হার্ভার্ড থেকে জীবাণু পাচার করতে গিয়ে চীনা বৈজ্ঞানিক ধৃত।

হার্ভার্ড থেকে জীবাণু পাচার করতে গিয়ে চীনা বৈজ্ঞানিক ধৃত

২৮ জানুয়ারি ২০২০ নাগাদ আমেরিকার বিচার বিগাইয় মন্ত্রক ঘোষণা করে যে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও প্রাণরসায়ন বিভাগে কর্মরত দুজন চীনা বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী গ্রেফতার হয়েছে চীন সরকারের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার অপরাধে। দুজন চীনা বিজ্ঞানীর পরিচয় নিচে দেওয়া হল –

ইয়াংক়িং ইয়ে (Yanqing Ye) : চীনা বংশোদ্ভূত ইয়ের বয়স মাত্র ২৯, তার বিরুদ্ধে জাল ভিসা, মিথ্যা তথ্য প্রদান, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা, চীনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করা ইত্যাদি অভিযোগ আনা হলেও চীনের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিং এর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে তাকে জেল খাটতে হয়নি।

জ়াওসং ঝেং (Zaosong Zheng) : ৩০ বছর বয়সী ঝেং ১০ ডিসেম্বর২০১৯ সালে বোস্টন শহরের লোগান (Logan) বিমান বন্দরে গ্রেফতার হন। তার বিরুদ্ধে বেআইনি ভাবে ২১ শিশি ভর্তি প্রাণঘাতী জীবাণু আমেরিকা থেকে চীনে পাঠাবার অভিযোগ আনা হয়। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে তাকে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় বোস্টন সুপ্রিম কোর্ট।

ডঃ চার্লস লিয়েবের

শুধু এই দুজন নয়, আরেকজন হার্ভার্ড অধ্যাপককে গ্রেফতার করা হয়েছিল – ডঃ চার্লস লিয়েবের (Dr. Charles Lieber)। ৬০ বছর বয়সী হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও প্রাণরসায়ন বিভাগের সভাপতি ও অদ্যাপক চার্লস লিয়েবেরকে দুই চীনা ছাত্রের সম্বন্ধে স্বদেশকে মিথ্যা তথ্য প্রদান, জাল ভিসা তৈরিতে সাহায্য করার পাশাপাশি ২১ শিশি পাচারে সাহায্য করার জন্যেও গ্রেফতার করা হয়েছিল।

তার কাছে প্রাপ্ত নথিপত্র অনুসারে লিয়েবের সেই ২০০৮ সাল থেকেই ন্যানোসায়েন্সের ওপর গবেষণার জন্য ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ বা এনআইএইচ [National Institutes of Health (NIH)] এবং ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স [Department of Defense (DOD)] থেকে একশ পঞ্চাশ কোটি ডলার অনুদান পেয়েছে। কিন্তু চার্লস লিয়েবের এতেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, তার গবেষণা আরও প্রসারিত করার জন্য অন্যান্য দেশ থেকেও অনৈতিক উপায়ে অর্থ গ্রহণ করেছিলেন।

সেই ২০১১ সাল থেকে হার্ভার্ডকে জানিয়েই অবশ্য, লিয়েবের উহান ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি বা ডবলুইউটি [Wuhan University of Technology (WUT)] এসে ‘রণনীতিগত বিজ্ঞানীর’ পদ গ্রহণ করেন। একইসাথে চীনের ‘থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস প্ল্যান’ রণনীতির প্রধান হন ২০১২ সালে, পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন। চীনের থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস প্ল্যান সেদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও অর্থসাপেক্ষ পরিকল্পনা, যার মাধ্যমে অন্তত এক হাজার নতুন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার করার কথা ভাবা হচ্ছিল। এই পরিকল্পনা অনুসারে সারা দুনিয়া থেকে চীনা বংশোদ্ভূত ছেলেমেয়েদের চীনে এনে বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ করে দিয়ে চীনের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, সামরিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি আরও বাড়াবার কথা ভাবা হয়েছিল।

কিন্তু অচিরেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, চীন আসলে যুবাদের বিজ্ঞানচর্চার নামে আসলে সারা দুনিয়া থেকে নতুন নতুন প্রযুক্তি চুরি করাবার জন্য ‘সুপারি’ দিচ্ছে। সেটাই ছিল চীনের পরিকল্পনা। এই প্রযুক্তি চুরির একটা বড় অংশ ছিল জীবাণুবিদ্যা সংক্রান্ত। এই ‘থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস প্ল্যান’ -এ অংশ নেবার জন্য লিয়েবার প্রতি মাসে শুরুতে পঞ্চাশ হাজার ডলার পেতেন, শেষে পেতেন ১,৫৮,০০০ ডলার। চুক্তি ছিল পাঁচ বছরের, পরে সেটা কমিয়ে তিন বছর করা হয়। চুক্তির মেয়াদ কমিয়ে দেওয়ার ‘ক্ষতিপূরণ’ স্বরূপ লিয়েবারকে ‘ডবলুইউটি’তে একটি গবেষণাগার নির্মাণের ভার দেওয়া হয়, এজন্য তাকে প্রতি মাসে ১৫ লাখ ডলার দেওয়া হত।

এর বিনিময়ে লিয়েবার হার্ভার্ডের চেয়ে ডবলুইউটিতে বেশী সময় কাটাতে থাকেন। সাথে হার্ভার্ড সহ আমেরিকা ও ইউরোপের বহু জায়গা থেকে বিজ্ঞানী, ছাত্রছাত্রীদের ডবলুইউটিতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি সেমিনার, আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের দায়িত্ব একক ভাবে নিতে থাকেন। এছাড়া সারা দুনিয়ায় নামীদামী বিজ্ঞান পত্রপত্রিকায় ডবলুইউটির তরফে পেটেন্ট ও প্রবন্ধ ছাপানোর ব্যবস্থাও করতে থাকেন।

কিন্তু ২০১৭ সালের শেষদিকে হার্ভার্ড তার কার্যকলাপ নিয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠে। তার কাছে থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস প্ল্যান ও ডবলুইউটির সাথে সংযুক্তির সম্পর্কে কৈফিয়ত নিতে থাকলে, লিয়েবার হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষের কাছে অনৃতভাষণ করেন। ২৪ এপ্রিল ২০১৮ সালে জনৈক হার্ভার্ড তদন্তকারী লিয়েবারকে প্রশ্ন করলে লিয়েবার তাকে জানান, তিনি কস্মিনকালেও থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস প্ল্যানের সাথে যুক্ত ছিলেন না। তবে চীন তাকে কি চোখে দেখে, সে বিষয়ে তিনি অবহিত নন।

নভেম্বর ২০১৮ সালে এনআইএইচ লিবেয়ারের চীন সরকার ও ডবলুইউটির সাথে সন্দেহজনক সম্পর্ক নিয়ে রীতিমত তেড়েফুঁড়ে তদন্তে নেমে পড়ে এবং শীঘ্রই আবিষ্কার করে লিয়েবার তাদের কাছে মিথ্যা কথা বলেছেন। লিয়েবারকে ডেকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে লিয়েবার জানান, তিনি ডবলুইউটির সাথে যুক্ত বটে, কিন্তু থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস প্ল্যানের সাথে একেবারেই যুক্ত নন। তিনি এবিষয়ে অবহিত পর্যন্ত নন। লিয়েবার এবিষয়ে একটি হাস্যকর যুক্তি দেন – যেহেতু তিনি ম্যান্ডারিন ভাষা জানেন না; তাই এরকম কোনও সরকারী পরিকল্পনার সাথে যুক্ত থাকবার কোনও সম্ভাবনা নাকি নেই। কিন্তু সেই যুক্তি এনআইএইচ কর্তৃপক্ষ মানেন নি।

ইয়াংক়িং ইয়ে

যখন ইয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়, তখন জানা যায়, ইয়াংক়িং ইয়ে আসলে পিপল’স লিবারেশন আর্মির একজন লেফটেন্যান্ট এবং তিনি চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) উচ্চপদস্থ সদস্যও বটে। তিনি যখন জে-১ ভিসা নিয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন নিজেকে একজন সাধারণ ‘ছাত্রী’ হিসাবে পরিচয় দিয়েছিলেন। এটা তিনি চেপে গিয়েছিলেন যে, তিনি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ ডিফেন্স টেকনোলজি বা এনইউডিটি [National University of Defense Technology (NUDT)] ছাত্রী, যা কিনা চীনের সর্বোচ্চ পর্যায়ভুক্ত সামরিক বিদ্যায়তন হিসাবে গণ্য হয়।

অক্টোবর ২০১৭ থেকে এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত ইয়াংক়িং ইয়ে যে সময়ে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জৈবচিকিৎসা বাস্তুবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে পড়ছিলেন; প্রায় একই সময়ে তিনি পিএলএ লেফটেন্যান্ট হিসাবে গুপ্তচরবৃত্তি করে যাচ্ছিলেন। তিনি আমেরিকার মিলিটারি ওয়েবসাইট হ্যাকিং করে প্রাপ্ত তথ্য চীনে পাঠাচ্ছিলেন।

বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় তার হালচাল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। তার বিরুদ্ধে এফবিআইতে অভিযোগ জানায়। ২০ এপ্রিল ২০১৯ সালে যখন এফবিআই তাকে বোস্টন লোগান বিমান বন্দরে চীনে প্রত্যাবর্তনরত ইয়াংক়িং ইয়েকে গ্রেফতার করে, তখন এটা পরিষ্কার হয়ে যায় – তিনি আমেরিকায় থাকাকালীন নিয়মিত দুই এনইউডিটি অধ্যাপকের কাছে নিয়মিত আমেরিকার সেনাবাহিনী সংক্রান্ত সংবাদ পাচার করছিলেন, যারা আবার পিএলএ টপ অফিসারও বটে। রোবটিক্স ও কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে ওয়াকিবহাল একজন আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ বিজ্ঞানীকে হানিট্র্যাপে ফেলে ইয়াংক়িং ইয়ে তাকে চীনে তথ্য পাচার করতে বাধ্য করে। এই কাজ না করলে দুজনের অন্তরঙ্গ ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়বে বলে হুমকিও দিয়েছিলেন ইয়াংক়িং ইয়ে।

উইচ্যাট (WeChat) সাইটে দুই এনইউডিটি অধ্যাপকের সাথে ইয়ের সর্বশেষ কথোপকথনের ট্রান্সক্রিপ্ট থেকেও বোঝা যায় তার গুপ্তচরগিরির জাল অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উইচ্যাটে নিজের বক্তব্যের ট্রান্সক্রিপ্ট দেখে ইয়াংক়িং ইয়ে ভেঙ্গে পড়ে এবং পিএলএ ও সিসিপির সাথে তার সম্পর্ক স্বীকার করে নেয়।

জ়াওসং ঝেং

আগস্ট ২০১৮ সালে জ়াওসং ঝেং জে-১ ভিসা নিয়ে আমেরিকায় প্রবেশ করেছিল, এবং ক্যান্সার সেল রিসার্চার হিসাবে বোস্টনের বেথ ইজরায়েল ডিকোনেস মেডিক্যাল সেন্টারে কাজ করেছিল। ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে ৯ ডিসেম্বর ২০১৯ সালের মধ্যে অন্তত ২১টি জীবাণু ভরতি শিশি চীনে পাচার করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

এফবিআই তার নামেও বিস্তর অভিযোগ পেয়ে লোগান বিমান বন্দরে তাকে ইয়াংক়িং ইয়ের সাথে গ্রেফতার করে। তার মোজাকে তল্লাশি করলে ভেতরে একটা জীবাণু ভর্তি শিশি পাওয়া যায়। এই নিয়ে প্রশ্ন করলে জ়াওসং ঝেং ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলে, কিন্তু এফবিআইয়ের কঠোর জেরার মুখে ভেঙ্গে পড়ে এবং তার কুকীর্তি সম্পর্কে স্বীকারোক্তি দেয়। সে এটাও মেনে নেয় বেথ ইজরায়েল ডিকোনেস মেডিক্যাল সেন্টারে (Beth Israel Deaconess Medical Centre) দেড় বছর কর্মজীবনে অন্তত ২১ বার একটি করে জীবাণু ভর্তি শিশি এভাবে পাচার করেছে। এবং তার কাছে জাল প্রমাণপত্র থাকায় সেগুলো নিয়ে বিমান বন্দরের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি। ঝেং এও মেনে নেয়, এই ২১ ভায়াল দিয়ে সে নিজের বাড়ীতে একটা গবেষণাগার বানিয়ে গবেষণা করার পরিকল্পনা করেছিল। যদিও তার সাথে পিএলএ বা সিসিপির কোনও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস প্ল্যান এবং চীন

প্রশ্ন : থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস প্ল্যান আসলে কি?

উত্তর : ২০০৮ সালে চীনের কমিউনিস্ট শাসকরা দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আবিষ্কার, উদ্ভাবনা ইত্যাদি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী আমদানি করে আসলে পশ্চিমী প্রযুক্তি চুরি ও তাকে কাজে লাগিয়ে আরও উন্নত করার যে পরিকল্পনা করেছিল; তাই থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস প্ল্যান নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনা অনুসারে এক হাজার রিক্রুটের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

বিজ্ঞানী নাকি গুপ্তচর?

চীন যে আমেরিকায় লোক পাঠিয়ে প্রযুক্তি চুরি করে তাকে কাজে লাগিয়ে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন বানানোর ঘাতক পরিকল্পনা করছে, সেটা ধরতে আমেরিকার অনেক বছর লেগেছে। জুন ২০১৮ সালে হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়।

এপ্রিল ২০১৮ সালেই আমেরিকার মারকিন-চীনা অর্থনীতি ও নিরাপত্তা পর্যালোচনা আয়োগের (U.S.-China Economic and Security Review Commission) প্রধান মাইকেল ওয়েসেল (Michael Wessel) প্রথমবার সেনেটে মার্কিন কংগ্রেসকে যেসব অধ্যাপক বা ছাত্রছাত্রী থাউজ্যান্ড ট্যালেন্টস প্ল্যানের সাথে যুক্ত, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত করার নির্দেশ দেন। ওয়েসেল বলেন, “চীন তাদের গুপ্তচর আমাদের দেশে ঢুকিয়ে প্রযুক্তি শুধু চুরিই করছে না, সাথে অন্তর্ঘাত করার চেষ্টাও করছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার – তারা আমাদের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঘাতক জৈবাস্ত্র বানানোর চক্রান্ত এঁটেছে; যা কিনা আমাদেরই বিরুদ্ধে কাজে লাগাবে স্থির করেছে!”
✍ Ayan Chakraborty

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted