দিদি, এক বাটি আটা দিবেন ? : হায়রে ! NRC, CAA

দিদি, এক বাটি আটা দিবেন ? : হায়রে ! NRC, CAA 
----------------------------------------------------------------------
“দিদি, এক বাটি আটা দিবেন ? কাইল সক্কালে গম ভাঙ্গাইয়া আনলে ফিরত দিয়া দিমু।“ প্রতিবেশী একে অপরের কাছে থেকে ধার করে দিন গুজরান। এই প্রথা প্রচলিত ছিল ১৯৪৭-এর পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে এপার বাংলায় আসা সহায় সম্বলহীন 'উদ্বাস্তু' নামক মানুষগুলোর মাঝে। এরা এবাংলার ঘটিদের কথিত 'বাঙ্গাল'। সকলেরই অবস্থা তখন প্রায় এরকমই!। জবর দখল করা জমিতে বসবাস, যার পোশাকি নাম-কলোনি। এবাংলার ঘটিদের মুখে মুখে ঘোরা এই 'বাঙাল' দের পেছনে লুকিয়ে আছে বহু মানুষের সমূলে উচ্ছেদের, জাতি-দাঙ্গার নিদারুন ইতিহাস, যা বাবু কালচারের বেড়াজালে থাকা ঘটিরা জানল না, বা জানার চেষ্টাও তেমনভাবে করেনি ! দেশত্যাগীর জ্বালা প্রখর বুদ্ধি থাকলেই বোঝা যায়না। আজকে এই বাঙালদের ছেলেমেয়েরা, পূর্বপুরুষের অতীতের ভয়াবহ সামাজিক সংঘাত, নতুন দেশে এসে নতুন পরিবেশে, ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে নিত্য লড়াইয়ের কাহিনী বিস্মৃত। ঘটিরা তো কোন ছাড় !

১৯৪৬-এর নোয়াখালির দাঙ্গার পরেই অনেক মানুষ বিষয় সম্পত্তি বিক্রি করে পূর্ব পাকিস্তানের পাট চুকিয়ে দিয়ে এপার বাংলায় চলে এসেছিল| যারা পূর্ব পাকিস্তানেই পরেছিল, তাদের জন্য অপেক্ষা করেছিল আরও বিভীষিকা! ১৯৪৯-এ আবার দাঙ্গা লাগলো পূর্ব পাকিস্তানে। দাঙ্গা লাগল খুলনা, ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ জেলাগুলোতে। দেশভাগের পর যেদিকে “আমাদের লোক” সেদিকে যাওয়াই নিরাপদ মনে করে হাজারে হাজারে শরণার্থী চলে এসেছিল এপার বাংলায়। কারুর ঠাই আত্মীয়ের বাড়ি, কেউ শরণার্থী ক্যাম্পে, কেউ জায়গা না পেয়ে শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ! অনেকে পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কুচবিহারের দিকেও গিয়েছিল। বেশ কিছু উদ্বাস্তুকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আন্দামান ও দন্ডকারণ্যে। ১৯৪৭-এ শরণার্থীদের স্রোত কিন্তু আজও বন্ধ হয় নি, যদিও ইদানীং তাদের আর উদ্বাস্তু বলে না।

কলকাতার কলোনিগুলো তৈরি হয়েছিল ১৯৪৯-৫০ নাগাদ। টালিগঞ্জ, যাদবপুর, বাঘাযতীন, অঞ্চলে বিভিন্ন জমিদারের জমি দখল করে ।

১৯৫০-এ পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় চলে আসা কোনো কোনো মানুষেরা হয়তো বা আশ্রয় নিয়েছিল চারঘর আত্মীয় পরিবার একসঙ্গে মোট ৬০০ বর্গ ফুটের দুই ঘর এক বারান্দায় । চার পরিবারের ২১ জন ! কোথায় পূর্ব পাকিস্তানের দালানবাড়ি কোথায় এই ঘুপচি জায়গাতে একসাথে ২০-২১ টা মানুষ!

উদ্বাস্তু কলোনির মানুষদের জীবন গোষ্ঠিবদ্ধ ছিলো। অনেকেই ছিল ছোট এবং মাঝারি চাষী পরিবারের, যারা পূর্ব পাকিস্তানে ভিটেমাটি ছেড়ে এই বাংলায় আশ্রয় নিয়েছিল। আবার অজস্র ভূমিহীন উদ্বাস্তুও এসেছিল । কৃষক এবং ভূমিহীন তখন বরাবর। সবার বাড়িতে ঘড়ির মত প্রয়োজনীয় যন্ত্রও ছিল না! যার বাড়িতে ঘড়ি ছিল তার কাছে সময় জেনে নিতে হত। এক বাড়ির খবরের কাগজ তিন চার বাড়ির লোকে পড়ত। খেলায় উৎসাহী ছোটরা বড়দের কাছে খবর জেনে নিত ইস্টবেঙ্গল ক’টা গোল দিয়েছে। রেডিও তখন বিলাসিতা ! অনুরোধের আসরের গান শুনতে বাঙালরা যেত অন্য পাড়ায়।

জমি দখলের সংগ্রাম পরিবারগুলোকে যেন জুড়ে দিয়েছিল। যেসব জমিদারিতে কলোনি হয়েছিল সেই জমিদাররাও ছাড়বার পাত্র ছিল না। রাতে লেঠেল পাঠাত বসতি উৎখাতের জন্য। কলোনিবাসীরা লেঠেল বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সকলে একসাথে লড়ত। এত কষ্টের মধ্যেও বড়রা ছোটদের একটা মন্ত্র কানে ঢুকিয়ে দিয়েছিল– “পড়াশুনা করে বড় হতে হবে, সকলকে দেখিয়ে দিতে হবে”। কলোনির ঘরে ঘরে পড়াশুনার চল ছিল। তাই আজ অনেকেই পৃথিবীর নানা দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছে।

কলোনির ভিতরে কিছু কিছু ব্যক্তিমালিকানার ঘর বাড়ি ছিল। সেসব বাড়ির ছেলেমেয়েরা কলোনির স্কুলেপড়তে আসত না। তারা পড়ত সাউথ পয়েন্ট, তীর্থপতি ইন্সটিট্যুশনের মত স্কুলে। বাঙ্গাল উদ্বাস্তুরা কলকাতার বনেদি মানুষের কাছে এক আজব প্রাণী। তারা বলত: “কচুবন কোথায়? সে তো বাঙ্গালরা খেয়েই সাফ করে দিয়েছে।” বাঙ্গালরা জঞ্জাল খেয়ে সাফ করে দিলে কলকাতার বাবুদের থাকতে আর বাধা কোথায়? কলকাতার কলোনিতে বাঙালরা যেন কিছু অবমানব !

সংস্কৃতিকে খাটো হতে দেখার ভয় সব সময় পিছু তাড়া করেছে বাঙালদের। এখনও “হ্যাঁ”, “দাঁড়িয়ে” প্রভৃতি বানান লিখতে গেলে তারা চন্দ্রবিন্দু দেয়না । সন্দেহ হয় কোন অস্তিত্বটা তাদের। কোন উচ্চারণে কথা বলবে ? তারা কি পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা বাঙাল-উদ্বাস্তু না কী কলকাতারই একজন ?

উদ্বাস্তু হয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যারা এসেছিল তারা একাধিক অর্থে ছিন্নমূল। জন্মভূমি থেকে ছিন্ন। স্থাবর সম্পত্তি, কৃষি জমি থেকে উচ্ছিন্ন। পূর্ববঙ্গের সমাজ সংস্কৃতি থেকে বিসর্জিত! ১৯৪৭-এর আগে তারা ছিল ভারতবর্ষে। ১৯৫০এর পর তারা আবার এলো ভারতবর্ষে ! এটা ইতিহাসের এক বিরাট প্রহসন......

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted