?” তা সার্বিকভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করব।
জীবজন্তুর মত আহার নিদ্রা ভয় মৈথুনের মধ্যে দিয়ে তুচ্ছ ভাবে বেঁচে থাকা, অস্তিত্ব রক্ষা করাটা নিশ্চয় মানুষের কাম্য নয়। উদ্ভিদ এবং প্রাণীও বেঁচে থাকে, কিন্তু তাদেরকে জীবনের প্রকৃত অর্থ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। অস্তিত্ব রক্ষা আর বেঁচে থাকাও ঠিক এক নয়। উদ্ভিদ এবং প্রাণীও বেঁচে থাকে, তাদের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু অস্তিত্ব মানে কি সেটি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না তাদের। মানুষই হলো একমাত্র প্রাণী যে তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন। ফরাসি দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে(১৯০৫-১৯৮০) বলছেন একটি বস্তুগত জিনিস স্রেফ “স্বীয় প্রকৃতিগত” অন্যদিকে মানুষ নিজের জন্য। মানব সত্তা আর বস্তু সত্তা তাই এক নয়। মানুষের অস্তিত্ব তার অন্য আর সব কিছুর চেয়ে অগ্রাধিকার পাবে। আমি যে অস্তিত্বশীল এই বিষয়টি আমি যা তার আগে গুরুত্ব পাবে।
“অস্তিত্বের অধিকার, নির্যাসের আগে”। নির্যাস বলতে আমরা বুঝি সেই সব জিনিস যা দিয়ে কোনোকিছু তৈরি- কোনোকিছুর প্রকৃতি বা সত্তা। কিন্তু সার্ত্রের মতে মানুষের এ- ধরনের কোনো সহজাত প্রকৃতি বা সত্তা নেই। মানুষকে তাই অবশ্যই নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে। তাকে অবশ্যই তার নিজস্ব প্রকৃতি বা নির্যাস তৈরি করে নিতে হবে, কারণ সেটি আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে নেই।
দর্শনের গোটা ইতিহাস জুড়ে দার্শনিকেরা আবিষ্কার করতে চেয়েছেন মানুষ কী বা মানব প্রকৃতি কি? কিন্তু সার্ত্রে বিশ্বাস করতেন যে মানুষের এ ধরনের কোনো শাশ্বত প্রকৃতি নেই যার ওপর ভরসা করা যেতে পারে। কাজেই সাধারণত ভাবে জীবনের অর্থ খোঁজার চেষ্টাও অর্থহীন। উপস্থিত মত উদ্ভাবন করার শাস্তিপ্রাপ্ত আমরা। আমরা যেন সেইসব অভিনেতার মতো যাদের কে মঞ্চে টেনে নিয়ে আসা হয়েছে অথচ তারা তাদের সংলাপ মুখস্ত করেনি, তাদের কাছে কোনো চিত্রনাট্য নেই বা ফিসফিসিয়ে মঞ্চ নির্দেশনা জানিয়ে দেয়ার মতো কেউ নেই। সময়ই মানুষকে এমনি এক নাট্যমঞ্চে এনে দাঁড় করিয়েছে। তাই কীভাবে বাঁচতে হবে সে-সিদ্ধান্ত অবশ্যই আমাদেরকেই নিতে হবে।
জাঁ পল সার্ত্রে বলেছেন যে মানুষ যখন উপলদ্ধি করে যে সে বেঁচে আছে, একদিন সে মারা যাবে- এবং আঁকড়ে ধরার মতো কোনো অর্থ নেই- তখন সে উদ্বেগ বোধ করে। অর্থহীন একটা জগতে মানুষ বিচ্ছিন্ন বোধ করে। জগতে মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ হতাশা, একঘেয়েমি, বিবমিষা আর অবাস্তবতার একটা অনুভূতি তৈরি করে। “বিষণ্ন বোধ করা বা সবকিছুই খুব একঘেয়ে এ রকম একটা অনুভূতি হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
মানুষের স্বাধীনতাকে সার্ত্রে একটা অভিশাপ হিসেবে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ মুক্ত হওয়ার সাজাপ্রাপ্ত’। সাজাপ্রাপ্ত তার কারণ সে নিজেকে তৈরি করেনি, কিন্তু তারপরেও মানুষ মুক্ত। কারণ এ জগতে একবার চলে আসার পরে সে তার প্রতিটি কৃতকর্মের জন্য দায়ী। কিন্তু মুক্ত মানুষ হিসেবে আমাদেরকে সৃষ্টি করতে তো বলিনি আমরা।
এ জগতে একবার চলে আসার পরে কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই ন্যায় কি? অন্যায় কি? জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে সে নিজেকে তৈরি করার আগেই সে তার প্রতিটি কৃতকর্মের জন্য দায়ী। আবেগতাড়িত হয়ে শিশু আগুনে হাত দিয়ে তার হাত পুড়বে না এমন কোন কথা নেই।সার্ত্রে ঠিক এটাই বলতে চেয়েছেন। তারপরেও আমরা মুক্ত মানুষ এবং এই স্বাধীনতা আমাদেরকে সারা জীবন ধরেই অনবরত বেছে নেবার শাস্তি দিয়েছে। এমন কোনো শাশ্বত মূল্যবোধ নেই বা রীতি নেই যা আমার আঁকড়ে ধরে থাকতে পারি, যা আমাদের পছন্দকে বেশি অর্থবহ করে। কারণ আমরা যা করি তার জন্য আমরাই পুরোপুরি দায়ী।
সার্ত্রে এই কথাটির ওপরেও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন যে মানুষ যেন কখনো তার কৃতকর্মের দায়-দায়িত্ব অস্বীকার না করে। ওদিকে আবার আমরা এই অজুহাতেও আমাদের বেছে নেবার দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারি না যে আমাদেরকে কাজে যেতেই হচ্ছে বা কীভাবে আমরা জীবন যাপন করবো সে ব্যাপারে আমাদেরকে অবশ্যই কিছু মধ্যবিত্তসুলভ প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এভাবে যারা অজ্ঞাত পরিচয় জনসাধারণের দলে ঢুকে পড়ে তারা নিজেদের কাজ থেকে পালিয়ে আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে কখনোই নৈর্ব্যক্তিক একটা দঙ্গলের সদস্য হওয়া ছাড়া অন্য কিছু হতে পারবে না। অন্য দিকে, আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরকে বাধ্য করে আমাদের নিজেদেরকে কাজে লাগিয়ে কিছু একটা সৃষ্টি করতে, বিশুদ্ধভাবে বা সত্যিকার অর্থে বাঁচতে।
সার্ত্রে যদিও দাবি করেছেন যে জীবনের কোনো সহজাত অর্থ নেই, তাই বলে তিনি কিন্তু বলেননি যে কোনো কিছুরই কোনো অর্থ নেই। আমরা যাকে বলি নাস্তিত্ববাদী(nihilist), তিনি কিন্তু তা ছিলেন না। নাস্তিত্ববাদী তিনি যিনি মনে করেন কোনো কিছুরই কোনো অর্থ নেই এবং সব কিছুই বৈধ। সার্ত্রে মনে করতেন যে জীবনের অর্থ থাকতেই হবে। এটা একটা একান্তই প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু আমাদের জীবনে এই অর্থ তৈরি করতে হবে আমাদের নিজেদেরকেই। অস্তিত্বশীল থাকার অর্থ তোমার নিজের জীবনকে নিজেই তৈরি কর। মানব জীবনের প্রকৃত অর্থ সেটাই যেভাবে আমরা নিজেরাই আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করি।
“মানুষের কোনো শাশ্বত প্রকৃতি নেই যার ওপর ভরসা করা যেতে পারে। আমরা নিজেরা নিজেদেরকে সৃষ্টি করি।”
— জাঁ পল সার্ত্রে
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................