এক অলেখা ইতিহাসের নোয়াখালীর চৌমুহনী।

লকডাউনের অখন্ড অবসরে আমি টুকটাক ইতিহসচর্চা করছি৷ বিশেষত পার্টিশানের ইতিহাস৷ যদিও আমি বরাবরের লাস্ট বেঞ্চির ছাত্রী,কোন বিষয়েই খুব ভালো দখল নেই৷ গুগল ঘাঁটতে ঘাঁটতে এই ছবিটায় চোখ পড়লো৷ বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার চৌমুহনী রেলওয়ে স্টেশানের প্লাটফর্ম৷ এই চৌমুহনী-বেগমগঞ্জ অঞ্চলে কখনো আমার পুর্বপুরুষের ভিটে ছিলো৷ ৪৬ এর জেনোসাইডের পর পিতামহ কলকাতায় চলে আসেন৷ উনি আমার জন্মের আগেই মারা যান,ফলত ওইসব ঘটনার বিবরণ তার মুখ থেকে শোনা হয়নি৷ বাবার জন্ম কলকাতায়, বামসুলভ সুশীলতায় ওসব আলোচনা কখনোই হতো না,বরং ওদের দেশহিতৈষী, গণশক্তি ম্যাগাজিন পড়েছি,সেখানে একটা গল্প ছিলো,এক হিঁ দুব্যাক্তি 'ওদের' অত্যাচারে ইন্ডিয়া চলে যেতে চান৷ গভীর রাতে ওদেরই কতিপয় 'ভালোমানুষ',তার কাছে এসে, একত্রে আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বো,প্রতিজ্ঞা করে তাকে ওদেশেই রেখে দেয়,ব্যাস সবুজ ধানক্ষেতের ফাঁকে লাল সুর্য্যের উদয়৷ সেই কাঙ্খিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে হ্যাপি এন্ডিং হয়েছে কিনা জানি না,তবে ম$দিনা সনদের বাংলাস্তানে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশানের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কিশোর কুমার দাশকে ফাউন্ডেশানের সাথে সম্পর্ক 'হ্যাপিলি' এন্ড করতে হয়েছে৷ এবং সংগঠনটি, 'বেশিরভাগই মু স্লিম সদস্য' মর্মে মু*লমানবতার কোলে ঝোল টেনে, মৌলবাদীদের ইনসুইঙ্গারে ডিফেন্স খেলেছে৷ বিদ্যানন্দ নামটিও হয়ত বদলে যাবে কোনদিন,তারা নাকি এতে হিঁদুয়ানি, বিবেকানন্দ ইত্যাদির গন্ধ পাচ্ছে৷ বাইরে বিদ্যানন্দ,ভেতরে ইস্কনানন্দর ধর্মান্তরণ প্রোগ্রাম,এইরকম একটা পোষ্টও চোখে পড়লো৷ এদেশে ওরা 'সিঙ্গেল সোর্স',থুতু মেরে প্লাজমাদানে, আমাদের কৃতজ্ঞ থাকতে হবে৷ অথচ,ওই অকৃতজ্ঞের দেশে সম্প্রদায়নির্বিশেষে শুধুমাত্র ত্রাণসামগ্রী বিলি করা সংগঠনের কর্তাকে তার কু ফ রী নাম পরিচয়ের কারণে সরে যেতে হবে৷

যাই হোক,পরিবারের 'প্রগতিশীলতা' র কারণেই,যেটুকু শুনেছি ভাসা ভাসা৷ বরং, ওই এলাকায় এককালে থাকা মামাদিদার মুখে শুনেছি, একটা বাড়ি,কিছু জমি এবং উঠোনে রাধাগোবিন্দের মন্দির(যেটা বর্তমানে ম স জি দ) ছিলো৷ তবে কখনোই খুব বেশী মুখ খুলতেন না৷ অসন্মানের ইতিহাস তো, মামাদাদু স্ত্রী,বড়ো মেয়ের ইজ্জত-আব্রু বাঁচাতে জনৈক জ্বনাব চৌধুরীসাহেবের চাপে সম্পত্তি হস্তান্তরের দলিলে সই করে এক কাপড়ে ইন্ডিয়া চলে আসেন৷ প্রতিবার দেখেছি এসব আলোচনা করলেই মামাদিদাকে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে,তৌহিদীদের ওই ইঙ্গিতপূর্ণ বিশ্রী দেঁতো হাসির কথা ভুলতে পারেন নি উনি,আমিও বিশেষ জোর করতাম না৷ শুধু আমি 'ওদের' সাথে বেশী মেলামেশা করছি দেখলে,উনি কেমন যেন আশঙ্কামিশ্রিত বিরক্তি প্রকাশ করতেন৷'তর কি অগো বাসায় লই আইতেই অইবো?'ব্যাস এইটুকুই৷ আজকালকার প্রজন্ম আমরা, আধুনিকতার ধুনকিতে গুরুজনের মুখের উপর খ্যা খ্যা করে হেসে,ওনাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাটা বিচিত্র নয়৷ সেই কারণেই হয়ত চুপ করে যেতেন৷ এখন বুঝি,আসলে উনি ভয় পেতেন,উনি ওদের দেখলে আজও ভয় পান,ওই ভয়ের প্রহরগুলো যাতে আমার জীবনেও পুনরাবৃত্ত না হয়,যাতে আমিও বিশ্বাস করে না ঠকি,সেই জন্যই আমাকে সাবধান করতে চাইতেন৷ ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, প্রবচনটি বিশেষভাবে বাঙাল রিফিউজিদের জন্যই লিখিত৷ এই সাইনবোর্ডটা দেখেই মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো,ভাবলাম, আর কি ফিরে পাওয়া যাবে বনগাঁ- ত্রিপুরা মধ্যবর্তী নেকড়েমুক্ত ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের জনপদ, যেখানে নিজেদের অংশটুকুই দুধেলদের লাথিতে ভেঙে পড়োপড়ো?! পঞ্চাশ কিলো চাল, কুড়ি কিলো ডালের নবাবী ভুরিভোজ করিয়ে লাথির জোর আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে! ইচ্ছে ছিলো একবার ওদেশে যাবো,খুঁজে দেখবো আমার অজানা অস্তিত্বের একখন্ড নির্যাস৷ আমার মাও তাই চান৷ পরে জানলাম, ওই অঞ্চলে হুজুরীয়ানার দাপট ভীষণ বেশী,শীতকালে নাকি ও*য়াজে ও*য়াজে বাতাস ভরপুর থাকে৷ সংখ্যালঘুদের শুধু বেঁচে থাকার জন্য কোনমতে বেঁচে থাকা৷ পরিচিত এক দাদা,দুমাস আগে ওদের সাতক্ষীরার পুরোনো বাড়িতে গেছিলো, পরিকল্পনা ছিলো তুতোভাইদের সাথে সপ্তাদুয়েক আড্ডা গল্পে কাটাবে,কিন্তু দিনসাতেক পরেই ফিরে আসে৷এত তাড়াতাড়ি চলে এলে,জিজ্ঞেস করতেই বললো,'ভালো লাগলো না,রে৷ওরা একদম ভালো নেই৷'তারপর দুজনেই নিশ্চুপ৷ এই প্রথম একজন ধর্মনিরপেক্ষ সুশীলের সত্যদর্শন জনিত অনুশোচনা হচ্ছে দেখে,আমার হাসি পায় নি৷ আমাদেরও ঢাকায় জনাকয়েক আত্মীয়স্বজন আছেন৷ তবে, আমরা যাবো, ওদের পরিস্থিতি দেখবো,কিঞ্চিৎ 'আহা,উহু' করবো, মানুষগুলোকে এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইছি না৷ চাই না, ওরা আমাদের অনুকম্পার পাত্র হোক, সংকুচিত হয়ে পড়ুক৷ আমার ওই না দেখা দেশটির প্রতি কোনরুপ ভালোবাসা নেই,পড়ে আছে কেবল নষ্টালজিয়ার সরণীতে একদলা ঘৃণামিশ্রিত অনুভুতি৷ বাঙালীর খুনে লাল হয়েছিলো যেথা কা*শেম-স*রোওয়ারের খঞ্জর, সেই ভুমিতে দাঁড়িয়ে একটা প্রতিজ্ঞা করার ছিলো মাত্র৷

আমার বাড়ির কাছের স্টেশানেও এমন একটা সাইনবোর্ড আছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, একটা ছবি তুলে রাখবো৷ এই অসম লড়াইয়ে যদি শেষ অবধি পর্যদুস্ত হতে হয়,যদি আমার চিরপরিচিত দুই বিঘা জমির মায়াত্যাগ করে অনিশ্চয়তার সহচর হতে হয়, খুঁজতে হয় অপেক্ষাকৃত কোন 'নিরাপদ' আশ্রয়,তবে উত্তরপ্রজন্মকে ছবিটা দেখাবো এবং সত্যের অপলাপ না করেই জানাবো, 'হ্যাঁ,এখানে আমাদের বাড়ি ছিলো৷ ওদের জন্য সব হারিয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে,হেরে গেছিলাম সেদিন৷' যাতে, ওদের গুগল ঘেঁটে হলোকস্ট ইতিহাস না খুঁজতে হয়, আমার মত৷ এই কারণেই সুশীলতা বিষবৎ পরিত্যাজ্য৷ আত্মবিস্মৃত জাতির নির্মাণ ব্যাতীত সুশীলতা আর কিসসু দেয় নি৷ ডারউইনের আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম, যোগ্যতমের উদবর্তন,অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম, বিবর্তনের প্রয়োজনীয় প্রকরণ, এগুলো তো স্রেফ মুখস্থ করে খাতায় লিখে আসার বিষয় ছিলো না৷ হাতের সামনে নোয়াখালী জেনোসাইডের মত এমন যথাযথভাবে প্রমাণিত দুর্ভাগ্যজনক 'স্যাম্পেল', ডারউইন বোঝার মেশিনারি আর কটা জাতিই বা পেয়েছে?!

'নদীরে কতই রঙ্গ দেখাবি আমায়৷ সারাজীবন বাইলাম তরী, নিলি না কিনারায় রে,নদীরে.........

~এডিটর

#সাতদশকেরযন্ত্রণা

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted