-ধন্যবাদ উম্মে হানি, আজকে মিরাজের দিনে আমাকে সময় দেয়ার জন্য।
-আপনাকেও ধন্যবাদ সুপা। কি জানতে চান বলুন?
-প্রথমেই বলতে চাই মিরাজের ঘটনায় আপনার নামটি চলে না আসলে ইসলামের ইতিহাসে উম্মে হানি হতো বিস্মৃত একটি নাম। কিন্তু মিরাজের কারণে আপনার নামটি বহুল পরিচিত। বলতে কি বিতর্কিত…
-বিতর্কিত বলছেন কেন?
-আসলে কি ঘটেছিল সেদিন একটু বলবেন আমাদের?
-কেন সে ঘটনা তো সবাই জানে। আমার ঘর থেকেই রসূল্লাহ মিরাজ গমন করেছিলেন। সেরাতে নবীজি আমার ঘরেই ঘুমিয়ে ছিলেন। এশার নামাজ আদায় করে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তারপর ভোরে ফজরের নামাজের একটু আগে আমাদের ডেকে তোলেন এবং আমরা একসঙ্গে ফজরের সালাত আদায় করি…
-উম্মে হানি আপনাকে একটু থামাই, মিরাজ গমণ করার আগে এশার নামাজ ফজর নামাজ কি করে আসছে? মিরাজ থেকেই তো ৫ ওয়াক্ত নামাজের নির্দেশ নিয়ে আসা হয়। তবু যাই হোক, ধরে নিলাম নবীজি নামাজ পড়ছিলেন কিন্তু আপনিও নামাজ পড়ছেন এমনটা কি করে হতে পারে? আপনি তো মক্কা বিজয়ের আগে ইসলাম গ্রহণ করেনি!
-(মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে) তা এসব আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন, ইবনে হিশামকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন…।
-ইবনে কাথির সুরা আহযাবের তাফসির করতে গিয়ে লিখেছেন আপনি মক্কা বিজয়ের আগে ইসলাম গ্রহণ করেননি। নবীজি তো আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাই না?
-হ্যাঁ। এটা মিরাজের ঘটনার পরের ঘটনা। মিরাজের ঘটনার এক বছরের মধ্যে নবীজি মদিনায় হিযরত করেছিলেন। তখন তিনি আমাকে বিয়ের প্রস্তব দিয়েছিলেন।
-সুরা আহযাবের ৫০ নম্বর আয়াত আপনার প্রত্যাখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছিল।
-হ্যাঁ তাই। আমি হিযরতকারীদের মধ্যে ছিলাম না, এ কারণেই সুরা আহযাবে বলা আছে, যে সব কাজিন আপনার সাথে হিযরত করেছে তাদের বিয়ে করা হালাল। আমি নবীজিকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানালে সুরা আহযাবের ৫০ নম্বর আয়াত নাযিল হয়। এ বিষয়ে ইবনে কাথির পরিস্কার করে তার তাফসিরে লিখেছেন। কষ্ট করে একটু পড়ে দেখবেন।
-ঠিক আছে। চলুন আবার মিরাজের প্রসঙ্গে যাই। হাসান বসরী বলেছেন, নবীজি কাবার হিজরের মাঝ ঘুমিয়ে ছিলেন। এমন সময় জিব্রাইল এসে নবীজিকে চিমটি কেটে ঘুম ভাঙ্গিয়ে তাকে মিরাজে নিয়ে যান। এই ঘটনা ধরলে নবীজি মিরাজ গমণ শুরু কাবাঘরের সামনে থেকে। কিন্তু আপনি দাবী করেছেন সেরাতে নবীজি আপনার ঘরেই ঘুমিয়ে ছিলেন এবং আপনার ঘর থেকেই তিনি সপ্ত আকাশে ভ্রমণে বের হোন।
-এতে আপনাদের নাস্তিকদের সমস্যাটা কি? মুসলমানদের তো কোন সমস্যা হচ্ছে না? কই তারা তো কোন প্রশ্ন তুলছে না? আজ পর্যন্ত এমন কোন ইসলামী পন্ডিতকে পেয়েছেন যিনি আমার ঘর থেকে মিরাজ যাওয়াকে অস্বীকার করেছেন?
-আমার ঠিক জানা নেই। তবে আমাদের ফেইসবুক মোল্লাদের আপনি চেনে না। তারা ঠিকই তালগাছ বগলে নিয়ে এই বিষয়ে তর্ক জুড়ে দিবে! আচ্ছা উম্মে হানি, মিরাজের কথা যখন নবীজি প্রকাশ করলেন তখন সবাই বিশ্বাস করে নিয়েছিল?
-পাগল আপনি! আমি তো ভয়ে কাঁপছি তখন! নবীজি আমাকে স্বাক্ষি রেখে বলছেন, দেখো আমি তোমাদের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলাম তারপর আল্লাহ নির্দেশে আল্লার আরশে ঘুরে এসেছি। এদিকে কাবাঘরে সামনে নবীজিকে না পেয়ে তার সাথীরা খুঁজতে খুঁজতে আমার ঘরে এসে উপস্থিত। নবীজি তখন সবাইকে বলছিলেন তিনি এই জগতে ছিলেন না। এক রাতের মধ্যে ২৭ বছর পার করে এসেছিলেন আল্লার সাথে সাক্ষৎ করতে গিয়ে।
-তারপর?
-নবীজি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে মক্কার সামনে সবাইকে এই ঘটনা বর্ণনা করে শুনাচ্ছিলেন। এসব শুনে বহু নওমুসলিম ইসলাম ত্যাগ করে ফেলেছিল। তারা নবীজিকে মিথ্যাবাদী বলতে লাগল।
-নিন্দুকরা আপনার বাড়িতে নবীজিকে পাওয়া নিয়ে সন্দেহ করেছিল। আপনার স্বামী তখন বাড়িতে ছিল না…।
-… আমি সব মিলিয়ে ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম তাকে নিয়ে। ঘরে আমাদের যে হাবশি দাসটি ছিল, তাকে বললাম, শীগগির তুমি নবীজির কাছে চলে যাও। গিয়ে দেখো লোকজন তার সঙ্গে কেমন আচরণ করছে…।
-ইবনে হিশাম এমনটাই লিখেছেন আপনার বর্ণনা উল্লেখ করে। আচ্ছা হিশাম তো সহি হাদিসকে ভিত্তি করেই নবীজির জীবনীটা লিখেছেন তাই না? আচ্ছা যাই হোক, আবু বকর তো সে সময় বিরাট একটা ভূমিকা রেখেছিল মিরাজ ঘটনায়?
-হ্যাঁ তিনিই প্রথম মিরাজকে খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা এমনভাবেই প্রচার শুরু করেন। লোকজন যখন তাকে গিয়ে বলছিল তোমার বন্ধু দাবী করছে সে কাল রাতে সাত আকাশ ভ্রমণ করে এসেছে তখন প্রথমটায় আবু বকর নিজেই কথাটা বিশ্বাস করেনি। পরে যখন তিনি শুনলেন নবীজি সত্যিই এমন দাবী করছেন তখন সে একটা চরম কথা বলল। সে বলল, দেখো আমি তো জানি নবীজির সাথে রাতদিন আল্লার ম্যাসেজ চালাচালি চলে, সেখানে এই মিরাজ তো খুবই সাধারণ একটি ঘটনা।
-আবু বকর তো নবীজির বর্ণনা করা বাইতুল মোক্কাদেসের প্রতিটি অংশকে সঠিক বলে রায় দিয়েছিলেন তাই না?
-হ্যাঁ, নবীজি যখন দাবী করেছিলেন তিনি এক রাতের মধ্যে মক্কা থেকে জেরুযালেম গিয়ে নামাজ পড়ে এসেছেন তখন লোকজন সেখানটার আল আকসা মসজিদের বর্ণনা শুনতে চাইছিলো। আবু বকর দাবী করেছিল সে জেরুযালেম গিয়ে সেটা আগে দেখে এসেছে। তাই নবীজি বর্ণনা করাতে তিনি সাক্ষি দিতে লাগলেন নবীজি সঠিক বলছেন।
-কিন্তু সেখানে তো কোন মসজিদ সেসময় ছিল না! সলোমনের মন্দির বলতে সেখানে যেটা ছিল, সেটাও রোমানরা ভেঙ্গে দিয়েছিল। অর্থ্যাৎ, ইহুদীদের নবী সলোমনের একটা মন্দির সেখানে ছিল ৯৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পরে রোমানরা সেটা ৭০ খ্রিস্টাব্দে আক্রমন করে ভেঙ্গে ফেলে। সেটা তখন ভঙ্গুর অবস্থায় পড়েছিল। নবীজি তাহলে কি করে সেখানে বাইতুল মোকাদ্দেস মসিজদটা দেখতে পেলো আবার আবু বকর নিজে দেখে এসে সেই বর্ণনাকে সঠিক বলেও রায় দিচ্ছেন! সে যুগে ঘোড়ায় চড়ে মক্কা থেকে জেরুজালেম যেতে দুই মাসের বেশি পথ পাড়ি দিতে হতো। মক্কার লোকজন ইহুদীদের তীর্থভূমি জেরুজালেম এবং সলোমনের মন্দিরের কথা জানতেই পারে। কিন্তু নিজের চোখে দেখে আসার মত খুব কম লোকই সেখানে ছিল। এসব ইতিহাস সেসময় খুব বেশি মানুষের জানার কথা না। কাজেই নবীজি কি বলছেন সেটা প্রমাণ করার কেউ নেই এক আবু বকর ছাড়া!
-এত কঠিন কথা আমি বুঝি না। শুধু এটুকু জানি, তিনি আল্লাহর নবী। তিনি চাইলে সবই হতে পারে।
-আয়েশা তো বলেছেন মিরাজ ঘটেছে স্বপ্নের মাধ্যমে। নবীজি সশরীরের কোথাও যাননি। সাহাবী মুয়াবিয়াও একই দাবী করেছেন। এরকম মনে করার আসলে কারণ কি? মিরাজ গমণকে স্বাভাবিকভাবে নিতে না পারা?
-আপনি ইবনে হিশাম পড়েছেন সুপা? তিনি কি লিখেছেন শেষতক? ‘আল্লাহতালাই সব থেকে ভাল জানেন মিরাজ কেমন করে ঘটেছিল’। এটাই হচ্ছে খাঁটি বিশ্বাসের কথা।
-ঠিক বলেছেন। আচ্ছা, নবীজি নাকি এক রাতের মধ্যে ২৭ বছর আল্লাহ’র কাছে কাটিয়ে এসেছিলেন? কিন্তু পৃথিবীতে এসে দেখেন উনার অজুর পানি তখনো গড়িয়ে যাচ্ছে…।
-হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন।
-তাহলে নবীজি মিরাজ থেকে ফিরে এসে কি দেখেছেন আপনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন?
-তা দেখবেন কেন? আমাদের সময়ে তো সেটা মাত্র এক রাতের ব্যাপার।
-আসলে কি জানেন, আমাদের একজন বড় বিজ্ঞানী আছেন আইনস্টাইন। তিনি আপেক্ষিক তত্ত্ব নামের একটা জিনিস আবিস্কার করে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। তার সেই আবিস্কার বলে, কোন বস্তু যদি আলোর গতির সমান ছুটতে পারে তাহলে তার সময় স্থীর হয়ে যাবে। তার মানে আমাদের নবীজি যদি দাবী করে থাকেন তিনি ২৭ বছর পার করে এসেছেন এর মানে দাঁড়াচ্ছে আল্লার আরশ পৃথিবী থেকে আসতে যেতে ২৭ আলোকবর্ষ দূরে। আলোর গতিতে বুরাকে চেপে তিনি মহাশূন্য ভ্রমণ করে আসলে তার সময় ধীর হতে হতে সেটা বড়জোর কয়েক ঘন্টা বা এক রাত্রী সমান হলেও পৃথিবীতে ঠিকই ২৭ বছর পার হয়ে যাবার কথা! তাহলে তিনি কি করে এসে দেখলেন আপনি তখনো ঘরে বসে আছেন? পৃথিবী একই রকম থেকে গেছে? বৈজ্ঞানিকভাবে তো এটা যাচ্ছে না?
-সুপা আপনি পাগল নাকি বলেন তো? আল্লাহ চাইলে কি না হয় বলেন তো?
-তা অবশ্য লাখ কথার এক কথা বলেছেন। তাহলে এইসব যুক্তিটুক্তির কথা আর চলে না। আচ্ছা ম্যাডাম, আমাদের ইন্টারভিউ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। লাস্ট প্রশ্ন, আপনি মিরাজ বিশ্বাস করেছিলেন?
-তিনি আল্লার নবী, তিনি কি না পারেন!
-তবু আপনি ইসলাম গ্রহণ করেননি কেন? অন্তত ইবনে কাথিরের তথ্য অনুযায়ী মক্কা বিজয়ের আগে আপনি ইসলাম গ্রহণ করেননি…
-(মুচকি হেসে) আল্লাহ হিদায়েত নসিব না করলে আমার কি স্বাধ্য বলেন তো!
-থ্যাঙ্কংস উম্মে হানি আমাকে সময় দেয়ার জন্য আবারো। মিরাজ নিয়ে কিছু গন্ডগোল থেকেই গেলো অবশ্য…
-আপনাকেও ধন্যবাদ সুপা।… আর হ্যাঁ, আপনাকে একটা কথা বলি, গাধার মত একটা পশু যার মানুষের মত মুখ। এরকম একটা জন্তুর পিঠে চড়ে মহাকাশ ভ্রমণের ঘটনা বিশ্বাস করতে হলে অন্ধ আত্মসমর্পন লাগে। আপনার সেটা নেই। মিরাজ বিশ্বাস করতে তাই যুক্তি লাগে না। ভাল থাকবেন…।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................