৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররা গুলি খেয়ে মারা গেলো।

৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররা গুলি খেয়ে মারা গেলো। দেশ স্বাধীন হবার আগ পর্যন্ত এই আন্দোলন আসলে নিছকই একটা রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ছিলো। গুলি যে চালিয়েছিলো সেই পুলিশ আর যে নির্দেশ দিয়েছিলো সকলেই এদেশীয়। তবু ভাষা আন্দোলনকে এমন করে বলা হয় যেন উপনিবেশ কোন বিদেশী শক্তি বাংলা ভাষার জন্য করা মিছিলে গুলি চালিয়ে ছিলো! 

মুনির চৌধুরী কবর নামে এই হত্যাকান্ড নিয়ে খুবই মর্মস্পর্শী একটি নাটক লিখেছিলেন। পাত্রপাত্রী সকলেই এদেশীয়। নেতা, ইন্সেপেক্টর হাফিজ সকলেই। জেগে উঠা ছাত্র আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে গুলি খেয়ে মরা লাশগুলোকে মাটির নিচে পাতাল পর্যন্ত কবর খুড়ে মাটি দিতে নেতা আর হাফিস চেষ্টা করেন। এই হাফিজের মত পুলিশরাই কিন্তু ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম হামলার শিকার হোন। খুবই অদ্ভূত ব্যাপার। শত্রু মিত্র মেলানো বেশ কঠিন ব্যাপার। কবর নাটকের পুলিশ অফিসার হাফিজ রাজনৈতিক নেতাকে বারবার বলছিলেন, পাকিস্তান হবার পরও আমাদের কোন উন্নতি হলো না স্যার, যে পেটি-অফিসার ছিলাম তা-ই থেকে গেলাম…।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কি এই উন্নতির আকাঙ্খা থেকেই? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত যতগুলি রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ পাওয়া যায়, তাকে ঘিরে লেখা নাটক উপন্যাস প্রবন্ধ- কোথাও ‘পাকিস্তান’ যে দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিলো তার বিরুদ্ধতা পাওয়া যায় না। পশ্চিমা শাসকদের অগণতান্দ্রিক দমন পীড়ন থেকে মুক্তির স্পর্ধা বা বাহি:প্রকাশকেই আমরা ‘স্বাধীনতা’ বলতে পারি। সে অর্থে পাকিস্তান থেকে আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম বৈকি। কিন্তু কোথাও দ্বিজাতিতত্ত্বকে থুতু দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছি বলে উল্লেখ নেই।

মুসলমান হলেই যে এক জাতি নয়, শুধু ধর্মের মিল হলেই যে ভিন্ন দুটি সংস্কৃতি জাতিসত্ত্বাকে কৃত্রিমভাবে কোন জাতি সৃষ্টি করা যায় না সেটা দুই পাকিস্তান ২৩ বছর পর ভেঙ্গে গিয়ে প্রমাণ করেছে। তাতে কি দ্বিজাতিতত্ত্ব হেরে গেছে? মোটেই নয়। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী মুসলমানের কাছে দ্বিজাতি তত্ত্ব ছিলো বাঙালী হিন্দুর সঙ্গে বিচ্ছেদ নিশ্চিত করা। সেটি সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে আর কোনদিন রাজনৈতিকভাবে কোন অমুসলিম কমিউনিটি উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এটাই ছিলো দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের পাকিস্তান আন্দোলনের প্রাণ ভ্রমরা। 

হিন্দুরা ভারতে চলে গেছে এটি নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। যারা চলে গেছে তাদের ভালোই হয়েছে। বাকী যারা আছে তারাও সবাই একদিন চলে যাবে। খারাপ হবে না। বাংলাদেশ চিরকাল মুসলমানদের দেশ থাকবে এটিই নিশ্চিত করা হয়েছিলো। হিন্দুরা থাকলে রেষারেষি থাকত। বড় জাতের হিন্দুরা মুসলমানদের নমশুদ্রই মনে করত। মুসলমানরাও হিন্দুদের মা*লাউন ছাড়া আলাদা কোন সন্মানের চোখে দেখত না। ভারত ভাগের পর মুসলমানদের চোখে তারা হয়ে গেলো ‘ভারতের এজেন্ট’। পাকিস্তানের ২৩ বছর কেবলই ইন্ডিয়ার স্পাই আর তাদের ষড়যন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের মাথা ঘামাতে হয়েছে। এদেশের মানুষ বরাবরই ছিলো ইসলাম প্রেমি মুসলমান। একই সঙ্গে হিন্দু বিরোধী। হিন্দুরাও তাই ছিলো। এজন্যই বলেছি হিন্দুরা যারা চলে গেছে ভালোই হয়েছে। সেখানেই তারা ভালো থাকবে। এটা মুসলমানদেরই দেশ। এই সত্যটা যে বলবে তাকেই আমরা ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে দাগিয়ে দিবো!

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে যদি তর্কের খাতিরে একটি সেক্যুলার ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার লক্ষ্যে পরিচালিত বলে ধরে নেই তবে সেটা কেবলই মুসলমানদের জন্য। কারণ সেক্যুলারিজমের সুফল পাওয়ার মত জনসংখ্যার ধর্মীয় অনুপাতে অমুসলিমরা তখন ছিলো না। ১০০ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে সেক্যুলারিজম দরকার মুসলমানদের জন্যই। যেসব মুসলমানরা স্বাধীন গণতান্ত্রিক পশ্চিমা দর্শনে চলতে চান তারা ইসলামিক গোঁড়ামীর হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতেই সেক্যুলারিজম চান। বাংলাদেশে ৭২ সালের সংবিধান থাকলেও কি কোন হিন্দু রাষ্ট্রপতি হতে পারত? পাকিস্তানের যে পতাকাটা দেখেন, যেটা নিয়ে পাকিস্তানীরা অন্যসব দেশের নাগরিকদের মত সন্মান করে, সেখানে সবুজের সঙ্গে সাদা অংশটি হচ্ছে অমুসলিম নাগরিদের পাকিস্তানে সমান অধিকার নিশ্চিত করার ইঙ্গিত। তাতেই কি পাকিস্তানে কোন অমুসলিম সুখে আছে? লাহোর করাচি এই পুরোনো শহরগুলো ছিলো হিন্দু ও শিখদের। দ্বিজাতি তত্ত্ব নিশ্চিত করেছে ওখানে শিখ ও হিন্দুরা কোনদিন মুসলমানদের উপর রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখাতে পারবে না। এরপর পাকিস্তানের জাতির পিতা জিন্নাহ সাহেব তার দেশের পতাকায় সাদা রঙ দিয়ে সংখ্যালঘু অধিকার সংরক্ষণ করলেই কি না করলেই কি?

১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বেদনার দিন। এই গোটা ‘বাংলাদেশ’ আর মুজিব এতটাই অভিন্ন যে একটা ছেড়ে অন্যটাকে কল্পনাও করা যায় না। এদেশের মানুষের জন্য মুজিব তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবাণ সময়টুকু জেলে কাটিয়েছেন। এদেশের মানুষকে তিনি সত্যিকারের ভালোবাসতেন। মুজিব পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন। তিনিই আবার পাকিস্তান ভেঙ্গেছেন। সবটাই এদেশের মানুষের কথা ভেবে। এই দেশের জাতীয় সংগীতটা তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে বেছে নিয়েছিলেন। ৭২ সালের সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে যা কিছুই করা হোক তার ফয়সালা হয়ে গেছে ১৯৪৭ সালে। এখন যারা হাজার কোটি টাকা কানাডা পাচার করে, দেশের মন্ত্রী মিনিস্টার হয়- তারা সকলেই প্রথমত দেশভাগের কাছে ঋণী! কারণ দেশভাগই একছত্র ‘মুসলমান’ নির্ধারণ করে দিয়েছিলো। তারপর মুজিব বাংলাদেশ না করলে পাঞ্জাবী পাঠান সিদ্ধিদের সঙ্গে বাঙালীরা পারত? এই যে ‘বাঙালী মুসলমানের’ ক্ষমতায়ন এটি দ্বিজাতিতত্ত্ব ও মুক্তিযুদ্ধ মিলিতভাবে সম্ভব করেছে। তবু দুটি কোনভাবেই এক জিনিস নয়। বাংলাদেশের মানুষের পিঠের চামড়া দিয়ে মুজিবের পায়ে জুতা বানিয়ে দিলেও তাঁর ঋণ শোধ হবে না। এটা কিন্তু আবেগের কথা নয়, সত্য ইতিহাস। স্বাধীনতা আমাদের সিস্টেম বদল করেনি সত্য, তবে কোন এক পাঠান বা পাঞ্জাবীর বদলে রুবানা হক গার্মেন্টস ব্যবসার নেতা হয়েছেন সে তো মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো বলেই! লাভ বলতে এটুকুই। আগে অবাঙালীরা শোষন করত এখন বাঙালী মুসলমানকে বাঙালী মুসলমানই শোষন করছে!

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted